বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঐতিহাসিক স্থান যা কিনা শত শত বছর কিছু আবার হাজার বছরের পুরনো।এই সকল ঐতিহাসিক স্থানগুলো বিভিন্ন ধরনের নগরায়ন, দূষণ ও দুর্যোগের পরও আজ অব্দি টিকে থাকলেও বর্তমানে আর নিরাপদ নয়। ক্রমেই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখানে আমরা ৭ টি স্থানের কথা বলব যা কিনা অদূর ভবিষ্যতে হারিয়ে যেতে পারে।
১। চিয়ারসন্সিস প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
চিয়ারসন্সিস একটি গ্রীক উপনিবেশ। এটি সেভাস্তাপোল শহরের উপকণ্ঠে ক্রিমিয়ান উপদ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত। চিয়ারসন্সিস একটি গ্রীক শব্দ থেকে উদ্ভুত যার অর্থ ‘উপদ্বীপ’। এটি আধুনিক ইউক্রেনে অবস্থিত। চিয়ারসন্সিস ৩০০-২০০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একসময় এখানে স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পর এটি তার স্বাধীনতা হারায়। ৫ম শতাব্দীতে খ্রিস্টধর্মের প্রভাবে এখানকার মন্দির ও গ্রীক ভবনগুলো ধ্বংস হতে থাকে। তখনকার সমাজ এগুলো রক্ষা করতে পারেনি। ১৮০০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রিমিয়া দখলের পর এই স্থানটি রাশিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিকরা আবিস্কার করে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের জন্য এই স্থান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি কঠোরভাবে সুরক্ষিত ও পুনর্নির্মিত।কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রাকৃতিক ও মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড দ্বারা ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উপকূলীয় ভাঙ্গন,দূষণ এবং শহুরে অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপের কারণে এটি প্রতিনিয়ত ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
২। হিশামের প্রাসাদ
হিশামের প্রাসাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এটি ইসলামী নিদর্শন বহন করে। এই প্রাসাদ ৭৪৭ খৃষ্টাব্দে এক ভূমিকম্পে বালির নিচে চাপা পড়ে যায়।১৯৩৪ সালে ফিলিস্তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক ডিসি বারামকি প্রথম খণন শুরু করেন। বারামকির এক সহকর্মী রবাট ডব্লিউ হ্যামিলটন গবেষণা করে প্রমাণ করেন এই প্রাসাদ ৮ম শতকে নির্মিত হয়। অনেকে বলেন খলিফা হিশাম বিন আবদেল এর প্রাসাদ এটি। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রমাণ হয় এই প্রাসাদ তার ভাগ্নে দ্বিতীয় ওয়ালিদের সময় নির্মাণ করা হয়। পরে এটি ভুমিকম্পে হারিয়ে যায়। এটি নির্মাণের সময়ই অসম্পূর্ণ ছিল। বর্তমানে একটি সুপরিচিত পর্যটকদের আকর্ষণ ও সাংস্কৃতিক উৎসবের জন্য।তবে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন এটি এখনও সুরক্ষিত নয় তাই হারিয়ে যেতে পারে। তাদের ধারণা ১০০ বছর পর এর অস্তিত্ব নাও থাকতে পারে।
৩। কেনিয়ার প্রাচীন শহর লামু
২০০১ সাল থেকে কেনিয়ায় অবস্থিত লামু শহরটি পৃথিবীর অন্যতম একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে যদিও এর পরিচিতি প্রায় ১৪শতাব্দী থেকে। আফ্রিকার পূর্ব উপকূল সোয়াহিলি নামক জনবসতিতে এটি প্রতিষ্ঠিত এবং এখনও সেখানে জনবসতির বসবাস আছে। প্রাচীনকালে এর স্বর্ণযুগ সময়ে শিল্পে, সাহিত্যে, রাজনীতিতে লামু একটি অন্যতম প্রধান শহর ছিল। পরবর্তীতে এটি জার্মানি ও বৃটেন উভয় দেশের একটি প্রধান যুদ্ধস্থান হিসেবে ভূমিকা পালন করে।১৯৬০সালে লামু শহরটি প্রথম স্বাধীনতা লাভ করে।
যদিও পূর্বের বিভিন্ন শতাব্দীতে শহরটি অনেক জনবহুল এবং কর্মব্যস্ত ছিল,মানুষ এখন লামু শহরকে পরিত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। ২০১১সালে লামু শহরে ভ্রমণ করতে যাওয়াকে সম্পূর্ণ নিষেধ করে দেওয়া হয় কারণ সন্ত্রাসী আল-শাবাব তার দলসহ আক্রমণ করে। আল-শাবাব দাবী করে মুসলমানদের জমি চুরি করা হয় তাই সে এটার প্রতিশোধ নেয় এবং এতে করে অনেক মানুষ মারা যায়। সন্ত্রাসীদের এই আক্রমণে লামুর ঐতিহ্যবাহী স্থান যেমন লামু দুর্গ রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৪। গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ
