অশ্রুসিক্ত ভালোবাসা, কথার জাদুকরকে!

হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮-২০১২)

জীবন সম্পর্কে উদাসীন মানুষকে যদি জীবনের সুধা পান করাতে হয়, তবে হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের বিকল্প নেই। তাঁর বই পড়লে নিতান্ত উদাসীন মানুষটারও হঠাৎ করে জীবনের মানে খুঁজতে ইচ্ছে হবে। কিছু না বলা কথা বলতে ইচ্ছে হবে।

“কেউ যখন কষ্টে থাকে তখন প্রশ্ন করে কষ্টের ব্যাপারটা জানতে নেই। সময়ের সাথে সাথে কষ্টের ওপর প্রলেপ পড়ে। তখন জিজ্ঞেস করা যায়। প্রলেপ পড়ার আগেই কষ্টের ব্যাপার জানতে চাইলে কষ্টটা অসহনীয় হয়ে ওঠে।”– লাইনগুলো হুমায়ূন স্যারের এপিটাফ উপন্যাস থেকে নেওয়া। কেমন অদ্ভুতভাবে মিলে গেল! যখন আমার মন খারাপ থাকে, তখন যদি কেউ বারবার জিজ্ঞেস করে, কেন মন খারাপ, তখন সত্যিই মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। মন খারাপের সময় একা থাকতেই ভাল লাগে। হুমায়ূন স্যার কী করে সমস্ত বাঙ্গালীর মনস্তত্ত্ব জেনে নিয়েছিলেন, খুব জানতে ইচ্ছে হয়।

আগে কোন বিষয়ে, কিছু অজানাকে জানতে ইচ্ছে করলে ভাবতাম, এটা করলে ওটা হবে না তো? অমুক কী বলবে? তমুক কোন চোখে তাকাবে? এখন আর ওরকমটা ভাবি না। এসব ছাঁইপাশ ভাবলে তো বিষয়টা আজীবন অজানাই থেকে যাবে! একইরকমভাবে কিছু পাগলামিকে প্রশ্রয় দিতে, বৃষ্টি-জোছনাকে উপভোগ করতে তো হুমায়ূন স্যারই শিখিয়ে গিয়েছেন তাঁর মোহনিয়া লেখার জাদু দিয়ে। এসবের জন্য তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব আজীবন।

তাঁর একেকটা লেখা, একেকটা গল্প জীবন সম্পর্কদ কী গভীর ধারণা দেয়! অনুভূতিগুলোকে জাগিয়ে তোলে। বই থেকে সিনেমা বানানো হলে, বাই চান্স যদি সিনেমা আগে দেখে ফেলি, তাহলে আর বই পড়ি না। এটা ভেবে পড়ি না যে কাহিনি তো জানিই! কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের ক্ষেত্রে এই লজিক খাটে না। উনার একটা বই না পড়া মানে, অনেক বড় কিছু মিস করে ফেলা। আগুনের পরশমণি সিনেমাটা দেখেছি অনেক আগেই। বইটাও যখন পড়া হলো, তখন কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করলো। নিশ্ছিদ্র শূন্যতা যেন ঘিরে ধরলো। ছোট ছোট ব্যাপারগুলো, বিশেষ করে অনুভূতির বর্ণনাগুলি বইয়ে যেভাবে লেখা হয়েছে, সেটা সিনেমায় আসে না। একেকটা জায়গা পড়ে অজান্তে ফুঁপিয়ে উঠেছি। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে।

blankঅভিব্যক্তির পরিপূর্ণ প্রকাশ লোকে চাক্ষুষ করে টিভিতে। আমি দেখি হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে। নাটক মুভির অভিব্যক্তি আমাকে ছোঁয় না। কিন্তু স্যারের বইয়ের অভিব্যক্তি আমাকে ছোঁয়। শুধু ছোঁয় বললে ভয়াবহ ভুল হবে। প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়ে যায়। একেকটা বই পড়া শেষ করে থম মেরে বসে থাকতে হয়। এতো হাহাকার, এতো শূন্যতা!

অল্প কিছু বই ছাড়া আমি হুমায়ূন স্যারের সব বই পড়েছি। কিছু কিছু বই একাধিকবার করেও পড়েছি। একাধিক বললে ঠিকভাবে প্রকাশ করা হবে না। বৃষ্টি বিলাস বইটা পড়েছিলাম উনিশবার! তোমাদের এই নগরে পড়েছি চৌদ্দবার! এরকম বহু বই আছে, যেগুলো পড়ার সংখ্যাটা দুই অংকের ঘর ছুঁয়েছে। প্রতিবারই বইগুলো নতুন মনে হয়। যতোই পড়ি, পুরোনো হয় না।

অনেকেই বলে কিছু মাস্টারপিস ছাড়া স্যারের বেশিরভাগ বইয়ের কাহিনি একই প্লটে, একই প্রেক্ষাপটে, একই গতিতে এগিয়ে গিয়েছে। ফলে বইগুলি পড়ার সময় একটা মোহ, ঘোর, ভালোলাগা কাজ করলেও, পড়া শেষ করার পর তা নাকি বিশেষত্বহীন লাগে। তখন আর উল্লেখ করার মতো তেমন কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেকেই সস্তা বাজারি লেখক তকমা দিয়ে ফেলেছে তাঁকে। হুমায়ূন আহমেদের মতো লেখক নাকি রাস্তায় রাস্তায় পাওয়া যায়। এরা কোন উচ্চমার্গের লেখা পড়ে বেড়ায়, আমার জানা নেই। এদের কে বোঝাতে যাবে, সত্তুরের দশক থেকে এই পর্যন্ত এখনো বাংলাদেশের মানুষদের মোহগ্রস্ত করে রেখেছেন তিনি একাই। সেই মোহজাল থেকে মুক্তি চায় না কেউই। আমি নিজেও তাদের একজন।

