প্রকৃতি আমাদের অনুপ্রাণিত করে। এই প্রকৃতিতে ছড়িয়ে রয়েছে অনাবিল দৃশ্যাবলী যা মানুষের মনকে করো তোলে আন্দোলিত । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মানুষ নিজেকে বেষ্টিত করে রাখতে খুবই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে । বসন্ত যখন আপনার দুয়ারে কড়া নাড়ে, তখন সবাই তাদের পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে গ্রীষ্ম থাবা দেয়ার আগেই ছুটি কাটাতে বের হয়ে পড়ে। করে নানা পরিকল্পনা । কেউ চায় সমুদ্র ভ্রমণে , কেউ বা পাহাড় , কারো বা সমতলে ভ্রমণ করতে পছন্দ । যেখানে যাই না কেন সবুজ বিস্তৃত মাঠে, এদিক-সেদিক ফুটে থাকা নানারঙের ফুল এবং তার উপর খেলা করা ভ্রমর যে কারো মনকেই নাড়া দিতে বাধ্য । আসুন দেখে এমনি ১০টি সুন্দর উপত্যকা যা না দেখলে আপনার জীবনে থেকে যাবে অপূর্ণতা ।
১। ল্যুটারব্রুনেন, সুইজারল্যান্ড
এই উপত্যকা সুইস আল্পসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ । পাথুড়ে পাহাড় এবং ৭০ টি ছোট – বড় বিচিত্র জলপ্রপাত এই ভ্যালির চতুর্দিক জুড়ে রয়েছে । এছাড়া নির্জন উত্যকা, রঙিন আলপাইন তৃণভূমি এবং পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত পান্থশালা আপনার চিত্তকে করবে আলোড়িত । আপনি খুব সহজে গাড়ী ভাড়া করে সুইজারল্যান্ডের এই মনোরম দৃশ্যাবলী সমৃদ্ধ উপত্যকাটি ঘুরে আসতে পারেন কোন রকম বিপদ ছাড়াই ।
২। নুব্রা ভ্যালি, ভারত
নুব্রা ভ্যালি লাদাখ উপত্যকার উত্তর পূর্বদিকে অবস্থিত । এটি সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১০,০০০ ফুট উপরে অবস্থিত । লেহ শহর থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই ভ্যালির পাশ দিয়ে নুবরা এবং সায়ক নদী বয়ে চলেছে । গ্রীষ্মকালে উপত্যকায় সবুজের সমারোহ থাকে । শীতের সময় এই স্থানটি বরফে ঢাকা পড়ে। এই স্থানটিকে চাঁদের এলাকা বলেও অবহিত করা হয় । লোমশ জোড়া কুঁজ বিশিষ্ট উট এবং বৌদ্ধদের প্রাচীন কিছু মনস্ট্রি এই উপত্যকার মূল আকর্ষণ। মে-আগস্ট মাসে এখানে ভ্রমণের উৎকৃষ্ট সময় । এসময়ের আবহাওয়া থাকে অতি মনোরম । অন্য সময়টায় এলাকাটি বেশ ঠান্ডা থাকে । হয় প্রচুর তুষারপাত । এই ভ্যালিতে যাতায়াতের জন্য খারগাও লাপাস সড়ক সারা বছরই উন্মুক্ত থাকে । তবে এই এলাকায় যাওয়ার ব্যাপারে কিছু বিধি-নিষেধ আছে । বিদেশী পর্যটকদের জন্য এই উপত্যকা ভ্রমণের বিশেষ অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয় ।
৩। হাআ ভ্যালি, ভুটান
’হাআ’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল ”লুক্কায়িত”। এই উপত্যকা কে বিশ্বের সবচেয়ে লুক্কায়িত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হিসেবে অভিহিত করা হয় । এশিয়ার কমনীয় উপত্যকাগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা । এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখা আপনার জীবনের সবচেয়ে উপভোগ্য দৃশ্য হবে নিঃসন্দেহে । এখানে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের অসংখ্য মঠ যা দেখার জন্য প্রতিবছর প্রচুর দর্শনার্থীর ভিড় হয়। গ্রীষ্মে এ অঞ্চলে নানাধরণের উৎসব হয় । ভ্রমণকারীরা এ উৎসবে যোগ দিয়ে অশ্ব চালনা , ধনুর্বিদ্যা এবং ঐ অঞ্চলের ঐতিহ্যগত বিভিন্ন ধরনের খেলা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে পারে ।
