আপনি যদি হোন ভ্রমণপিপাসু আর আপনার পকেটে থাকে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ তাহলে থেকেই আসুন না বিলাসবহুল ভাসমান হোটেলগুলোতে যা তৈরি হয়েছে সম্পূর্ণ পানির উপর।শুধু কি থাকা? না তা কেন হবে। এসব রিসোর্টে থাকার সাথে সাথে আপনি উপভোগ করতে পারেন রিসোর্টগুলোর চারপাশে ঘিরে করে প্রবাল দ্বীপ কিংবা পরিদর্শন করতে পারেন স্থানীয় মানুষদের জীবন যাত্রা। এছাড়া সমুদ্রতলের নানা ঐশ্বর্য দেখে আপনি নিজেকে সংযত নাও রাখতে পারেন। কিন্তু এ সবই আপনার মনকে বিমোহিত না করে পারবে না। তাহলে চলুন জেনে নিই বিশ্বের সেসব ১০ ভাসমান বা রিসোর্টের হোটেল নানা তথ্য।
১। কোকো আইল্যান্ড, মালদ্বীপ
মালদ্বীপের কোকো আইল্যান্ডে অবস্থিত রিসোর্টটি বিশ্বের ভাসমান বিলাসবহুল হোটেলগুলোর একটি। প্রকৃতির কাছাকছি আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধাসমৃদ্ধ এবং দেশীয় ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে তৈরি এই রিসোর্টে ৩৩টি স্যুট ও ভিলা রয়েছে।স্থানীয় স্বতন্ত্র ধোনী নৌকার (ধনুক আকৃতির নৌকা) আদলে তৈরি করা হয়েছে এই স্যুটগুলো। স্থানীয় জেলেদের নৌকায় ব্যবহৃত কুঁচানো কাঠ এই রিসোর্ট নির্মানে ব্যবহার করা হয়েছে। রিসোর্টের চারপাশে কাঠের তৈরি ধনুকের ন্যায় বাঁকানো হাঁটা রাস্তা দিয়ে ভ্রমণার্থীরা সহজে দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। প্রত্যেকটি রুমের সাথে রয়েছে নিজস্ব চত্ত্বর যেখান থেকে আপনি আপনার প্রিয়জনকে নিয়ে মালদ্বীপের সমুদ্র সৈকতের উষ্ণতা আর নীল জলরাশি আপনার জীবনের স্বর্গীয় সুখ নিয়ে আসবে নির্ধিদ্বিধায় বলা যায়। এছাড়া কাঠের তৈরি বিস্তৃত প্লাটফর্মে দাড়িয়ে আদিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি, দেহাতি মানুষের সংগ্রামী পথচলা কিংবা নান্দনিকতায় ভাস্বর প্রাকৃতিক পরিবেশ একজন ভ্রমণপিপাসু হিসেবে আপনার মনকে নাড়া দিয়ে যাবে।
২। পান্টা ক্যারাকল্ একুয়্যা লজ, পানামা
পানামায় অবস্থিত পান্টা ক্যারাকল্ একুয়্যা লজ একটি বিশ্বমানের পরিবেশ বান্ধব লজ।ক্যারাবিয়ান সাগরের ইসলা কোলন অঞ্চলের প্রত্যন্ত প্রবাল উপদ্বীপের উপর নির্মিত এই লজে অত্যাধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান। সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই লজটি প্রকৃতির খুব কাছাকাছি হওয়ায় চারদিকের নয়নাভিরাম দৃশ্য আপনার মনকে আন্দোলিত করে তুলবে নিঃসন্দেহে।পানির উপর অবস্থিত এই লজে রয়েছে দুই তলা বিশিষ্ট নয়টি কেবিন। প্রত্যেকটি কেবিনের সাথে যুক্ত রয়েছে প্রাইভেট ব্যালকনি। ব্যালকনির সুদৃশ্য দোলনায় শুয়ে আপনি দেখতে পারেন সর্যোদয় আর সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য।