হিরোশিমায় প্রেসিডেন্ট ওবামার সাম্প্রতিক সফরের সাথে সাথেই একটি প্রশ্ন পুনরায় জেগে উঠে, ” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন পারমানবিক বোমাগুলো নিক্ষেপ করেছিল?” আত্মসমর্পণের জন্য জাপানকে রাজি করাতে কি এর প্রয়োজন ছিল? এটা যতটা প্রাণ কেড়ে নেয় তার চেয়ে বেশি কি বাঁচিয়েছিল অন্য পক্ষের, একটি দীর্ঘ বহিরাক্রমণ এড়ানোর দ্বারা?
১৯৬০-এর দশকের শুরুতে, “ভিয়েতনাম যুদ্ধ” যুদ্ধের নৈতিকতা এবং যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তার উপর অনেক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, যা মানুষকে নিয়ে যায়- হিরোশিমা এবং নাগাসাকির বোমাবর্ষণ আদৌ প্রয়োজনীয় ছিল কিনা এমন ধারণার প্রতি। অর্থনীতিবিদ “গার আলপারোভিটস” ইতিহাসবেত্তাদের একটি নতুন দলকে তর্কের জন্য নেতৃত্ব দেন যে বোমার উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েতকে ভয় দেখানো এবং জাপানিদের পরাজিত করা নয়। ১৯৯৫ সাল নাগাদ, আমেরিকান জনগণ এই বিষয়ে এতই বিভাজিত ছিল যে স্মিথসোনিয়ানে ৫০তম বার্ষিক প্রদর্শনী বার বার পরিবর্তন করতে হয়।
এই আবেগই এই বিতর্কের উৎসাহ যুগিয়েছে। ফলস্বরূপ, পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজ এবং ডকুমেন্টারী রিলিজগুলি যা বোমার ব্যবহার সম্পর্কিত তত্ত্বগুলিকে অগ্রাহ্য করত, তা সবার নজর এড়িয়ে যায়। ১৯৭৩ সালে ফিরে দেখলে, রবার্ট জেমস ম্যাডুক্স প্রমাণ করেছিলেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভয় দেখানোর বিষয়ে আলপারোভিটসের যুক্তি যুক্তিহীন ছিল, তবে সাধারণ জনগণের ধারণার উপর এর প্রভাব খুব কম ছিল।
এ তথ্যগুলো একটা নজির রাখে যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এর মনোবল ছিল বোমাগুলোর সত্যিকারের লক্ষ্য, নির্ভর করছিল ট্রুম্যান ও তার পরামর্শদাতারা কি ভাবছিলেন এর উপর – এমন কোন তথ্য ছিল না প্রমাণ করার জন্য যে তারা সোভিয়েতদের বোমা দিয়ে ভয় দেখানোর প্রয়োজন অনুভব করছিলেন। অন্যান্য গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে জাপানীরা আমেরিকার শর্তগুলিতে আত্মসমর্পণ করতে চায়নি। পরিবর্তে, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, যাতে জীবাণু অস্ত্রের সম্ভাব্য ব্যবহারও অন্তর্ভুক্ত ছিল, এবং তারা সবচেয়ে দৃঢ় প্রতিবন্ধকতা গড়ে তুলতে চেয়েছিল। এই পদ্ধতিতে যুদ্ধের অনুমতি দেয়ার ফল আমেরিকা ও তার বন্ধু রাষ্ট্রেদের জন্য খারাপ হত, নিশ্চয়ই আরো খারাপ হতো দীর্ঘমেয়াদে জাপানের জন্য।
১৯৪৩ সালে কাসাব্লাংকা কনফারেন্সে, প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য উপস্থাপন করেন – তার শত্রুদের শর্তহীন আত্মসমর্পণ, তাদের অঞ্চল দখল করার সুযোগ, নতুন রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা, যেহেতু মিত্রশক্তি প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল। ১৯৪৫ সালের গ্রীষ্মে, এই শর্ত গুলো জার্মানির উপর আরোপিত করা হয়েছিল, ১৯৯৯ সালের বই, “ডাউনফল” অনুযায়ী, জাপান সরকারের মতে, এটা মানলে যুদ্ধ জয় হত না, এজন্য আমেরিকান শর্তগুলো গ্রহণে তারা ইচ্ছুক ছিল না। তারা বিশেষ করে দখলদারিত্বের বিরোধিতা করেছিল এবং তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার যেকোন পরিবর্তনের প্রতি।
জানা যায় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউশু দ্বীপে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
জাপানিরা দ্বীপটিকে শক্তিশালী করে তোলে এবং পরিকল্পনা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে যাতে তারা দ্বীপ দখলের ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে এবং হাল ছেড়ে দেয়। ১৯৪৫ সালের জুলাইয়ের শেষের দিকে, সেনাপ্রধান স্টাফ জেনারেল জর্জ সি. মার্শাল যথেষ্ট ভাবছিলেন যে তিনি জেনারেল ম্যাক আর্থারকে আক্রমণ পুনর্বিবেচনার জন্য এবং যদি সম্ভব হয় পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলবেন।
তিনদিনের মধ্যেই হিরোশিমা এবং নাগাসাকির বোমাবর্ষণ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবস্থান, সম্রাট এবং জাপানের সরকারকে বোঝানো হয় আত্মসমর্পণই তাদের একমাত্র উপায়। প্রমাণ বেড়েই চলছিল যে জাপান কোন আক্রমণের পূর্বে আমেরিকার শর্তে আত্মসমর্পন করত না, যদি না বোমা নিক্ষেপ করা হত।
এটা বলা যায় না যে, একটি শহর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে এবং বেসামরিক জনগণকে পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে নিশ্চিহ্ন করা নৈতিকভাবে অনুমোদনযোগ্য। সৌভাগ্যবশত, কোন দেশ এই ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেনি সেই থেকে, এবং আমাদের কাজ করে যেতে হবে যেন ভবিষ্যতে এমন ধ্বংসযজ্ঞ আর দেখতে না হয়, সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা জাপানে তার সাম্প্রতিক সফরে এমনটি জোর দিয়ে বলেন।
পারমানবিক অস্ত্রের নৈতিকতার ওপর এটিই একমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম নয় । এ সংগ্রাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে মানুষের মাঝে বিকশিত মনোভাবের বিরুদ্ধেও। নাগাসাকি এবং হিরোশিমার কয়েকবছর পূর্বেই, ব্রিটিশ এবং আমেরিকান কৌশলবিদরা বৈধ কৌশল হিসেবে পুরো শহর পুড়িয়ে দেয়াকে প্রস্তাব করেছিল জার্মানি এবং জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহার করার জন্যে। হিরোশিমা ও নাগাসাকির হতাহতের তুলনায় হ্যামবুর্গ, ড্রেসডেন, টোকিও এবং জাপানের অন্যান্য শহরগুলির ফায়ারবম্বিংগুলি সমান বা তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এটা কিভাবে বৈধ যুদ্ধ কৌশল হয়ে ওঠে তা কম স্পষ্ট, কিন্তু এটা স্পষ্টত যে এই ধ্বংসযজ্ঞ হিরোশিমা আর নাগাসাকির পূর্বে ভালোই নজর এড়িয়ে যায়। বিখ্যাত পারমানবিক আঘাত গুলো একটি বিদ্যমান মানসিকতার ধারাবাহিকতা ছিল যা বেসামরিক জীবনকে সম্পূর্ণভাবে ব্যয়বহুল মনে করত, এবং এটি এমন একটি মনোভাব যা থেকে আমাদের দূরে সরতে সংগ্রাম করতে হবে, এমনকি যুদ্ধেও।