চার্লস ডারউইন সম্পর্কে সবাই কম বেশি জানে। তিনি তার বিবর্তন তত্ত্ব উদ্ভাবন করতে গিয়ে গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের প্রাণী নিয়ে গবেষণা করেন।গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ চার্লস ডারউইন এবং অনন্য বন্যপ্রাণীর জন্য বিখ্যাত। বিশ্বের সবচেয়ে আদিম ক্রান্তীয় দ্বীপ এগুলো। প্রায় ৯০০০ প্রজাতি বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায় যেগুলার আদিনিবাস ছিল এই দ্বীপপুঞ্জ। দ্বীপপুঞ্জগুলো বিখ্যাত এর দৈত্যাকৃতি কাছিম ও লাভা টিকটিকির জন্য।এই দ্বীপপুঞ্জ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে তালিকাভুক্ত।এসব দ্বীপপুঞ্জ ও এর বন্যপ্রাণী বর্তমানে হুমকির মুখে। ডারউইনের অন্বেষণ পর থেকে নাটকীয় পরিবর্তন হয় এখানে।জনসংখ্যার আধিক্য,অবৈধ মাছ শিকারি,ট্যুরিজম শিল্পের আধিক্য ইত্যাদি কারনে গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ ও এর আদিপরিবেশ বিলুপ্তির পথে।
৫। ইন্ত্রামুরোস
ফিলিপাইনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হল ম্যানিলা। ম্যানিলার অর্থ হল দেয়ালের মধ্যে। বলা হয় এটি প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত। ১৬ শতকে এই দেয়াল নির্মিত হয়েছিল। স্প্যানিশ রাজাদের শাসনামলে ম্যানিলাই ছিল তাদের রাজধানী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সেনাবাহিনী কর্তৃক ফিলিপাইন আক্রমনের সময় এই দেয়াল বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ভারি গোলার আঘাতে এর অনেকখানি অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে মাত্র ৫% পুনর্নির্মাণ করা হয়। ১৯৫১ সালে এই দেয়ালকে ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। গ্লোবাল হেরিটেজ ফান্ড ও ঐতিহাসিকদের মতে শীঘ্রই এটি বিলুপ্তির পথে। এখনি এই দেয়ালের পাশে পরিখাসহ ঐতিহাসিক মনোরম স্থান ফোর্ট সানটিয়াগোসহ বেশ কিছু এলাকা গলফ কোর্সে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে হয়ত এখানে নির্মাণ হবে সুউচ্চ দালান, মল ইত্যাদি।
৬। সিসিলি
বেশিরভাগ মানুষ মাদাগাস্কার ছাড়া সিসিলির অন্য ১১৫ টি দ্বীপের কথা জানে না। এসব দ্বীপ প্রবাল এর তৈরি। এই দ্বীপগুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অত্যন্ত মনোরম।এখানে আগে মানুষ থাকত না। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬০০ সালে এগুলো আবিষ্কার করে। এরপর এখানে ছিল জলদস্যুদের আস্তানা। বর্তমানে তিমি মাছের মত বড় বড় মাছ দেখার একটি আদর্শ স্থান এই দ্বীপগুলো। এছাড়াও সামুদ্রিক কাছিম এর জন্য বিখ্যাত এসব দ্বীপ। এখানে জনবসতি কম থাকলেও পাখি ও সামুদ্রিক জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল। কিন্তু ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে প্রবালস্তর ধীরে ধীরে ধ্বসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখনি দ্বীপের অনেক প্রাণী বিলুপ্তির পথে।
৭। হিমবাহ ন্যাশনাল পার্ক
পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় এই পার্ক প্রায় ১০০০০ বছর আগের। মন্টনার এই জাতীয় হিমবাহ পার্কে বরফ ছিল ১.৬ কি.মি. গভীর। ১৯১০সালে যখন পার্কটি প্রতিষ্ঠিত হয় তখন সেখানে ১৫০টি হিমবাহ ছিল। বর্তমানে মাত্র ২৫টি আছে। ধারণা করা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে এটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। বিগত শতাব্দীতেই এটি তার ৯০ শতাংশ বরফ হারিয়েছে। বরফস্তর কমার সাথে সাথে এর মধ্যে অবস্থিত প্রাণীকুল তাদের আবাসস্থল পরিবর্তন করছে।তাপমাত্রা বৃদ্ধি এই স্থানটির ভবিষ্যতে হারিয়ে যাওয়ার কারণ।
লেখিকাঃ ফাহমিদা নাসরিন।পেশায় শিক্ষক।ভাল লাগে বই পড়তে আর ঘুরে বেড়াতে।অবসর সময় কাটে ক্রাফটিং করে।