৪। রোমস্ডল ভ্যালি, নরওয়ে :
১৫০০ মিটার উচ্চ, ৬০ কিলোমিটার বিস্তৃত রোমস্ডাল ভ্যালি নরওয়ের একটি বিখ্যাত উপত্যকা । দুপাশের সৌম্য উচ্চ পর্বতমালাদ্বারা উপত্যকাটি পরিবেষ্টিত। ভ্যালির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা রৌমা (Rauma) নদী । এখানই রয়েছে ট্রলভেগান (Trollveggen) পর্বতশৃঙ্গ যা ইউরোপের সবচেয়ে খাড়া পর্বত (দৈর্ঘ্য-১,৫৫৫ মিটার)। এটি পর্বতারোহী এবং বেস জাম্পিংয়ের জন্য একটি খুবই জনপ্রিয় স্থান । এই উপত্যকার মধ্য দিয়ে একটি শান্ত ও সুন্দর নদী বয়ে চলছে যা আপনার মনে প্রশান্তি নিয়ে আসবে নিঃসন্দেহে । ভ্যালির চারপাশের অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী, সুন্দর ক্রসিং রোড এবং উত্তরাঞ্চলের গ্র্যান্টার ভ্যালিতে অবস্থিত গ্র্যান্ট সেতু ভ্রমণকারীদের বিমোহিত করে রাখে ।
৫। সিম্পলন ভ্যালি, ইতালি
এই উপত্যকাটি আল্পসের দক্ষিণে অবস্থিত। এই উপত্যকাটি রাজনৈতিকভাবে ইতালি এবং সুইজারল্যান্ডের মধ্যে বিভক্ত । ভ্যালির পশ্চিমাঞ্চল সুইজারল্যান্ডের এবং ভ্যালির পূর্বাঞ্চলের পাদদেশ ইতালির অধীনে । উপত্যকার সর্বোচ্চ পর্বত ’ওয়েসমি’ ৪,০১৭ মিটার, ‘লেগিনহর্ন ’ ৪,০১০ মিটার, ‘ফেটসুকর্ন’ ৩,৯৯৩ মিটার যা পেন্নি আল্পসের সাথে যুক্ত। অপর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মন্টে ‘লিওন’ (৩,৫৫৩ মিটার) লিপনটাই্ন আল্পসের সাথে যুক্ত । ভ্যালিটি ভ্রমণকারীদের জন্য সারা বছর উন্মুক্ত থাকলেও শীতকাল বরফ পড়ে এবং অঞ্চলটি খুব ঠান্ডা থাকে । এই সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায়ই বন্ধ থাকে ।
৬। ভ্যালি অব টেন পিক, কানাডা
কানাডার বেন্ফ ন্যাশনাল পার্ক ঘিরে অবস্থিত এই উপত্যকা বিশ্বের মনোরম ভ্যালিগুলোর একটি যার চতুর্দিক বয়ে চলছে জনপ্রিয় মোরাই্ন লেক । ১০টি পৃথক শৃঙ্গ নিয়ে এই উপত্যকাটি গঠিত । প্রথম দিকে শৃঙ্গগুলোকে ১ থেকে ১০ এভাবে নামাঙ্কিত করা হয়েছিল । কিন্তু সম্প্রতি ৩টি শৃঙ্গকে বিশ্বের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে । মোরাই্ন লেক অনুসরণ করে আপনি সহজেই এই ভ্যালিতে পৌঁছে যেতে পারেন । গ্রীষ্মের শুরুতে এবং শীতের শেষে এখানে ভ্রমণের প্রকৃত সময়। এই সময়টায় ভ্যালির চারপাশে বান্ধবীর সাথে হেঁটে ঘুরে বেড়ানো, মেরিন লেকে নৌবিহার, ইচ্ছেমত ফোটোগ্রাফী এবং পর্বতারোহণ করতে পারেন ।
৭। হারাউ ভ্যালি, ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম সুমাত্রা অঞ্চলে এই উপত্যকাটি অবস্থিত । হারাউ ভ্যালি অতুলনীয় প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর জন্য প্রসিদ্ধ । ভ্যালিটি সারাশাহ বানতা এবং আকা বারুউইন নামক দুইটি অঞ্চলে বিভক্ত । সারাশাহ বানতা অঞ্চলে ৫টি জলপ্রপাত এবং আঁকা বারুউইন অঞ্চলে ১টি জলপ্রপাত রয়েছে। হারাউ উপত্যকায়ও একটি জলপ্রপাত রয়েছে যেখানে ২০ ফুট উচ্চতা থেকে ঠান্ডা পানি স্রোত বহমান । এই উপত্যকা জুড়ে রয়েছে বিস্তৃত ধানক্ষেত, ছোট-বড় গাছপালায় ঢাকা ঘন পাথুরে বন এবং এদিক সেদিক ছড়িয়ে রয়েছে
