খেলা কখনো কখনো শুধুই খেলা নয়। কখনোওবা তা হয়ে ওঠে জীবনের প্রতিচ্ছবি। খেলা নিয়ে আমরা হাসি। আনন্দ পাই। চায়ের আড্ডায় ঝড় ওঠে এই খেলাকে ঘিরেই। টিভি স্ক্রিণে চোখ আটকে থাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো। আবার এই খেলাই আমাদের কাঁদায়। প্রিয় দলের পরাজয় সহ্য করতে না পেরে নিজের জীবনকেই শেষ করে দেয় অনেকে। এমন অসংখ্য নজীর আছে পৃথিবী জুড়েই। এই মূহুর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। ক্রিকেটকে ঘিরে আমাদের অনেক সুখ স্মৃতি আছে। আছে আনন্দ বেদনার কাব্য। নিজ দল, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে সমর্থন করার পাশাপাশি অন্যান্য দলকেও সমর্থন দিয়ে থাকেন আমাদের ক্রিকেটামোদী দর্শক। যুগ যুগ ধরে অনেক খেলাই হয়েছে। এর মধ্যে কিছু খেলার স্মৃতি আজও আমাদের মনকে নিয়ে যায় ঠিক সেই সময়ে। আমাদের কাঁদায়। কখনোবা ভাবায়। মনে হয়, যদি খেলাটা এমন না হয়ে অমন হত! তাহলে তো প্রিয় দলকে হারতে দেখতে হত না। ঠিক এমন ৮ টি ক্রিকেট ম্যাচের কথাই আজ আমি বলবো। প্রিয় পাঠক, চলুন না ঘুরে আসি সেই ম্যাচগুলোতে। আরেকবার।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিদায়
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। আজও মানু্ষের মুখে এই ম্যাচের কথা ফিরে ফিরে আসে। হয়তো ক্রিকেট খেলা যতদিন বেঁচে থাকবে, ঠিক ততদিন এই ম্যাচের কথা কেউ ভুলবে না। ল্যান্স ক্লুজনারের সেই পাগলা দৌঁড়, এলান ডোনাল্ড এর হাতের ব্যাট ফেলে দিয়ে সেই হতবিহবল দৃষ্টি, অস্ট্রেলিয়ানদের বুনো উল্লাস…সবই যেন এক একটি টুকরো টুকরো মুহুর্তের গল্প। স্বপ্নপূরণ কিংবা দুঃস্বপ্নের আখ্যান।
২য় টেস্ট,এশেজ ২০০৫
সীমিত ওভার ছেড়ে এবার একটু টেস্ট ম্যাচে আসা যাক। সব অস্ট্রেলিয়ানই চাইবে ২০০৫ সালের এশেজকে ভুলে যেতে। আরো বেশি করে চাইবেন হয়তো ব্রেট লি। ২য় টেস্ট জয়ের দ্বারপ্রান্তে অস্ট্রেলিয়া। উইকেটে ব্রেট লি এবং মাইকেল ক্যাসপ্রোভিচ। জয় যখন ঠিক ২ রান দূরে, আম্পায়ারের একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তের শিকার হন ক্যাস্প্রোভিচ। শেষ উইকেট জুটিতে ৫৯ রানের জুটি গড়েও ৪৩ রানে অপরাজিত থেকে দুচোখভরা জল নিয়ে ড্রেসিংরুমে ফেরত আসেন ব্রেট লি।
মুলতান টেস্ট, বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান
একটি টেস্ট জয়ের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০০৫ সাল পর্যন্ত। এই অপেক্ষা ২০০৩ সালেই শেষ হতে পারতো। যদি না ইনজামাম উল হকের একটি অসাধারণ ইনিংস আমাদের স্বপ্নকে শেষ না করে দিত। জয়ের দ্বারপ্রান্তে থেকেও ওই এক ইনিংসের কাছেই আমরা সেদিন হেরে যাই। সেই সাথে ছিল রশিদ লতিফের সেই বিতর্কিত ক্যাচ। মাটি থেকে বল কুড়িয়ে নিয়েও তিনি আবেদন করেন এবং তার আবেদন সফল হয়। ম্যাচ শেষে সেদিন কেঁদেছিল দেশের সব মানুষ। চোখ মুছতে মুছতে অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজনের ড্রেসিং রুমে ফেরার দৃশ্য আজও চোখে লেগে আছে।
বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান, এশিয়া কাপ ফাইনাল, ২০১২
তর্ক হতে পারে, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ম্যাচ বোধ হয় এটাই। হাতের মুঠোয় থাকা ম্যাচ এইভাবে ২ রানে বাংলাদেশ হারবে, এটা বোধ হয় কেউ ভাবতেও পারেনি। কিন্তু এটাই হয়েছিল সেদিন। আমরা হেরেছিলাম। পূরণ হয়নি আমাদের এশিয়া কাপ জয়ের স্বপ্ন। সেদিন কেঁদেছিল সবাই। ক্রিকেটার থেকে শুরু করে দেশের সব মানুষ। সাকিব আল হাসানের কান্নাজড়ানো সেই মুখের ছবি দেখলে বুকের ভেতর মোচড় দেয় না,এমন বাঙালি বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এশিয়া কাপ সেমিফাইনাল ২০১৬, বাংলাদেশ বনাম ভারত
