এই লেখাটি পড়ার সময় না থাকলে, শুনতে পারেন এর অডিও ভার্সন। ক্লিক করুন নিচের প্লে-বাটনে।
শিশুতোষ বাচ্চাদের বইগুলো অনেক সময়ে বিভিন্ন রকম দুঃখ-দুর্দশা জনিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।জীবনের অপরিহার্য কিছু কষ্টকর পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল বইগুলো যখন কোন বড় প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পড়ে তখন তারা জীবনের এই বাস্তবতা বাচ্চাদের থেকে বেশি অনুধাবন করতে পারে।
১। স্যাড বুক, ২০০৪, মাইকেল রোজেন
মাইকেল রোজেন যুক্তরাজ্যের একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশুতোষ লেখক। তিনি ২০০৭-২০০৯সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের শিশুতোষ সাহিত্যের মুকুটভূষিত রাজকবি ছিলেন। ১৯৯৯সালে, তার ১৮ বছর বয়সী ছেলে এডি মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।২০০৪ সালে তার “স্যাড বুক”নামে বইটি প্রকাশিত হয় যা ছিল তার নিজস্ব কিছু দুঃখজনক ঘটনা নিয়ে রচিত। বইটির শুরু ছিল এমন-
আমি বিষণ্ণ।এই ছবিটি দেখে মনে হতে পারে আমি হাসিখুশি। সত্যি বলতে আমি বিষণ্ণ-দুখী কিন্তু অভিনয় করছি যেন আমি খুশি।আমি এটা করছি কারণ আমার বিষণ্ণতা মানুষ পছন্দ করেনা।
ব্ল্যাক কুয়েনটিন অত্যন্ত চমৎকারভাবে ছবির মাধ্যমে বিবর্ণ হারানো অনুভূতি তুলে ধরেছিলেন যা বইটির শব্দ পড়ে বোঝা কঠিন।
রোজেন বলেন এডি এর মৃত্যুর পর তিনি এই বইটি লিখেছিলেন, তিনি এখনও তার স্কুল দেখতে যান এবং স্কুলের বাচ্চাদের সাথে কথা বলেন।তিনি ছোট এডির গল্প করতেন আর তখন বাচ্চারা এডির বয়স জানতে চাইলে রোজেন বলতেন তার মৃত্যুর কথা।বাচ্চাদের আগ্রহ আরও বেড়ে যায় এবং তারা অনেক প্রশ্ন করতো। মাইকেল রোজেন স্যাড বইটি তাদের প্রশ্নের ব্যাখ্যাস্বরূপ লিখেছিলেন এবং এটি ছিল রোজেনের হারানো অনুভূতির ঘটনা।
২। লাভ ইয়ু ফরএভার, ১৯৮৬, রবার্ট মুনশ
রবার্ট মুনশ এর রচিত “লাভ ইয়ু ফরএভার” বইটি একটি ছেলে এবং তার মায়ের সম্পর্ক তুলে ধরে। ছেলেটির ছোট থেকে বড় হয়ে বেড়ে উঠা এবং মা তাকে ছোট থাকতে যেভাবে আদর করতেন বড় হওয়ার পরও ঠিক তেমনভাবেই আদর করতেন। মা তার ছেলেকে ধরে সবসময় একটি গান গাইতেন
আমি তোমাকে চিরদিন ভালবাসবো,
আমি তোমাকে সবসময় পছন্দ করব,
যতদিন আমি বেঁচে থাকবো
তুমি হবা আমার আদরের বাচ্চা।
উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে ছেলেটি বড় হয়ে যায় এবং মৃত্যুশয্যায় শাইত তার মাকে কোলে নিয়ে সেই গানটি গাইতে থাকে।
রবার্টের স্ত্রী যখন দুইবারই মৃত সন্তান প্রসব করেন তার পর থেকেই তিনি গল্পটি লিখার অনুপ্রেরণা পান। তিনি এই ছন্দটি তার মৃত বাচ্চাদের জন্য লিখেছিলেন। রবার্ট বইটি প্রকাশের কোন পরিকল্পনা করেননি প্রথমে যেহেতু এটি তার একটি ব্যক্তিগত ঘটনা থেকে লিখা। তবে তিনি মাঝে মাঝে যখন শ্রোতাদের তার উপন্যাস পড়ে শোনাতেন তখন লাভ ইয়ু ফরএভার গানটিও গাইতেন। আর তখন শ্রোতাদের আগ্রহ দেখে তিনি বইটি প্রকাশ করেন।
বইটি অ্যারিজোনাতে বেশি বিক্রি হয় কারণ সেখানে বাচ্চা কম। যারা প্রাপ্তবয়স্ক তারা তাদের বাবা-মার জন্য বইটি কিনতো,এটি বাবা-মার জন্য একটি মর্মান্তিক বই যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ১৯৮৬সালের প্রকাশনীর পূর্ব পর্যন্ত ১৫ মিলিয়নের উপর বইটি বিক্রি হয়। রবার্ট ১৯৯৯সালে বইটির জন্য দ্যা অর্ডার অব কানাডা পুরস্কার অর্জন করেন।