এ লজে প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটি রেস্তোরা রয়েছে যেখানে আপনাকে আপনার পছন্দমত খাবার পরিবেশন করার জন্য সর্বদাই প্রস্তুত। সম্পূর্ণ বোটহাউজটি সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে বিদ্যুতায়িত করা হয়েছে। আপনি ব্যালকনিতে বসে কিংবা কেবিনের ছাদে বসে ডলফিনদের চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। এছাড়াও আপনি নৌকায় করে বড়শীতে মাছ শিকার করতে পারেন। এখানকার রেনফরেস্ট, তার চারদিকের ছোট ছোট পাহাড় এবং স্থানীয় জনপদে ভ্রমণ করতে পারেন।
৩। খোয়াই রিসোর্ট, থাইল্যান্ড
থাইল্যান্ডর খোয়াই নদীতে অবস্থিত ভাসমান রিসোর্টটিতে রয়েছে ১৮টি ভিলা। থাইল্যান্ডের ঐতিহ্য বজায় রেখে প্রতিটি ভিলা তৈরী করা হয়েছে বাঁশ এবং টিকউডের সমন্বয়ে।এসব রিসোর্টে অবস্থানকারী ভ্রমণপিপাসুদের জন্য নানা প্যাকেজ ট্যুরের ব্যবস্থা রয়েছে।ভ্রমণকারীরা হাতির পিঠে চড়ে দর্শনীয় বৌদ্ধ মন্দিরগুলো ঘুরে আসতে পারেন।স্থানীয় আদিবাসীদের গ্রাম পরিদর্শন করতে পারেন আর উপভোগ করতে পারেন তাদের নানা সাংস্কৃতিক কার্যক্রম।
৪। এরিয়া অ্যামাজন, পেরু
আপনার মত ভ্রমণপিপাসুদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল হতে পারে পেরুর আমাজন নদীর ১৪৭ ফুট লম্বা(দৈর্ঘ্য৪৫ মিটার)এরিয়া অ্যামাজন, নামক ভাসমান হোটেলটি। এই হোটেলটির নকশা করেছেন একজন পেরুভিয়ান আর্কিটেক্ট যার নাম জর্ডি পেগ।প্রকৃতপক্ষে এউ হোটেলটি একটি ভাসমান ক্রুজ যেখানে ক্রুসহ ৩২ যাত্রীর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।একজন যাত্রী সহজেই বাধাবিঘ্নহীনভাবে অ্যামাজন অঞ্চলের অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী দেখার বিরল সৌভাগ্য লাভের অধিকারী হতে পারেন। এই হোটেলটির স্লিপিং কোয়াটারে রয়েছে ১৬টি স্যুট। প্রত্যকটির সাথে রয়েছে একটি লজ যার চতুর্দিকে বিস্তৃত নদীর দৃশ্যাবলী দেখার সুব্যবস্থা রয়েছে। এই লজ থেকেই একজন দর্শনার্থী
দেখতে পারেন পাখি খেকো মাকড়শা কিংবা এনাকোন্ডা নামক বিশালআকৃতি ও দৈঘ্যের সাপ ছাড়া আরও বিচিত্র রকমের পাখি এবং নানাধরনের জন্তু জানোয়ার।খুব ভাগ্যবান হলে গোলাপী ডলফিন কিংবা একটি কালো জাগুয়ার সাথে আপনার দেখা হয়ে যেতে পারে।
৫। দ্য মেরিডিয়ান বোরা বোরা হোটেল, ফ্রান্স
ফ্রান্সর পলিনিশিয়া বোরা বোরা বিমান বন্দর থেকে মাত্র নয় কিলোমিটার দূরে এই হোটেলটি অবস্থিত।বিমান বন্দর থেকে মাত্র পনের মিনিটের নৌকা ভ্যমণ করে আপনি সহজেই এই হোটেলে পৌঁছে যেতে পারেন্।হোটেলটির চতুর্দিক প্রবাল প্রাচীর বেষ্টিত।মেরিডিয়ান বোরা বোরা হোটেলটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেখানে রয়েছে দর্শনীয় বীচ বাংলো। স্বচ্ছ কাঁচের জানলারে বাংলোর চারপাশে রয়েছে সামুদ্রিক গাছপালা। এছাড়াও বিলাসবহুল প্রিমিয়াম বংলোর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি স্বচ্ছ হ্রদ যেখানে আপনি আপনার প্রিয়জনের সাথে সাঁতার কাটতে পারেন অথবা পারেন তার সাথে নির্জন মুহুর্ত কাটানোর সুযোগ।
