মিশন রাতারগুল-বিছানাকান্দি-লাউয়াছড়া-হামহাম ঝর্ণা

শান্তিবাড়ি

এই ফিচারের সব ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা- ফৌজিয়া জান্নাত

মধ্যবিত্ত পরিবারের নানাবিধ সংস্কারমূলক বিধিনিষেধ এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিয়ের আগে মেয়েদের বন্ধু বান্ধব নিয়ে ঘুরতে যাওয়া মানা। তবেঁ আজকাল যুগ পরিবর্তনের সাথে অভিভাবকরাও উদার দৃষ্টিভঙ্গি মেলে ধরছেন। যদি অনার্স মাস্টার্স করা মেয়েকে চাকরি বাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার সাহস যোগাতে পারেন, তবে ছাত্রজীবনের অমৃত আস্বাদন করার অনুমতি প্রদান করাটাও কোনভাবেই অমূলক নয়। তাই যখন একুশ জন মেয়ে সিলেট এর দুর্গমতম অঞ্চলে হাইকিং এ যাবার সিদ্ধান্ত নিল, “একুশ জন মেয়ে একা যাবে! কোন ছেলে নেই!” পড়শি দের এমন কথা বাবা মা রা হেসেই উড়িয়ে দিলেন।

blankসিলেট এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন মনোমুগ্ধকর তেমনি উদাস করে দেয়ার মত খেয়াল জাগানিয়া। অনেক উল্লেখযোগ্য জায়গা আছে যেগুলো পরিপূর্ণ ভাবে ঘুরে আসতে চাইলে হাতে অন্ততপক্ষে চারদিন সময় নিয়ে আপনাকে যেতে হবে। বাস বা ট্রেন উভয়ের যাতায়াত ব্যবস্থা সুবিধাজনক।সিলেটের উদ্দেশ্যে আমরা রওনা দিলাম রাত দশটার উপবন এক্সপ্রেসে, পূর্ণিমার জোৎস্নাকবলিত আলোকচ্ছটার মাঝে ঝমাঝম গতি তুলে ট্রেন ছুটে চলল সিলেট স্টেশন উদ্দেশ্য করে।

blank
রাতারগুল


১ম দিন:

ভোর পাঁচটায় উপবন এক্সপ্রেস থেকে নামলাম আমরা, উল্লেখ্য যে একটি নামকরা ট্রাভেল এজেন্সি আমাদের থাকা খাওয়া এবং দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছিল। গাইডের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা ভাড়া করা একটি বাসে উঠে চলে এলাম আল সালিম লজে, যেখানে হালকা পাতলা একটু রেস্ট নিয়ে, হাত মুখ ধুয়ে আমরা রাতের জার্নির ক্লান্তি ঝেড়ে ফেললাম। লজের হোটেলে ভরপেট নাস্তা করে শুরু হল রাতারগুল অভিমুখে অভিযান। তবেঁ রাস্তায় খানিক থেমে হযরত শাহজালাল (রা:) এর মাজারে পুকুরের বিখ্যাত গজার মাছ ও পায়রার ঝাঁক দেখে নিলাম। রাতারগুলের রাস্তা তেমন ভালো না হলেও দেখলাম সংস্কারাধীন। আমরা কাঁচাপাকা রাস্তায় ঝাঁকুনি খেতে খেতেই বহু দূর এলাম। বাস সরু মত একটি রাস্তায় এসে থামল। চারদিকে ধানিজমি। গাইড বলল, মিনিট বিশেক হাটতে হবে। আইসক্রিম এর ফেনার মত খণ্ড খণ্ড মেঘ সমস্ত দক্ষিণের আকাশ উচ্ছ্বল করে রেখেছে। হেটে আমরা গোয়াইন নদীর ধারে পৌঁছলাম। নৌকা ভাড়া করা হল মোটে পাঁচটা। ভেসে চলল স্বপ্নতরী জলাবনের ধার ঘেঁষে। নীরব নিস্তব্ধ বনের সাথে মাঝির বৈঠার ছলাৎছলাৎ আর ভাওয়াইয়া গানে প্রাণ অজানা আনন্দে মুখরিত হয়ে উঠল। বেশ উঁচু, প্রায় আটতলা সমান ওয়াচটাওয়ারের উপর থেকে আপনি পুরো রাতারগুলের চারপাশে অনেকদূর দেখতে পাবেন। আছে ভাসমান চা বিস্কিট এর দোকান। চাইলে নৌকায় মাঝির গান শুনতে শুনতে চা ও খেয়ে নিতে পারেন। প্রায় দেড় ঘন্টা রাতারগুল পরিভ্রমণ শেষে ফের বাসে উঠে যাত্রা করলাম আমরা। এবার বিছানাকান্দির উদ্দেশ্যে।

