এক
লোকনাথবাবার বাঁধানো ছবি, মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো ঠাকুমা, কুম্ভ মেলার নাগা সন্ন্যাসী – মানুষ যাকে পারছে খামচে ধরে “খ্যাচাক”। এমনিতেই আমরা কালচারপ্রবণ জাত। তার ওপর ‘সেলফি’র মতো এমন আর্টিস্টিক কাজ পেয়ে উৎসাহ তেরো গুণ বেড়ে গেছে। দিন শেষে নিজেরই দেড়শ ছবি। অবস্থা এমন জায়গায় গেছে যে, গলির অন্ধকারে প্রেমিকাকে পেয়েও সোমত্ত ছেলে চুমু খাচ্ছে না! ফ্রন্ট ক্যামেরায় সেলফি তুলছে। তুলেই পোস্ট। সঙ্গে ছুনুমুনু ক্যাপশন, ‘উই ইন কানাগলি, ফিলিং প্রেম প্রেম।’ ছোটবেলার বন্ধুর সঙ্গে কুড়ি বছর পর দেখা। কোথায় বুকে জড়িয়ে ধরবি, তা নয়, প্রথমেই গলা জড়িয়ে সেলফির অ্যাঙ্গেল ঠিক করতে ব্যস্ত।
আয়নার সামনে দাঁড়ালে যেমন সবটুকু নিজস্ব, তেমনই স্মার্ট ফোন নামক মোবাইলে সবটুকুই নিজস্বী। সুইচ টিপলেই নিজের সেই মুহূর্তের প্রতিবিম্ব সেভ হয়ে যাবে হাওয়ায়, হাওয়ায়। জমা থাকবে সেলফির সিন্দুকে। সেখানে আছে আরও আরও প্রতিবিম্ব। প্রচুর প্রচুর ‘আমি’। দুর্গা ঠাকুরের সামনে আমি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পেছনে আমি, হিমালয় পর্বতের পাশে আমি, প্যারামাউন্ট শরবতের সাথে আমি, ধর্ষণবিরোধী মিছিলে আমি, নবান্নের পাঁচিলে আমি, এরোপ্লেনের সিটে আমি, সিন্ধুঘোটকের পিঠে আমি। এমন অনর্গল ‘আমি’, যেন সুনামি। এইবার ভাইরাল ফিভারের চেয়ে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়বে এই আমি-কালেকশন। বন্ধু-বান্ধব, পাড়াপড়শির দেওয়ালে সেঁটে যাবে আত্মপ্রচারের স্টিকার।
মানুষমাত্রই কমবেশি নার্সিসিস্ট। আয়না দেখলে নিজের মুখটা অকারণেই একবার দেখে নিই আমরা। কেউ চুলটা ঠিক করে নিল, কেউ গোঁফে তা দিয়ে নিল। শপিং মলের কাচে, বাইকের মিররে, বন্ধুর চশমায়, প্রেমিকার চোখের তারায় নিজেকে দেখেই কেটে গেল ‘অর্ধেক জীবন’। কিন্তু সত্যি বলতে কী, আপন মনের এই দেখাগুলো দারুণরকম ব্যক্তিগত। একঘেয়ে রুটিনের ফাঁকে ফাঁকে নিজেকে একবার দেখে নেওয়া। একটু ভালোবাসার নরম নেশা, ছাপোষা চুমুর মতো গোপন। কিন্তু স্মার্ট ফোন গোপনীয়তার দফারফা করে ছেড়েছে। টুজি, থ্রিজি, ফোরজি- এখন ডিজিটাল নবজাগরণের স্বামীজি, নেতাজি, বাপুজি। আমাদের পুজোআচ্চা থেকে প্রাতঃকৃত্য, পুরোটাই প্রকাশিত সেলফির শোকেসে। খালি ‘বিয়ের টোপরে আমি’ পেরিয়ে ‘গার্লফ্রেন্ডের ওপরে আমি’-টুকু বাকি। তাহলেই ষোলকলা পূর্ণ আর ছলাকলা জিন্দাবাদ।
দুই
বাঁদরের হাতে তলোয়ার দিলে কী হয়? সেলফি। ২০১১ সালে ইন্দনেশিয়ায় প্রথম সেলফিটি তোলে ‘সেলেবস ক্রেস্টেড ম্যাকাক’ বা মাকাকা নিগ্রা প্রজাতির এক মেয়ে বাঁদর। আমাদের ‘পূর্বপুরুষ’। অবশ্য ইন্ধন জুগিয়েছিল ওয়াইলড লাইফ ফটোগ্রাফার ডেভিড স্লেটারের উদ্ভাবনী চিন্তা। ট্রাইপডে ক্যামেরা বসিয়ে, খুঁটিনাটি সমস্ত কিছু ঠিক করে দিয়ে তিনিই বাঁদরকে ক্যামেরা নিয়ে খেলার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। স্লেটারকে নিরাশ হতে হয়নি। বাঁদরী তুলেছে সেলফি।