আবারো দৃশ্যপটে বাংলাদেশ। এবার প্রতিপক্ষ ভারত। জয়ের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে অবিবেচকের মতো ব্যাট চালাতে গিয়ে সেদিন আউট হয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম আর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। ৩ বলে ২ রান, এই সহজ সমীকরণেই জয় সেদিন হয়ে গিয়েছিল সুদূর পরাহত। ম্যাচে বাংলাদেশ হেরে যায় ১ রানে। সেদিন হেরে গিয়েছিল পুরো ক্রিকেটপ্রেমী বাঙালি জাতিই। ম্যাচ শেষ হয়েছে আজ কয়েক মাস। কিন্তু সেই ম্যাচ নিয়ে আজো মানুষের মধ্যে আলোচনা হয়। কথা হয়। গল্প হয়। সেই গল্পে মিশে থাকে এক টুকরো হতাশা আর চাপা কান্না। যদি ৩ বলে ২ রান করে ফেলতো বাংলাদেশ? এই আক্ষেপ বোধ হয় আমাদের কোনদিনও যাবে না।
ডন ব্রাডম্যানের শেষ ইনিংসে শুন্য
অসংখ্য স্মরণীয় ইনিংস তিনি খেলেছেন। উঠেছেন খ্যাতি আর সম্মান এর চূড়ায়। কিন্তু জীবনের শেষ ইনিংসেই তাঁর কি যেন হলো। তিনি যেন ব্যাট করতে ভুলে গেলেন। জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংসে ০ রানে আউট হলেন তিনি। ক্যারিয়ার গড়ও আর ১০০ হলো না তার। রয়ে গেল ৯৯.৯৪ এই।
দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম নিউজিল্যান্ড
২০১৫ এর বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে। আরেকটি বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। দৃশ্যপটে আবারো দক্ষিণ আফ্রিকা। এবার প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবেশী দেশ নিউজিল্যান্ড। প্রতিপক্ষ ভিন্ন হলেও ফলাফল হলো অভিন্ন। দক্ষিণ আফ্রিকার কান্না আরেকবার দেখলো বিশ্বকাপের বড় মঞ্চ। প্রথমে ব্যাট করে দক্ষিন আফ্রিকা করেছিল ৪৩ ওভারে ২৮১। ডাকওয়ার্থ লুইসের অদ্ভূত নিয়মে সেই টার্গেট গিয়ে দাঁড়ায় ৪৩ ওভারে ২৯৮. সেই অসম্ভব টার্গেটের পিছে ছুটেও গ্রান্ট এলিয়টের অসাধারণ এক ইনিংসের উপরে ভর করে নিউজিল্যান্ড সেই রানে পৌঁছে যায় অবলীলায়। ম্যাচ শেষে এ বি ডি ভিলিয়ার্স এর কান্নাভেজা মুখ, পিচে শুয়ে পরা ডেল স্টেইন এই ম্যাচের হাইলাইটস হয়ে আছে।
ভারত বনাম শ্রীলঙ্কা, বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল ১৯৯৬
শ্রীলঙ্কার করা ২৫১ রানের জবাবে প্রবল বেগে ছুটছে ভারত। মাত্র ১ উইকেটের বিনিময়েই তারা তুলে ফেললো ৯৮ রান। ভারর্তীয় সমর্থকরা যখন আরেকটি বিশ্বকাপ ফাইনালের স্বপ্নে বিভোর হয়ে কেবলই সুখস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন, ঠিক তখনই দৃশ্যপটে এসে পড়লেন ভাগ্যবিধাতা। হঠাৎ করেই ২২ রানের মধ্যে টপাটপ ৭ উইকেট পড়ে গেল। ম্যাচ ঘুরে গেলো শ্রীলঙ্কার দিকে। যাই হোক, ৮ম উইকেটের পতন ঘটলো, মাঠে উপস্থিত ভার্তীয় দর্শকরা মেজাজ ঠিক রাখতে পারলেন না। শুরু হলো মাঠে হট্টগোল, বোতল নিক্ষেপ। অবস্থা যখন একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলো, ম্যাচ রেফারি ক্লাইভ লয়েড কোন উপায় না দেখে ম্যাচটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করলেন। ম্যাচ জিতে স্বপ্নের ফাইনালে চলে গেল শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়েরা যখন বুনো উল্লাসে মত্ত, ঠিক সেই সময় ভারতের বিনোদ কাম্বলির অশ্রুসজল চোখে মাঝপিচে দাড়িয়ে থাকার দৃশ্য আজো অনেকের চোখে লেগে আছে।
লেখক সম্পর্কেঃ ইশফাক জামান। পেশায় প্রকৌশলী, নেশায় কবি ও লেখক। শখ কবিতা লেখা, ফিচার লেখা, অনুবাদ করা। বিভিন্ন অনলাইন (অফলাইন ও) ম্যাগাজিনে লেখালেখি করছি বেশ কয়েক বছর। পেশাগত জীবনে Linde Bangladesh Ltd. এ Territory Manager হিসেবে কর্মরত আছি।