blankপ্রায় এক ঘন্টা যাবত পাহাড়ের কাছাকাছি কেবল এগিয়েই যাচ্ছি। হৈ হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে দূরে পাহাড়ের ফাঁকেফাঁকে হুটহাট বয়ে চলা চিকন সুতোর ন্যায় ঝর্ণার দেখা মিলে। সব গুলোই ভারতের সীমানার মধ্যে অবশ্য। আমরা খুশিমনে একে অপরকে ঝর্ণা দেখানোর জন্য চেঁচিয়ে বাস মাথায় তুলে ফেললাম। এমনিতেও স্থির হয়ে বসে থাকার জো ছিল না, কারণ রাস্তার ঝাঁকুনি রোলার কোস্টারকেও হার মানিয়ে দিচ্ছিলো। অবশেষে হাড়গোড় ভেঙে পড়ার আগেই বাস হাদারপাড় বাজারের নিকট থামল। খানিক জিরিয়ে আমরা বাজারের হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম। ক্ষুধা পেটে ভাজি, ভর্তা, ডাল মনে হল অমৃত। মুরগী অনেকে ছুঁয়ে ও দেখল না। ইঞ্জিনচালিত লঞ্চের পিঠে উঠে এবার পিয়াইন নদীর বুক চিড়ে ছুটে যাওয়া। একুশ জনের দলে ঊনিশ জনের সাঁতার সম্বন্ধীয় ‘স’ ধারণা না থাকলেও সে সবের তোয়াক্কা না করে লঞ্চের কিনারায় পা ঝুলিয়ে সকলেই বসে পড়লাম। ঠাণ্ডা পানি যখন পা ছুঁয়ে কেটে যাচ্ছিল, হাস্যকর হলেও সত্যি বলতে নিজেকে সিনেমার নায়িকার চাইতে কিছু কম মনে হয়নি। পাহাড়ের মায়াভরা কোল ঘেঁষে বিছানাকান্দি। পাথর, পাহাড় আর পানি দেখে ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়ল সকলে। ঝর্ণার স্রোত কিছুমাত্র কম ছিল না বরং কোমর সমান পানিতেও দাঁড়িয়ে থাকা দুষ্কর মনে হচ্ছিল। আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত সে অপরুপ সৌন্দর্য ভোগ করে রওনা দিলাম শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে। রাত একটায় বাস পৌঁছল শ্রীমঙ্গল। কুটুমবাড়িতে রাতের ভোজ সেরে লাউয়াছড়া রেইন ফরেস্ট এর থেকে খানিক যেতেই আমাদের রিসোর্ট শান্তিবাড়ি, যেখানে নামের সাথে জায়গাটার যথার্থ মেলবন্ধন রয়েছে।

২য় দিন

শান্তিবাড়ি তে আরাম করে সকালের নাস্তা সেরে সামনের পুকুরটার দিকে আমরা লোভাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। যেহেতু অধিকাংশ মেয়েই সাঁতার পারি না চেয়ে থাকা ছাড়া কিছু করবার ছিল না। হুট করেই একজন সাঁতারু পুকুরে নেমে গেল। মাঝপুকুরে গিয়ে গলা উঁচিয়ে তখন ডাকল সবাইকে। রিসোর্টের বাবুর্চি মামা তখন জানালেন, পুকুরে পানি এমনভাবেই রাখা হয়েছে যাতে যারা সাঁতার জানে না তারাও পুকুরে নামার আনন্দ লাভ করতে পারে। আর কি! বাস! ঝপাং করে সকলে লাফ দিয়ে পুকুরের পানিতে।প্রায় দু ঘন্টা ইচ্ছামত ডুবাডুবির পর্যায় শেষ হলে আমরা রওনা দিলান লাউয়াছড়ার রেইন ফরেস্ট দেখতে। জন্তুজানোয়ার এর দেখা তেমন না মিললেও বাহারি পদের গাছগাছালির সাথে পরিচয় ঘটল। তবেঁ সিলেট এ লালমুখো বানর আছে প্রচুর। প্রায় প্রতিটি সাইটেই এঁদের দেখা মিলে। লাউয়াছড়া থেকে খোলা জিপে চড়ে মাধবপুর চা বাগান সবটা ঘুরে দেখে নিলাম। সন্ধ্যা নামার মুখে নীলকন্ঠে সাত রঙ এর চা খেয়ে মণিপুরি পাড়ায় কিছু কেনাকাটা পর্ব সারা হল। এরপর আকর্ষণ ছিল শান্তিবাড়ির বারবিকিউ। সকলে একবাক্যে স্বীকার করল এমন বারবিকিউ আগে কখনোই কেউ চেখে দেখে নি। আনারসের বারবিকিউ ছিল শো স্টপার। এমনকি আমি আনারস খুবই অপছন্দ করলেও সেদিন মনে হচ্ছিল, এই জিনিস এক প্লেট অনায়াসে খেতে পারবো।