৩। ওল্ড ইয়েলার, ১৯৫৬,ফ্রেড গিপ্সন
১৯৫৬সালে রচিত ফ্রেড গিপ্সন এর ওল্ড ইয়েলার বইটি যতটা সুন্দর ঠিক ততোটাই দুঃখজনক একটি গল্প।উপন্যাসটি একটি ১৪বছর বয়সী ছেলে ট্রাভিস কোটসকে নিয়ে লিখা। যখন তার বাবা গবাদি পশু চরানোর জন্য বাহিরে যায় ট্রাভিস তখন তার পরিবারের খামার দেখাশোনা করে। একদিন একটি কুকুর তাদের খামারে আসে কিন্তু ট্রাভিস কুকুরটির সাথে কিছুই করলো না। অনেককিছুর পরিবর্তন আসে যখন কুকুরটি ট্রাভিস এর পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের বাঁচায় এবং তাদের মাঝে একটি কোমল-মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠে। একদিন একটি ক্ষিপ্ত এবং জলাতঙ্কগ্রস্ত নেকড়ে তাদের পরিবার আক্রমণ করে।ওল্ড ইয়েলার,কুকুরটি নেকড়েটির সাথে যুদ্ধ করে ট্রাভিস এর পরিবারকে বাঁচায়। কিন্তু কুকুরটি জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয় এবং ট্রাভিস বাধ্য হয় তাকে মেরে ফেলতে।
অতি আদরের ওল্ড ইয়েলারের মৃত্যু সাহিত্যে সবসময় একটি বিষণ্ণতার প্রতীক বহন করে। ১৯৫৭সালে এই বইটির ভিত্তিতে ডিজনি পরিচালিত একটি ছবি নির্মাণ করা হয়। বিবেচনা করা হয় উপন্যাসটি শিশুদের জন্য শ্রেষ্ঠ এবং বেদনাবিধূর একটি গল্প।ওল্ড ইয়েলার নিউবেরী সম্মাননাসহ আরও পুরস্কার অর্জন করে।
৪। দ্যা ভেলভেটিন রাবিট,১৯২২, মারযারি উইলিয়াম
একটি ছোট ছেলেকে বড়দিনের উপহার হিসেবে মখমলের একটি খেলনা খরগোশ দেওয়া হয়।একরকম কল্পিত ধারণা থেকে খেলনা খরগোশটি চায় সে যেন ছেলেটির সবচেয়ে প্রিয় খেলনা হয়। খরগোশটি এমন ইচ্ছা প্রকাশ করে কারণ তাকে অন্য একটি খেলনা বলেছিলো যেই খেলনা তার মালিকের সবচেয়ে পছন্দের হতে পারবে সেই খেলনাটি সত্যি সত্যি জীবন্ত হতে পারে। খরগোশটি ছেলেটির প্রিয় খেলনা হয় কিন্তু একদিন হঠাৎ ছেলেটি এক সংক্রামক জ্বরে আক্রান্ত হয়। যার ফলে চিন্তা করা হয় যে তার সবকিছু পুড়িয়ে ফেলা হবেএবং তখনোই দৈবক্রমে এক পরী এসে খরগোশটিকে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে সেই ছেলেটি একদিন বনে একটি খরগোশ দেখতে পায় যেটি ছিল তার প্রিয় খেলনা খরগোশটির মত দেখতে।
গল্পটি আমাদের একটি বার্তা প্রদান করে দিয়ে যায় যে মৃত্যুর পরও কিছু আশা থেকে যায়।
গল্পের লেখক মারযারি উইলিয়াম দ্যা ভেলভেটিন রাবিট লিখার পূর্বে বড়দের জন্য ভয়ঙ্কর উপন্যাস লিখেছিলেন। দ্যা ভেলভেটিন রাবিট এর মাধ্যমে তিনি উপন্যাস লিখার সফলতা অর্জন করেন। এরই স্বরূপ তিনি তার জীবনের লিখার লক্ষ্য পরিবর্তন করেন এবং একমাত্র শিশুদের উপন্যাসই লিখেন।উইলিয়াম ১৯৪৪ সাল অর্থাৎ তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শিশুদের উপন্যাস লিখেছিলেন।
৫। এ ব্রিজ টু টেরেবিথিয়া ,১৯৭৭, ক্যাথারিন পেটারসন