গন্ডগোল বাঁধল ছবির কপিরাইট নিয়ে। স্লেটারের দাবি, কপিরাইট তাঁর প্রাপ্য। কেননা বাঁদরকে দিয়ে ছবি তোলানোর আইডিয়া প্রথম তাঁর মাথাতেই ঝিলিক মেরেছিল। বাঁদর ক্যামেরা পেলে যে কিছু একটা করবে এমন অনুমানই তো ডেভিডকে চালিত করেছিল। তাছাড়া ক্যামেরাও তাঁর নিজস্ব। এখন বাঁদর ক্যামেরা হাতে পেয়ে অন্যকিছু না তুলে সেলফি তোলে, তবে তার কপিরাইট অন্য কেউ কেন পাবে? কেন নেপোয় দই মারবে? অন্যদিকে মার্কিন কপিরাইট দপ্তর স্পষ্ট বলে দিয়েছে, যেহেতু স্লেটার নিজে ছবি তোলেননি, তাই তাঁর নামে ‘কপিরাইট’ ইস্যু হতে পারে না। আবার বাঁদর যেহেতু ‘নন হিউম্যান বিয়িং’ অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থেই অ-মানুষ, সুতরাং ওই সৃষ্টিশীল বাঁদরের নামেও ‘কপিরাইট’ মঞ্জুর করা যাবে না। ইতিমধ্যে বাঁদরের নামে কপিরাইটের দাবিতে সরব হয়েছে ‘পেটা’। আইনানুগ কপিরাইট কে পাবে এখনও তাঁর সমাধান হয়নি। যাইহোক আত্মপ্রীতির এই স্বভাব যে পূর্বপুরুষের থেকে চুইয়ে আমাদের মধ্যে এসেছে তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া গেল।
তিন
মাকাকা নিগ্রা প্রজাতির মেয়ে বাঁদরের সৌজন্যে এখন সারা পৃথিবী জুড়ে সেলফি নেশা। লাজ-লজ্জার বালাই নেই। নেশায় আক্রান্ত পোপ থেকে প্রেসিডেন্ট, নিকারাগুয়া থেকে নীলগিরি – সর্বত্র, সকলে। কয়েকদিন আগেই এক পৃথিবী বরেণ্য নেতার সৎকার হচ্ছে, আর গ্যালারিতে বসে তিন তাবড় দেশের নেতা-মন্ত্রী হাসিহাসি মুখে গ্রুপফি তুলছে। নিজেদের নিয়ে এতই বিভোর যে শিক্ষা, সভ্যতা দূরের কথা, চক্ষুলজ্জা টার্মটা অবধি ভুলে মেরেছে। এক তুঙ্গ গ্ল্যামার স্টার হাতির সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে পায়ের তলায় যাচ্ছিলেন একটু হলেই। ফাইটার প্লেনের পাইলট মিসাইল ছোঁড়া সেলিব্রেট করছে সেলফি তুলে। কেউ বুল ফাইটের ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের দিকে পিছন ফিরে সেলফি তাক করছে। কেউ লন্ডনের সাউথ টাওয়ার থেকে ঝুলে। কেউ একশো তলা বাড়ি বেয়ে উঠে, কেউবা বেসবলের শট মাথায় লাগার আগের মুহূর্তে সব ছেড়ে ছুড়ে নিজের ছবি তোলায় মত্ত। এখনও প্লেনের কাচটা খুলতে পারেনি ভাগ্যি, নাহলে ওখান থেকেও মুণ্ডু বাড়িয়ে পোজ দিত।
এখন কথা হলো, মানুষ তো অনেক আগে থেকেই টাইম-বেটাইমে নিজের ছবি তুলত, অ্যালবামে সজিয়ে রাখত, সময় অসময়ে উল্টে দেখত। তাহলে এখন এত কথা উঠছে কেন?
কথা উঠছে কারণ, সুস্থতা আর অসুস্থতার মধ্যে একটা মোটা লাইন আছে। লোকে দিনে দু’বার দাঁত মাজলে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু দিনে তেরবার মাজলে ডাক্তার দেখাতে হয় – দাঁতের নয় মাথার ডাক্তার। বাড়ি পরিষ্কার রাখাটা সুস্থতার লক্ষণ। কিন্তু এমন অনেক মানুষ আছেন যারা সুস্থতাকে এত উঁচুতে নিয়ে গেছেন, যে সারাদিন ন্যাতা-বালতি নিয়ে ঘোরেন। এটা কি সুস্থতা? তেমনই হয়েছে সেলফি বাতিক। প্রাতঃপ্রণাম থেকে পরকীয়া- সর্বত্র নিজের মুণ্ডু বাড়িয়ে পোজ দিয়ে যাচ্ছে। একবার ভাবুন, মোনালিসার হাতে স্মার্টফোন থাকলে ভিঞ্চির পোট্রেট কলকে পেত মার্কেটে!
চার
সেলফি কিন্তু আত্মমুগ্ধতারই চূড়ান্ত প্রকাশ। সারাদিন নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকা। ক্ষণে ক্ষণে নিজের ছবি তুলে এখানে ওখানে চিপকে দেওয়া। মাঝে যেটুকু সময় পাওয়া যাচ্ছে, সেই সময়ও নিজের তোলা নিজের পুরনো ছবি একের পর এক দেখে চলেছে। সঙ্গে অ্যানালিসিস, ‘আগে গায়ের রংটা আরও পরিষ্কার ছিল…এই ফ্রেমটায় আমায় মানায় ভাল…চুলটা বড্ড কমে গেছে…এই অ্যাঙ্গেল থেকে আমাকে একদম আলিয়া ভাটের মতো লাগে…।’
মোদ্দা কথা এই সেলফির ভিড়ে ‘সেলফ’টাই হারিয়ে ফেলেছি আমরা। অনবরত নিজেকেই খুঁজে চলা। খোঁজার নেশা। সেলফি তুলছি, খুঁটিয়ে দেখছি গোয়েন্দার মতো। খুঁজে পাচ্ছি না নিজেকে। আবার তুলছি। নিজস্বীর স্তূপে হারিয়ে ফেলা ‘আমি’-কে খুঁজে পাওয়ার ঘোরে উন্মাদের মতো হ্যাংলা হয়ে উঠেছি আমরা সবাই।
লেখকঃ কৌশিক ভট্টাচার্য, সাব-এডিটর, আজকাল, কলকাতা, পশ্চিমবংগ, ভারত থেকে।