পরদিন বড় রকমের অভিযানের প্রস্তুতি নিতে সেদিনকার মত শান্তিবাড়িতে সবাই শান্তিমত ঘুমিয়ে নিলাম।

৩য় দিন:

 

blank
হামহাম ঝর্ণা

সকাল ৭টার মধ্যে সকলেই তৈরী। ব্যাকপ্যাক এ পানি, লবণ, ডেটল, গ্লুকোজ ভুরি ভুরি নেয়া হল। নাস্তা সার্ভ করতে একটু দেরী হওয়ায় বের হতে একটু বেলা হয়ে গেল। তারপরও হামহাম এর পাহাড় বেয়ে উঠা শুরু করলাম বেলা এগারোটায়। হাইকিং অভিজ্ঞতা দলে অধিকাংশেরই প্রথম। চড়াই উৎরাই এ বেশ ক্লান্তি চলে আসে তবেঁ আপনি ছোটবেলা থেকে দুরন্তপনায় অভ্যস্ত থাকলে তেমন কোন কষ্টই হবে না। শারীরিক পরিশ্রমে একদম অনভ্যস্ত থাকলে আমার মত দশ পনের বার আছাড় ও খাবেন, তবে ওই জায়গাটায় মনের জোরটাই আসল। হামহাম আতংকের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে জোঁকের ভয়। মজার বিষয় হচ্ছে যাওয়ার পথে দলের এক জনকেও জোঁক পায়নি। দু ঘন্টার মত সময় নিয়ে আমরা ঝর্ণার কাছে পৌঁছলাম, যা দেখে ক্লান্তি সব ধুয়েমুছে গেল।

 

blank
মাধবপুর লেক

অমন ভয়ংকর সুন্দর আপনাকে যেমন টানবে ঠিক তেমনই বেদম অস্থির যান্ত্রিক মনটাকে সুস্থির ও একই সাথে ব্যথাতুর করে তুলবে। ফিরে আসার পথে অবশ্য জোঁকে ধরল তিন চারজনকে। আমি সেই দুর্ভাগা দের একজন ছিলাম বটে তবেঁ ভয়ের চাইতে বেশি ওই ক্ষুদে প্রাণীগুলোকে দেখে আশ্চর্যান্বিত হতে হয়েছে। আমার বান্ধুবী শখ করে বোতলে দুটো জোঁক ধরে নিয়ে এল। হামহাম অভিযানে প্রেরণা পেয়েছি গাইডদের উৎসাহ যোগানো তে। বিশেষ করে তাইজুল মামা, যিনি কিনা পনেরো বছর আগে প্রথম হামহাম এর ঝর্ণার আবিষ্কার করেন, ছিলেন আমাদেরই দলে। রাতে আমরা সবাই তাইজুল মামার অতিথি হয়েই খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম। শান্তিবাড়ি পৌঁছে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে এবার ঢাকায় ফেরার পালা।

আমাদের বাস ছিল রাত এগারোটায়, ভোর সাড়ে চারটায় ঢাকায় প্রবেশ করে বাস নামিয়ে দিয়ে গেল আমাদের। ঘুমন্ত নগরী তখন কেবল জেগে উঠছে। এডভেঞ্চার এর নেশা রক্তে মিশে গিয়ে আমরা তরুণেরা তখন সদা জাগ্রত!