সিনেমা শুধু বিনোদনের মাধ্যমই নয় বরং কিছু কিছু সিনেমা আমাদের বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটায় । প্রতিটা দেশের সিনেমারই কিছু নিজস্ব ধাঁচ আছে । এই ধারাবাহিকতায় ইরানী সিনেমাগুলো বরাবরই বাস্তবসম্মত এবং শিশুতোষ সিনেমার জন্য বিখ্যাত । ইরানী সিনেমাগুলো হয়ত বানিজ্যিক সিনেমাগুলোর মত নাচ গানে পরিপূর্ণ নয় কিন্তু তারপরেও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অদ্ভুত এক সম্মোহনী মায়া দিয়ে সিনেমাগুলো দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে । সিনেমাগুলোতে নাচ গান না থাকলেও জীবনের ছোঁয়া থাকে ষোল আনা । যেখানের কোন একটা ঘটনা বা আবেগঘন কোন মুহূর্ত হঠাৎ করেই আপনাকে নিয়ে যাবে আপনার শৈশবে বা মনে করিয়ে দেবে কৈশোরের কোন স্মৃতি । আজ এমনই কিছু ইরানী সিনেমার সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব । যেগুলো কিছুটা হলেও আপনার মনকে নাড়া দিয়ে যাবে, ছুঁয়ে যাবে ভাল লাগার অন্যরকম এক অনুভূতি ।
১। FATHER (1996)
পরিচালক : মাজিদ মাজীদি
লেখক : মাজিদ মাজীদি এবং সৈয়দ মেহদী সোহজাই ।
অভিনয়ে মোহাম্মাদ কাসেবি, পরিভাস নাজারিহ, শিশুশিল্পী হুসাইন আবেদিনি, হাসান সাদেঘি, এবং আরও অনেকে ।
সিনেমাটি ফেস্তোরিয়া ত্রোয়া আন্তর্জাতিক পুরস্কার, সান সাবেস্তিয়ান আন্তর্জাতিক পুরস্কার, সাও পাওলো আন্তর্জাতিক পুরস্কারসহ মোট ৯ টি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করেছে । এছাড়াও আরও ৩ টি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছে ।
সিনেমাটি একটি পরিবারিক জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে । মেহরুল্লাহ ১৪ বছর বয়সী একজন শিশু যে কিনা তার বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরার জন্য কাজের সন্ধানে শহরে পাড়ি জমায় । তার ছোট ছোট ৩ টি বোন আছে যাদের সে অনেক ভালবাসে । অনেকদিন পর সে একদিন বাড়িতে আসে এবং তার সবচেয়ে ভাল বন্ধুর সাথে দেখা হয় পথে । সেই বন্ধুর কাছে থেকে সে শুনতে পায় যে তার মা আবার বিয়ে করেছে একজন পুলিশকে । এ সংবাদ শুনে মেহরুল্লাহ কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না । সে তার বাবার জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে বা চিন্তা করতে পারে না । এরপর শুরু হয় তার মায়ের সাথে মানসিক দ্বন্দ্ব । সে তার মা কে নানাভাবে অপমান করতে থাকে এবং তার সৎ বাবাকে বিভিন্নভাবে আঘাত করার চেষ্টা করে এবং বিপদে ফেলার চেস্টা করে । এরপর একদিন মেহরুল্লাহ আর তার বাবা মরুভূমিতে হারিয়ে যায় এবং তার সৎ বাবা মৃত্যুর মুখোমুখি হয় । এভাবেই শিশু মনের বিভিন্ন দ্বন্দ্ব, বিদ্রোহী মনোভাব এবং পারিবারের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার অসাধারন সব উপস্থাপন নিয়ে সিনেমার গল্প এগিয়ে চলে ।
২। BARAN (2001)
পরিচালক এবং লেখক : মাজিদ মাজীদি ।
অভিনয়ে হুসাইন আবেদিনি, যাহ্রা বাহরামী , মোহাম্মাদ আমির নাজি, আব্বাস রাহিমি এবং আরও অনেকে ।
