বিগত ২০০ বছরে মানব সভ্যতা চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি করেছে । যদিও এখনো কিছু রোগ অনিরাময়যোগ্য রয়ে গেছে তথাপি এখন পর্যন্ত আমরা রোগতত্ত্ব সম্পর্কে অনেক বেশিই জেনেছি । এরপরেও বিগত শতাব্দী থেকে এখন পর্যন্ত এমন কিছু মহামারী হয়ে গেছে যেগুলো আমাদের চিকিৎসা ব্যাবস্থাকে সংকটময় করেছে । কিছু মহামারীকে মাস হ্যালুসিনেশন কিংবা হিস্টেরিয়া বলে ব্যাখ্যা করা গেলেও বাকি গুলোর জন্য কোন যুক্তি ও ব্যাখ্যা খাটে না । এরকম ১০ টি মহামারীর কথাই বলা হয়েছে আজকের লেখায় ।
১। কারাঙ্কাসের উল্কা পতন জনিত অসুস্থতা
২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝ রাতে বলিভিয়ার পেরুভিয়ান সীমান্তে একটা উল্কা পিণ্ড পতিত হয়। আপাত দৃষ্টিতে এটার কোন প্রভাব তখন চোখে পড়েনি । কারাঙ্কাস শহরের কাছেই পতিত হয়েছিল উল্কাটি। প্রত্যক্ষদর্শীরা ১০০০ মিটার উঁচু আগুনের ফুলকি দেখেছিল। কিন্তু এর থেকেও ভয়াবহ বিপদ এগিয়ে আসছিল শহরটির দিকে ।
উল্কা পতনের পর ওই শহরের প্রায় ১০০ মানুষ অজানা এক মহামারীতে আক্রান্ত হয় । প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা এবং বমির সাথে শুরু হয় ডায়রিয়া । ডায়রিয়া খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে । প্রকোপ এতোটাই বেড়ে গেলো যে ডাক্তাররা রোগী সামলাতে হিমশিম খেতে লাগলো ।
এই রহস্যময় মহামারীর কোন যুক্তিযুক্ত কারণ পাওয়া যায়নি । কেউ বের করতে পারেনি ঠিক কি কারণে এই মহামারী হয়েছিল । অনেকেই বলেন উল্কা পতনের কারণে ওই স্থানের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা অনেক বেড়ে গিয়েছিল , যার কারণে মহামারী ছড়িয়ে পড়ে । কিন্তু পেরুভিয়ান ভূতত্ত্ববিদেরা এর সাথে একমত পোষণ করেন না । তথাপি এই মহামারীর আসল কারণটা এখনো অজ্ঞাত ।
২। জুন বাগ বা পোকা মহামারী
১৯৬২ সালে আমেরিকার পোশাক মিলের এক শ্রমিক দাবী করে তাকে এক প্রকারের মারাত্মক পোকা (বাগ )আক্রমণ করেছে। বলা হয়, ইংল্যান্ড থেকে কাপড়ের যে নতুন ব্যাচ এসেছে সেখান থেকেই এই পোকার উৎপত্তি । শ্রমিকরা কাজে যেতে অস্বীকৃতি জানালো । এই পোকার আক্রমণে শরীরে কিছু উপসর্গ তৈরি হয় । যেমন, মাথা ব্যাথা, র্যাশ, ঝিমুনি ইত্যাদি । এই একই রকম উপসর্গ দেখা গিয়েছিল প্রায় ৫০ জনের । মিল কর্তৃপক্ষ ঘটনার তদন্ত করার জন্য উৎপাদন বন্ধ করে দিলো । কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এরকম কোন বাগের প্রমাণ তখন পাওয়া যায়নি । এছাড়াও পুরো কারখানায় এমন কোন কীটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি যেগুলো ভয়াবহ উপসর্গ গুলো সৃষ্টি করে ।
কিছু না পাওয়া গেলেও পুরো মিলটিতে কীটনাশক স্প্রে করা হয় । মজার ব্যাপার হচ্ছে স্প্রে করার পর কারখানাটি যখন পুনরায় চালু করা হয় তখন কোন শ্রমিক অভিযোগ করলো না যে তাদেরকে জুন বাগ কামড়েছে । আসলে কি সত্যিই কাপড়ের মাঝে কিছু ছিল ??