আজ স্যারের সত্তরতম জন্মদিনে এসে আবারো একবার পুরোনো সেই কষ্টটা খুব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আল্লাহ স্যারকে কেন এত জলদি নিয়ে গেলেন? মানুষটা এতো কম হায়াত নিয়ে এসেছিলেন! আক্ষেপটা যেন কখনোই ঘোচবার নয়। যেমনটা ঘোচবার নয় তাঁর সাথে একবার দেখা না হওয়ার আক্ষেপ।

হুমায়ূন আহমেদের সেরা উপন্যাসের মধ্যে প্রথম দিকেই থাকবে, কবি। এই কবি-রই একটা উদ্ধৃতি- “একজন মানুষকে সত্যিকারভাবে জানার উপায় হচ্ছে, তার স্বপ্নটা জানা…”

blankস্যারের বেশিরভাগ উক্তি এতো বেশি অমোঘ সত্যতা ধারণ করে, বলার মতো না। সত্যিই তো! স্বপ্ন জানলেই তো একজন মানুষ সম্পর্কে অনায়াসে জানা যায়।

জনা তিনেক কবি, তাদের জীবনযাপন আর তাদের আশেপাশের মানুষদের নিয়ে উপন্যাস কবি। একজন আতাহার, আটপৌরে জীবন যাপন তার। চাকরির খোঁজে হন্যে হয়ে ঘোরা বেকার যুবক। ভালো কবিতা লিখলেও তার কবিতা কখনো পত্রিকায় ছাপা হয় না। বড়লোক বন্ধু সাজ্জাদের বোন তাকে খুব করে ভালোবাসলেও বলার সাহস পায় না। বরং তার সামনে মেয়েটা সেজেগুজে এলেও উল্টাপাল্টা কথা বলে মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলে মনের অজান্তেই।

একজন সাজ্জাদ। বড়লোক বাপের ছেলে, গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ হয়ে যাওয়ার পর যেখানে অনায়াসে খুব ভালো চাকরি করে স্বনির্ভর হতে পারে, সেখানে সেও পড়ে থাকে কবিতা নিয়ে। নিজে তো কবিতা লেখেই, বিখ্যাত সব কবিতা ভাষান্তর ও করে। প্রকাশকের সাথে তার মুখে মুখে খুব দহরমমহরম হলেও ভিতরে টিপিক্যাল প্রকাশকের মতোই। সাজ্জাদ ভালোবাসে এমন এক রহস্যময় মেয়েকে, যে জীবিকার তাড়নায় অসম্ভব এক কাজ করে বেড়ায়।

অন্যজন মজিদ। খাতার পর খাতা ভর্তি করে লেখা কবিতার কবি হুট করে সব ছেড়েছুঁড়ে মফস্বলে চলে যায় কলেজে চাকরি পেয়ে। লেখার খাতা যেন শিকেয় তোলে। মজিদের দুই বন্ধু আতাহার আর সাজ্জাদ তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেও, সে ফেরে না। কারণ সে সেই অখ্যত মফস্বলে অন্য এক কবিতা পেয়ে গেছে। 

আরোও কিছু টুকরো টুকরো গল্পের সমন্বয়ে উপন্যাস – কবি। উপন্যাসের শুরুটা খুবই বিরক্তিকর লেগেছে আমার কাছে। মনে মনে ভাবছিলাম, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস আবার বিরক্তিকরও হয়! বিরক্তি লাগার কারণ হলো কবিতা। কবিকে নিয়ে লেখা উপন্যাসে কবিতা থাকবে, সেটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু আমার যে কবিতা পছন্দ নয়!

একজন সাহিত্যপ্রেমী হিসেবে এটা যে খুব ভয়াবহ অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, সেটা আমি জানি। কিন্তু তবুও আমার যে কিছু করার নাই। পাঠ্যবইয়ের কবিতা ছাড়া আমি হাতে গোনা কিছু কবিতা পড়েছি। তাও হয়ত ঠেকায় বেঠেকায় পড়ে। ছোটবেলায় বান্ধবীকে দেখতাম, কোথাও সুন্দর কিছু পঙক্তি দেখলেই ডায়েরীর পাতায়, টেবিলের কাঠে, এখানে সেখানে লিখে রাখত। ওর অতি আগ্রহ কপি করার জন্য আমিও চেষ্টা করতাম কবিতা পড়তে। কবিতাকে ভালোবাসতে। হয়নি কখনো।

কবি উপন্যাসটা পড়ছিলাম কবিতাগুলি এড়িয়ে। “কবি” উপন্যাসের কবিতাগুলো খুব খটমটে! কিন্তু বোনের বিয়েতে জাগতিক বস্তুগত কিছুই দিতে না পারা আতাহারের বাড়িয়ে দেওয়া চিরকুটের কবিতাটা আমি এড়িয়ে যেতে পারিনি। ওটা পড়ে মিলির মতোই কেঁদে ফেলেছি। দুপুরে এক বন্ধু জিজ্ঞেস করছিল, হুমায়ূন আহমেদের কোন লেখা পড়ে আমি কেঁদেছি? ওকে বলা হয়নি, স্যারের প্রায় সবগুলি বই পড়ার কোন না কোন সময়ে আমার চোখে জল এসেছে। সেই অশ্রু কখনো চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েনি, চোখেই মরে গেছে।

blankহুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে যতো ফোঁটা অশ্রুকণা ঝরেছে, জন্মদিনে তার সবগুলো অশ্রুকণার শুভেচ্ছা জানাই। শুভ জন্মদিন কথার জাদুকর।

 

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ জ্যাজি জাবের, ফরহাদ আহমদ নিলয় ও সানজিদা আলম ইভা।