সিনেমাটি মন্ট্রিল ওয়ার্ল্ড ফিল্ম পুরস্কার, গিজন আন্তর্জাতিক পুরস্কার, শিকাগো আন্তর্জাতিক পুরস্কারসহ মোট ১৩ টি আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পুরস্কার জয় করেছে । এছাড়াও আরও ৫ টি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছে ।
১৭ বছরের কিশোর লতিফ একটি কন্সট্রাকশন বিন্ডিং এ চা পরিবেশনকারী হিসেবে চাকুরী করে । তার সাথে প্রায় প্রায় ওখানকার শ্রমিকদের সাথে ঝগড়া হয় । এর মধ্যেই সেই কন্সট্রাকশন সাইটে রাহমাত নামে আরেকটি ছোট্ট বালক আসে কাজের জন্য । কিন্তু একদিন সিমেন্টের ভারী বস্তা বহন করে উপরে নিয়ে যাওয়ার সময় সে দুর্ঘটনা ঘটায় । এরপর তাকে ওসব কাজ থেকে সরিয়ে লতিফ এর কাজে বহাল করা হয় এবং লতিফকে রাহমাতের কাজে লাগানো হয় । এতে লতিফ ক্ষিপ্ত হয় কারন এখন তাকে অনেক কাজ করতে হবে । এজন্য সে বিভিন্ন সময় রাহমাতকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে এবং সারাক্ষণ তার পেছনে লেগে থাকে । এদিকে রাহমাতের রান্না এবং কাজে সবাই সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে থাকে । এটা লতিফকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে । কিন্তু একদিন হঠাত করেই লতিফ আবিস্কার করে রাহমাত আসলে কোন ছেলে নয় সে একজন মেয়ে । মেয়েটির নাম বারান । এরপর থেকে তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখা দেয় এবং বিভিন্নভাবে সে বারান কে বিপদ থেকে রক্ষা করার চেস্টা করে । সিনেমাটি আমাদের কিশোর বয়সের অকৃত্রিম ভালবাসার কথা মনে করিয়ে দেবে ।
৩ । THE REWARD (2009)
পরিচালক : ইসমাইল মিহানদোস্ত ।
লেখক : যাবের ঘাসেম আলি এবং ইসমাইল মিহানদোস্ত ।
অভিনয়ে ফিরৌজ বেহজাত মোহামাদি, ইসমাইল দাভারফার, নাদিয়া দেলদার গোলচিন, মিনা নোরোজি এবং আরও অনেকে ।
রেজা একজন সাধারন ছাত্র যার পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে তার বাবা সন্তুষ্ট নয় । রেজা এবং তার বোন একসাথে স্কুলে যায় এবং আসে । তাদের স্কুলে যাওয়ার পথে একটি সাইকেলের দোকান আছে । সেখানে একটি সাদা সাইকেল রেজার খুব পছন্দ । সে সাইকেলটি কেনার স্বপ্ন দেখে কিন্তু সে ছোট বলে তার কাছে পর্যাপ্ত টাকাও নেই । এদিকে রেজার স্কুলের রেজাল্ট ভাল করার জন্য তার বাবা তাকে পুরস্কৃত করার ঘোষণা দেয় । তার বাবা তাকে বলে যদি সে কোন বিষয়ে এ+ পায় তবে প্রতি এ+ পাওয়ার জন্য তার বাবা তাকে ২০০ টোমান দেবে । এই ঘোষণায় রেজার মনের সুপ্ত স্বপ্ন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে । সে সাইকেল কেনার টাকা সংগ্রহ করার জন্য পড়ালেখায় মনযোগী হয় এবং এ+ পেতে থাকে । সে যত এ+ পায় তার বাবা তার ওয়াদা অনুযায়ী তত টোমান প্রদান করে । এক সময় রেজা প্রতিটা বিষয়েই এ+ পেতে থাকে । কিন্তু রেজার পরিবার আর্থিকভাবে ততটা সচ্ছল নয় তাই প্রতি মাসে রেজাকে এত টাকা দিতে গিয়ে তার পরিবারকে অনেক ঋণের সম্মুখীন হতে হয় । এক রাতে রেজা ঘুম ভেঙ্গে তার মা বাবার দুশ্চিন্তার কথা শুনতে পায় । কঠিন বাস্তবতার কাছে শিশুমনের স্বপ্ন হার মেনে যায় । সিনামটি দেখতে নিজের শৈশবের এমন কোন স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যেতে পারে যা বিভিন্ন কারনে পুরন হয়নি যার বেদনা এখনও কষ্ট দেয় ।