৩। সংক্রামক হাসির মহামারী
১৯৬২ সাল রহস্যময় মহামারীর জন্য বিখ্যাত । সংক্রামক হাসির ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল তাঞ্জানিয়ার এক গ্রামে । সেখানকার এক বোর্ডিং স্কুলের মেয়েদের মধ্যে ব্যাপারটা প্রথম ধরা পড়ে । মাত্র ৩ জন ছাত্রী থেকে ব্যাপারটা শুরু হয় এবং ১ দিনেই প্রায় ৯৫ জন এই রোগে আক্রান্ত হয় । ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল জানুয়ারির ৩০ তারিখে এবং অবস্থা বেগতিক হওয়ায় মার্চের ৩০ তারিখ স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয় ।
স্কুল বন্ধ হওয়ার পর যারা আক্রান্ত হয়েছিল তাদের আলাদা করে ফেলা হয় । গল্পের ভয়াবহ অংশের শুরুটাই এখানে । যদিও ভাবা হয়েছিল এভাবেই রোগটা নিরাময় হয়ে যাবে কিন্তু আসলে তা হয় নি । মে মাসের মধ্যে নতুন করে প্রায় ২০০ জন এইরোগে আক্রান্ত হয় । জুন মাসে বুকউবা স্কুলের আরো ৫০ জনের মাঝে এটি ছড়িয়ে পড়ে । এর মাঝে কয়েকজন মারাও যায় । নতুন করে আরো ১০০০ ছাত্রছাত্রী আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ১৪ টি স্কুল বন্ধ হয়ে যায় । এখন পর্যন্ত এই ঘটনার সত্যিকারের কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি ।
৪। স্লিপিং সিকনেস
এটা সাম্প্রতিককালের ঘটনা। ২০১৩ সাল। কাজাকিস্তানের একটি গ্রাম কালাচি । এই গ্রামের লোকজন আচমকা ক্লান্তি বোধ করতে শুরু করলো এবং এক সময় ঘুমিয়ে গেলো । পুরো গ্রামের চার ভাগের এক ভাগ লোক ঘুমিয়েই দিন পার করতে লাগলো । অনেকটা কোমার মতো অবস্থা । কোন খেয়াল নাই । ঘুমিয়েই যাচ্ছে । এই ঘটনাটির সত্যিকারের কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত ।
একজন রাশিয়ান বিজ্ঞানি মত প্রদান করেন যে , মাইন বোমাতে যে রেডন গ্যাস থাকে সেটা কোন অবমুক্ত হয়ে গেলে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে । কিন্তু তার এই তত্ত্বটি খুব জোরালো কিছু ছিল না । এখন পর্যন্ত ঘটনাটির কারণ অজ্ঞাত ।
৫। জ্ঞান হারানোর অজ্ঞাত ঘটনা
১৯৮৩ সালের ঘটনা। প্যালেস্টাইনের এক স্কুল ছাত্রী আচমকা কাশতে শুরু করলো। একসময় তার শ্বাস কষ্ট শুরু হয় এবং মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে যায়। কয়েক ঘণ্টার মাঝেই আরেকজন মেয়ে একই উপসর্গে আক্রান্ত হয় এবং অজ্ঞান হয়ে যায়। ঘটনাটি এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। এক সপ্তাহের মাঝে প্রায় ৯০০ লোকের মাঝে এই উপসর্গগুলো দেখা দেয় । কিন্তু এর কারণ কি ছিল সেটা কেউ বলতে পারে না ।
প্যালেস্টাইনের সাবেক মেয়র ওয়ালিদ হামাদাল্লাহ ঘোষণা করেন এর কারণ হচ্ছে কিছু বিষাক্ত উপাদান । বিষাক্ত কিছু গ্যাস । এবং এটার কারণ ছিল ইসরাইল।
যাই হোক, যে স্কুল থেকে ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল সেখানে তদন্ত করা হলো । কিন্তু সেখানে কিছু পাওয়া যায়নি । শুধু পাওয়া গিয়েছিল সামান্য পরিমা্হাণ ইড্রোজেন সালফাইড । তবে এই পরিমা্ণ হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস এতো বড় বিপর্যয় ঘটাতে পারে না ।আসল কারণটা কিন্তু এখনো অজ্ঞাত ।
৬। পাপের নৃত্য বা ড্যান্স অব সিন
বিগত শতকগুলোতে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যার ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি । নৃত্য সম্পর্কিত এই ঘটনাটি অন্য যে কোন ঘটনাকে হার মানাবে । “”শয়তানের অভিশাপ “” কথাটি এর সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত । ১৫১৮ সালে রোমান সাম্রাজ্যে এরকমই একটি ঘটনার জন্ম হয়েছিল ।
একটা সরু রাস্তার গলিতে ফারূ ত্রফিয়া নামের এক মহিলা নাচতে শুরু করলো । বিরতিহীনভাবে এই নাচ চলল টানা ৬ দিন । এক সপ্তাহের মাঝে ওই এলাকার ৪০ জন মানুষ একই ভাবে রাস্তায় নাচতে শুরু করলো । মাস শেষে সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ালো চারশো জনে । অতিরিক্ত হাঁপানিতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১২ জন লোক মারা গেলো ।