৬। দ্য মান্টা রিসোর্ট, তানজানিয়া
তানজিনিয়ায় অবস্থিত জানজিবার পেম্বা আইল্যান্ডে অবস্থিত মান্টা রিসোর্টটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল জলের নিচে থাকার ব্যবস্থা। তিন তলার এই স্যুটটির একটি তলা জলের উপরে এবং বাকি অংশটি জলের নিচে অবস্থিত।জলের নিচের মাস্টার বেডরুমটিতে রয়েছে কাঁচের জানলা যেখান থেকে আপনি সমুদ্রতলের জীবন অবলোকন করতে পারেন। বিশাল বীচ এবং এই রিসোর্টটির চারপাশের প্রাকৃতিক প্রবাল দেখার জন্য অতিথিরা সর্বদা উদগ্রীব হয়ে থাকেন।
৭। সার্বিয়ার ভাসমান দুই কাঠামো বিশিষ্ট ক্যাটামার্ন হোটেল
সার্বিয়ায় অবস্থিত সার্বিয়ার ইয়াচ্ট ডিজাইন ফার্ম এবং সার্বিয়া বেইজ্ড আর্কিটেকচার ‘সল্ট এন্ড ওয়াটার’এর মিলিত প্রয়াস দুই কাঠামো বিশিষ্ট ভাসমান ক্যাটামার্ন হোটেল হতে পারে আপনার পরবর্তী গন্তব্যস্থল । সম্প্রতি মিলেনিয়াম ইয়ট ডিজাইন এই হোটেলের নকশার জন্য পুরুষ্কৃত হয়েছে। এই ভাসমান হোটেলটির দুইটি অংশ: একটি অংশে রয়েছে অভ্যর্থনা কক্ষ, রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, ইভেন্ট হল, স্টাফদের রুম, এবং অতিথিদের তাদের ক্যাটামার্ন এপার্টমেন্টসমূহে যাতায়াতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অপর অংশটিতে রয়েছে আগত অতিথিদের জন্য বরাদ্দ কক্ষ। এই ক্যাটামার্ন এপার্টমেন্টসমূহে উদ্ভাবনী নকশার সন্নিবেশ করা হয়েছে। অতিথিদের কক্ষ থেকে হোটেলের ডক এমনভাবে পৃথক করা হয়েছে যেখানে অতিথিরা তাদের কক্ষে নির্জনতা এবং পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। প্রতিটি এপার্টমেন্টে রয়েছে একটি বৈঠকখানা,নিজস্ব ছোট কিচেন,ব্যবহারের জন্য বাথরুম, জিনিসপত্র রাখার জন্যছোট স্টোর রুম এবং একটি লিভিং রুম। মোটামুটি দুই থেকে চারজনের ব্যবস্থা রয়েছে এই ক্যাটামার্ন এপার্টমেন্টে । এখানকার বীচ প্লাটফরম থেকেই আপনি চাইলে সাঁতার বা ডাইভিং কাটতে পারেন, ইচ্ছে করলে মাছ ধরতে পারেন বা যখন তখন আপনি সূর্যস্নানও করতে পারেন।
৮। কিং পেসিফিক, লজ