চোখ ধাঁধানো পর্বতের সারি । কিছু ভ্রমণকারীর দাবী যে, হারাউ উপত্যকার সৌন্দর্য যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যানাড ক্যানিয়ন এর চেয়ে কোন অংশে কম নয়। কাজেই এই উপত্যকা পরিদর্শনে এলে এসব প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনার মনকে বিমোহিত না করে পারবে না ।
৮। লটসচেনটাল, সুইজারল্যান্ড
এই বিস্ময়কর ভ্যালি শুধু বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর উপত্যকাই নয় বরং সুইজারল্যান্ডের বৃহত্তম উপত্যকা । ইউনেস্কো হতে এই উপত্যকা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্থান হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে । ভ্রমণকারীদের জন্য এই উপত্যকাই কোন বিধি নিষেধ নেই । একজন ভ্রমণকারী ইচ্ছেমত এই উপত্যকা পরিভ্রমণ করতে পারেন । উপত্যকাটি ২৭ কিলোমিটার বিস্তৃত এবং ৩০০ মিটার উচু। উপত্যকা ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন আকৃতির পর্বতমালা যা ছবির মত সাজানো। বন্য লন্জা নদী এই ভ্যালির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে । এই অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত সম্পূর্ণ উপত্যকাটি বরফে আবৃত। ভ্রমনকারীদের জন্য এক অনন্য সাধারণ অভিজ্ঞতা ।
৯। কালাল্উ ভ্যালি, হাওয়াই
এই সুন্দর উপত্যকা কাউয়াই দ্বীপে অবস্থিত । উপত্যকাটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত । ৬১০ মিটার খাড়া পর্বত দ্বারা উপত্যকাটি বেষ্টিত। এর পাদদেশ অপেক্ষাকৃত সমতল যা ৩.২ কি.মি. বিস্তৃত । এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং সূর্যালোক থাকায় অঞ্চলটি উদ্ভিদ ও প্রাণীদের অভয়ারণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে । এখানেই রয়েছে জনপ্রিয় কালাল্উ বীচ । কালাল্উ বীচের অপরূপ সৌন্দর্য অনেক ভ্রমনকারীদেরই আকৃষ্ট করে । আপনি যদি কখনও এই উপত্যকা ভ্রমণে আসেন তবে কোন যানবাহনের উপর নির্ভর না করে ট্রেকিংয়েই আপনার প্রধান অবলম্বন হওয়া উচিত। তাহলে একসাথে সবুজ বিস্তুত উপত্যকা এবং ট্রেকিং দুটোরই মজা আপনি উপভোগ করতে পারবেন ।
১০। বরুণ ভ্যালি, নেপাল
বরুণ ভ্যালি হিমালয় রেঞ্জের একটি আংশ। এটি মাউন্ট মাকাউলু পাদদেশে অবস্থিত । এখানেই নেপালের বরুণ ন্যাশনাল পার্ক এই সমগ্র উপত্যকা জুড়ে বিস্তৃত । এছাড়াও এ উপত্যকায় রয়েছে নেপালের উচ্চতম জলপ্রপাত, গভীরতম গিরিখাত এবং ঘন সবুজ পরিবেশ। নেপালের এই উপত্যকায় গড়ে উঠেছে সংরক্ষিত ইকো সিস্টেম যেখানের পৃথিবীর বেশ কিছু বিরল উদ্ভিদ ও প্রাণীর শেষ আবাসস্থল । এই ভ্যালি ভ্রমণ করে আপনি নিজেকে এবং আপনার পরিবারকে অনাবিল আনন্দ দিতে পারেন ।
ভ্রমণপিপাসুরা জেনে নিলেন বিশ্বের শীর্ষ সুন্দর ১০ উপত্যকা । কাজেই আর দেরি কেন? এখনই টিকিটের জন্য বুকিং দেন । ঘুরে আসুন এবং উপভোগ করুন প্রকৃতির নিজের হাতে সাজিয়ে রাখা সেসব দৃশ্যবিলী যা আপনার হৃদয়কে আনন্দময় করে তুলবে ।
লেখিকা সম্পর্কেঃ পাপিয়া দেবী অশ্রু। শখ -বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেড়ানো, গান করা, ছবি আঁকা। লেখা – লিখিতে বেশ আগ্রহ থাকলেও তেমন ঘটা করে হয়ে উঠেনি কখনও। শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত আছি। ইচ্ছে আছে একেবারেই নতুন কিছু করার, যা বিশ্বজুড়ে সবার দেখার মতই। অদ্ভুত ইচ্ছে!!!