৪ । GRANAZ (2009)
পরিচালক : আব্বাস রাফেই ।
লেখক : গোলাম রেজা রামেজানি ।
অভিনয়ে মাটিন হাইদারনিয়া, সাফা মালাকদাল, ঘোরদান নাদযাফি, ড্যানিয়াল নোরভাস এবং আরও অনেকে ।
ছোট্ট মিলাদ প্রায় প্রায় স্কুলে দেরীতে উপস্থিত হয় । মিলাদের সাথে তার কিছু বন্ধুও আছে যারা প্রতিদিন স্কুলে দেরীতে আসে এবং তাদের দেরীর কারন তারা স্কুলে আসার পথে দুষ্টামি এবং খেলা করতে করতে স্কুলে আসে । এতে তাদের প্রতিদিন সতর্ক করা হয় কিন্তু তারা বিভিন্ন মিথ্যা অজুহাত দেখায় । এজন্য স্কুল থেকে তার বাবা মা এর কাছে প্রায় প্রায় অভিযোগ যায় এবং তাদের অভিভাবকরাও এটা নিয়ে খুব বিরক্ত । একদিন মিলাদ স্কুলে আসার পথে এক বাসের ড্রাইভার তাকে একজন বয়স্ক মহিলাকে রাস্তা পার করে দেয়ার জন্য বলে যে কিনা ভুলে ভুল বাসে উঠে গিয়েছে । কিন্তু সমস্যা হয় যে এই মহিলা অন্য ভাষায় কথা বলে যা অনেকেই বুঝতে পারে না । মিলাদকে বলা হয় মহিলাটিকে যেন সঠিক বাসে তুলে দিয়ে আসে সে । সবাই মহিলাকে মিলাদের দাদী মনে করে । মিলাদ মহিলাকে বাস স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে চলে যায় কারন তার স্কুলে দেরী হয়ে যাবে । রাস্তায় মিলাদের দুষ্ট বন্ধুরা বলে আজ স্কুল বন্ধ এটা শুনে মিলাদ সেই বয়স্ক মহিলাকে সাহায্য করার জন্য আবার তার কাছে ছুটে যায় কারন তারও একজন দাদি আছে যাকে সে অনেক ভালবাসে । কিন্ত সেদিন স্কুল বন্ধ ছিল না আর স্কুলে অনুপস্থিত থাকার কারনে মিলাদের বাবা তাকে খুব মারধর করে । মিলাদ তার অনুপস্থিত থাকার কারন বলতে চাইলে কেউ তা শুনতে চায় না । এরপর ক্লাসে শিক্ষক ছাত্রদের দুটো বিষয়ে লেখার জন্য বলে । তখন মিলাদ তার বাবাকে চিঠি লিখে তার স্কুলে না আসার কারন জানিয়ে । ছোট্ট মিলাদের চিঠি পড়ে শ্রেনী শিক্ষক এক অসাধারন অবাক করা সত্যের মুখোমুখি হয় যার জন্য সে মিলাদের প্রতি খুব কৃতজ্ঞ হয় এবং মিলাদ তার ছাত্র বলে তার গর্ব হতে থাকে ।
ছোটকালে স্কুল যাওয়ার পথে যারা বন্ধুদের সাথে দুষ্টুমিতে মেতে থাকতেন এবং তার জন্য প্রায়ই স্কুলে দেরী হয়ে যেত তারা সিনেমাটির সাথে নিজেদের শৈশবের স্মৃতি আরেকবার ঝালিয়ে নিতে পারেন ।
লেখিকাঃ শারমীন আক্তার সেতু। আমি পেশায় একজন মনোবিজ্ঞানী । কবিতা লিখতে এবং পড়তে পছন্দ করি । মনোবৈজ্ঞানিক ফিচার লেখার সাথে যুক্ত আছি। তাছাড়াও অন্যান্য বিষয়েও লিখতে এবং জানতে পছন্দ করি । আমি এর আগে পরামর্শ .কম এ লেখার সাথে যুক্ত ছিলাম । এখন কিছু ইংরেজি সাইটে অনুবাদের কাজ করছি । আমার শখ ভ্রমণ এবং গান গাওয়া । বাগান করতে পছন্দ করি এবং বিভিন্ন গাছ,ফুল্,ফল এবং নতুন নতুন জায়গার সাথে পরিচিত হতে ভাল লাগে।