পুরস্কারপ্রাপ্ত এই শিশুতোষ উপন্যাসটি দুজন এগারো বছর বয়সী জেস এবং লেসলিকে নিয়ে।জেস একটি খামারে চার বোনের সাথে বাস করে। লেসলি অন্য একটি এলাকা থেকে আসে এবং জেস প্রথমে তাকে পছন্দ করে না কিন্তু পরবর্তীতে দেখে যে তাদের দুজনের মনোভাব একইরকম,একই প্রকৃতির।জীবনের প্রতিদিনের বিভিন্ন সমস্যা থেকে একটু মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা নিজেরা বনে একটি কাল্পনিক রাজ্য বানায় যার নাম টেরেবিথিয়া। একদিন জেস লেসলিকে একজন শিক্ষকের সাথে আর্ট গ্যালারিতে যাওয়ার জন্য একটি পরিখা খনন করে দেয় এবং সেই শিক্ষকটি কিনা লেসলিকে পছন্দ করতেন। লেসলি একা একা বনে যায় এবং আকস্মিকভাবে ডুবে যায়।যেকোনো বয়সের জন্যই গল্পটি মর্মান্তিক।
ক্যাথারিন পেটারসনের ছেলের অন্যতম ভালো বন্ধু মারা যাওয়ার পর তিনি এই উপন্যাসটি লিখেছিলেন।এটা খুবই মর্মান্তিক একটি ঘটনা যা,হারানোর বেদনা বোঝানো খুব কঠিন প্রকাশ করে।এমনকি প্রাপ্তবয়স্কদের পক্ষেও কঠিন মৃত্যুর বেদনা মেনে নেওয়া সহজ নয়।
বইটি নিউবেরী মেডাল অর্জন করে এবং ২০০৭ সালে ডিজনি এই উপন্যাসের ভিত্তিতে একটি ছবি নির্মাণ করে এবং এটি প্রায় বইটি প্রকাশের ৩০ বছর পর নির্মাণ করা হয়।
৬। ওয়ার হর্স,১৯৮২ ,মাইকেল মোরপুরগ
ইংরেজ লেখক মাইকেল মোরপুরগ ১২০টির উপর বই লিখেছেন।তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একজন সদস্য এবং ২০০৩সাল-২০০৫সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ বাচ্চাদের গ্রন্থকার হিসেবে মুকুট অর্জন করেন।ওয়ার হর্স তার একটি বিখ্যাত উপন্যাস।
জোয়ি একটি ঘোড়ার নাম যাকে নিয়েই এই ওয়ার হর্স গল্পটি।প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মধ্যবর্তী সময়ে ১৯১৪সালে জোয়িকে সেনাবাহিনীর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।এখানে দুটি মর্মান্তিক গল্প রয়েছে যার প্রথমটি প্রকাশ করে যুদ্ধের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড এবং অপরটি ঘোড়াটি যখন বাড়িতে থাকতো তখন খামারের একটি ছেলের সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে।
২০০৭সালে উপন্যাসটি নিয়ে যখন একটি নাটক প্রদর্শিত হয় তখন এর জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। পরবর্তীতে ২০১১সালে এ উপন্যাসটি নিয়ে একটি ছবি নির্মাণ করা হয়।এর ফলে বইটির বিক্রি আরও বেড়ে যায় এবং এটি সবচেয়ে বেশি বিক্রিত একটি বইয়ে পরিণত হয়।বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে যেমন বইটি পড়ে অথবা ছবি,নাটকটি দেখে শিশু ছাড়া বড়োরাও কান্না করতে বাধ্য হয়েছে।
৭। এ টেস্ট অব ব্লাকবেরি’স,১৯৭৩, ডরিস বুচানান স্মিথ
ডরিস বুচানান স্মিথ এর এ টেস্ট অব ব্লাকবেরি’স আমেরিকান এসোসিয়েশন লাইব্রেরির উল্লেখযোগ্য একটি বই। বইটিতে নামহীন এক ১০ বছর বয়সী তার ভালো বন্ধু জেমির সাথে কালোজাম সংগ্রহ করছিলো। হঠাৎ জেমিকে একটি মৌমাছি কামড় দেয় যার ফলে সে খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়ে কিন্তু জেমির বন্ধু ভাবে সে মজা করছে।তাই সে কোনরকম পাত্তা না দিয়ে জেমিকে নিয়ে গেল ললিপপ নেওয়ার জন্য। স্মিথ এর এই বইটি শিশুদের জন্য ১৯৭৩সালের একটি কালজয়ী বই। এখানে শিশুরা কিভাবে ছোট একটি বিষয় থেকে অপ্রত্যাশিত মৃত্যুমুখে পতিত হয় তাই তুলে ধরা হয়েছে।
লেখিকা সম্পর্কেঃ আমি সাবরিনা আফরিন।পড়াশুনা করছি বিবিএ তে। ভাল লাগে বই পড়তে ও নতুন নতুন তথ্য জানতে ।