ব্রিটিশ কলাম্বিয়া উপকূলে অবস্থিত কানাডিয়ান জনহীন প্রান্তরে এই বিলাসী রিসোর্টটির গন্তব্যস্থল। এই রিসোর্টটি অত্যন্ত দামী সুগন্ধী কাঠ দারা নির্মিত যা শুধুমাত্র সমতলের উপরে ব্যবহারযোগ্য। মে-অক্টোবর পর্যন্ত এই রিসোর্টটি খোলা থাকে। রয়েল প্রিন্সেস দ্বীপের বার্নার্ড বন্দরের ষিুবিশাল প্রান্তর জুড়ে লজটি অবস্থিত। এর চতুর্দিকে রয়েছে গ্রেট বিয়িার রেন ফরেস্ট। এই ফরেস্টটি বহু পুরনো দেবদারু গাছ এবং নানধরনের বন্যপ্রাণী দ্বারা বেষ্টিত যা এখানকার ভ্রমণপিপাসুদের মূল আকর্ষণ । আধুনিক ডিজাইন, ভোজন বিলাসীদের জন্য খাবারের সুব্যবস্থা এবং সৌখিন আবাসনের ব্যবস্থা এই লজে বিদ্যমান। এই লজের চারপাশের অনন্যসুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করে আপনি হবেন পরিতৃপ্ত। এছাড়া এ সুযোগে প্রচুর পরিমানে কুজোঁ তিমি, পালকহীন ঈগল, সমুদ্র সিংহ, কালো ভালুক এবং বিরল প্রজাতির সাদা ভালুক দেখে আপনি হয়ে পড়বেন আপ্লুত।
৯। সিক্স সেন্স রিসোর্ট, মালদ্বীপ
মালদ্বীপের লামুতে অবস্থিত সিক্স সেন্স রিসোর্ট বিশ্বের অন্যতম বিলাসবহুল এবং ব্যয়বহুল রিসোর্ট ।ভারত মহাসাগরের একটি বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে প্রবাল প্রাচীরবেষনটকারী দ্বীপ লামুর অবস্থান কিন্তু সিক্স সেন্স রিসোর্টটি কার্যত ম্যাপে অচিহ্নিত অবস্থায় রয়েছে। এ দ্বীপের মূল বৈশিষ্ট্য হলো: এর প্রাকৃতিক অবস্থান, স্বচ্ছ টলটলে পানি, সাদা গুড়ো বালি, ঘন ক্রান্তীয় গাছপালা এবং সর্বশেষ এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যা এককথায় অতুলনীয় । মালদ্বীপের এই রিসোর্টটির কিছু অংশ সমতলে হলেও অধিকাংশ অংশই জলের উপর অবস্থিত।রিসোর্টটির কননস্ট্রাকশনে টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। পামগাছের সারি দিয়ে ঘেরা রিসোর্টটি যেন এক নন্দনকানন।
১০। আমাজন জঙ্গল প্যালেস, ব্রাজিল
ভাসমান আমাজন জঙ্গল প্যালেস বিশ্বের একটি প্রথম পরিবেশবান্ধব এবং বিলাশবহুল হোটেলগুলোর একটি । বাজিলের রেনফরেস্টের মধে্যকার বিশাল এলাকা জুড়ে হোটেল চত্ত্বরটি অবস্থিত। এটি নিগ্রো নদীর তীরে অবস্থিত। ব্রাজিলের মেনোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রায় 10 মাইল দূরে অবস্থিত এই রিসোর্টটিতে৬৫ টি এপার্টমেন্ট । সমগ্র আমাজনের মধ্যে শুধুমাত্র এই একটি হোটেলই রয়েছে যেখানে পানি পরিশোধানাগার এবং বর্জ্য সংগ্রহ ও পয়ঃনিস্কাশনের আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে। ইউনিনরেট লরিয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টারের একদল গবেষকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। .
লেখিকা সম্পর্কেঃ পাপিয়া দেবী অশ্রু। শখ -বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেড়ানো, গান করা, ছবি আঁকা। লেখা – লিখিতে বেশ আগ্রহ থাকলেও তেমন ঘটা করে হয়ে উঠেনি কখনও। শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত আছি। ইচ্ছে আছে একেবারেই নতুন কিছু করার, যা বিশ্বজুড়ে সবার দেখার মতই। অদ্ভুত ইচ্ছে!!!