১০২১ সালে জার্মানির কল্বিক শহরে একই রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল । সেখানে ১৮ জন মানুষ একটা চার্চের বাইরে বিরতিহীন ভাবে নাচতে শুরু করলো । ধারনা করা হয় এটা ছিল তাদের “”পাপের নৃত্য “। এই ঘটনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল নগণ্য । তবে অন্য সব ঘটনার মতো এটাও ইতিহাসের পাতায় হয়ে আছে রহস্যময় ।
৭। পোকেমন শক
১৯৯৭ সালে জাপানের প্রায় ৭০০ শিশু অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় । ঘটনার কারন জনপ্রিয় কার্টুন সিরিজ পোকেমনের নতুন পর্ব “” DENNO SENSI PORYGON “” । বলা হয়ে থাকে এই সিরিজে যে অধিক ফ্ল্যাশ লাইট আর সাউন্ড ব্যবহার করা হয়েছে সেটারই প্রভাব পড়েছে শিশুদের মস্তিস্কে ।
যদিও এটা অদ্ভুত শোনায় যে একটা টেলিভিশন প্রোগ্রাম কিভাবে এতো লোককে অসুস্থ করে ফেলে তথাপি অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটেছিল পর্তুগালে । সেখানকার নিয়মিত সিরিয়াল “”morangoos com aucera “” দেখেও স্কুলগামী অনেক ছেলে মেয়ে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল ।
এসব কিছুই প্রমাণ করে একটা টিভি প্রোগ্রামও কতো ভয়ানক প্রভাব ফেলতে পারে যদিও বিজ্ঞান এখনো সেটা ব্যাখ্যা করতে পারেনি ।
৮। পিকারডি সোয়েট সিকনেস
১৫-১৬ শতকে ইউরোপে এই অসুখের উৎপত্তি । ঘামতে ঘামতে অবশ হয়ে যাওয়া ছিল এই রোগের লক্ষণ । ধারণা করা হয় ফ্রান্স থেকে এই রোগের আগমন ঘটে । প্রায় হাজারখানেক লোক এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় ।
বলা হয়ে থাকে এটা কোন ভাইরাস জনিত রোগ। মৃত্যুর হার শতকরা ৫০ ভাগ। উৎপত্তি যেভাবেই হোক না কেন ১৫ শতকের শেষ দিকে এই ভাইরাসটা দূর হতে থাকে । এবং ১৫৭৮ সালের মাঝে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায় । তবে এর ঠিক ১০০ বছর পরে ফ্রান্সে আবারো এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয় । তৎকালীন চিকিৎসকেরা এই রোগের কোন বিস্তারিত কারণ খুঁজে পাননি ।
১৯০৬ সালে এই ভাইরাস আবার আঘাত হানে এবং প্রায় ৬ হাজার মানুষকে আক্রান্ত করে । এরপর এটি পৃথিবী থেকে আবারও বিলুপ্ত হয়ে যায় । কেনই বা আচমকা আসে আবার কেনই বা আচমকা মিলিয়ে যায় সেটা এখনো একটা রহস্য ।
৯। নোডিং সিনড্রোম
রোগী জোরপূর্বক মাথা ঝুঁকে থাকে বা নিচু করে রাখে । কিছু খেতে পারে না। ঘুমাতে পারে না । শারীরিক এবং মানসিক কারনে এই রোগটি হয়ে থাকে । ১৯৬২ সালে এই রোগটি প্রথম শনাক্ত করা হয় তাঞ্জানিয়া , উগান্ডা এবং দক্ষিণ সুদানে । এই অঞ্চলগুলোতে সাম্প্রতিক সময়েও নোডিং সিনড্রোম শনাক্ত করা হয়েছে । ৫-১৫ বছরের শিশুরা এই রোগে আক্রান্ত হয় বেশি । রোগটি খুবই ভয়ানক । এখনো রোগটির কারণ জানা না গেলেও ডাক্তাররা এই ব্যপারে খুব আশাবাদী । তারা এর সাথে একটা “”প্যারাসাইটিক ওয়ার্ম “” এর সম্পর্ক পেয়েছেন । তবে এখন পর্যন্ত এর কোন প্রতিষেধক নেই ।
১০। ড্রোমমোনিয়া
১৮৮৬ সালে জিন আলবার্ট নামে এক ভদ্র লোককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় । অদ্ভুত ব্যপার হচ্ছে লোকটা নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে পারে না । কেন কিভাবে সে এখানে এসেছে তাও বলতে পারে না । তাকে স্মৃতিভ্রষ্ট অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল ।
তিনি প্রায়ই নিজেকে নতুন নতুন জায়গায় আবিস্কার করতেন। সম্পূর্ণ অসচেতনভাবে হেঁটে হেঁটে তিনি বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণ করতেন। ১৮৮১ সালে তিনি একই ভাবে হেঁটে হেঁটে ফ্রান্স থেকে রাশিয়াতে পাড়ি জমান । এই রোগটাকে বলা হয় “”pathological tourism “”কিংবা অস্বাভাবিক ভ্রমণ ইচ্ছা । ১৯ শতকে ফ্রান্সে এই মহামারী দেখা গিয়েছিল ।
১৯০৯ সালে বিজ্ঞানীরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছিলেন রোগটিকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য। কিন্তু পারেন নি । এই রোগের কারণটা আজও অজ্ঞাত হয়ে গেছে ।
লেখকঃ আরাফাত আব্দুল্লাহ । লেখালেখির সাথে যুক্ত আছি । কিছু অনুবাদের কাজ করেছি । প্রিয় কাজ সমসাময়িক বিষয়ের উপর লেখালেখি করা ।