অনলাইন পত্রিকার যুগে বিশ্বের একমাত্র হাতে লেখা পত্রিকা “মুসলমান”

ডিজিটাল প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে বর্তমানে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে আলোর মত দ্রুতগতিতে তথ্যের বিস্তার সম্ভব। যেকোনো খবর টাইপ বা রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিলে মূহুর্তেই পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। কাগজে ছাপানো বইয়ের বদলে ডিজিটাল যন্ত্রে বই পড়া, ছাপানো সংবাদপত্রের বদলে অনলাইনে খবর পড়ার প্রচলন শুরু হয়েছে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি আর প্রাচীন ঐতিহ্য সমানতালেই চলছে ভারতের চেন্নাইয়ে। সেখানে আজও একটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা প্রতিদিন হাতে লিখে প্রকাশ করা হয়।

দ্যা মুসলমান, একটি উর্দু ভাষায় হস্তলিখিত সংবাদপত্র। ১৯২৭ সালে সৈয়দ আজমতুল্লাহর হাতে এটি প্রতিষ্ঠালাভ করে। বর্তমানে এর সম্পাদনার দায়িত্বে আছেন তাঁর নাতি সৈয়দ আরিফুল্লাহ, যিনি তাঁর পিতার মৃত্যুর পর এই দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। আরিফুল্লাহ ছাড়াও তিনজন বিশেষজ্ঞ ক্যালিগ্রাফার সংবাদপত্র লেখার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন, যাঁদেরকে বলা হয় কাতিব। একেকজন কাতিব একেকটি পৃষ্ঠা লেখার দায়িত্বে থাকেন। প্রতি পৃষ্ঠার জন্যে তাঁরা ষাট রুপী পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। এছাড়া সংবাদ সংগ্রহের কাজটি সম্পন্ন করেন তিনজন সংবাদদাতা।

ক্যালিগ্রাফির ধর্মীয় ব্যুৎপত্তিগত কারণে ভারতের মুসলিমদের মধ্যে এর বিশেষ কদর রয়েছে। প্রাচীনকালে কাতিবের পদটি অত্যন্ত সম্মানজনক পদ হিসেবে গণ্য করা হতো। ডেইলি মেইলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আরিফুল্লাহ বলেন- “দ্যা মুসলমানের হৃদয় হচ্ছে ক্যালিগ্রাফি। হৃদয়টাই যদি বের করে নেওয়া হয়, তাহলে আর কিছু বাকি থাকে না।”

১৯৮০ সাল পর্যন্ত সকল উর্দু সংবাদপত্রই হাতে  লেখার চল ছিল। পরবর্তীতে ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে অন্যান্য সংবাদপত্র আধুনিক মুদ্রণ প্রযুক্তির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে থাকলেও দ্যা মুসলমান ঠিকই প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। চার পৃষ্ঠাবিশিষ্ট এই সান্ধ্যকালীন সংবাদপত্রটি আজও হাতে লেখার মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকি পত্রিকার বিজ্ঞাপনগুলো ডিজিটাল আকারে জমা দেওয়া হলেও পত্রিকায় সেগুলো হাতে এঁকে প্রকাশ করা হয়। লেখা শেষ হওয়ার পর এর নেগেটিভ   থেকে প্রিন্টিং প্লেট প্রস্তুত করা হয়, আর এভাবেই ১৯২৭ সাল থেকে আজ অবধি প্রতিদিন পত্রিকাটি প্রকাশ হয়ে আসছে।
অতীতে কোনো ব্রেকিং নিউজ দেরি করে পৌঁছলে সেটির জন্যে পুরো একটা পৃষ্ঠা আবার নতুন করে লিখতে হতো। কিন্তু এখন পত্রিকাটির প্রথম পৃষ্ঠার এক কোণায় কিছুটা জায়গা ব্রেকিং নিউজ প্রকাশের জন্যে ফাঁকা রাখা হয় এবং বিকেল তিনটার পূর্বে নিউজরুমে কোনো ব্রেকিং নিউজ পৌঁছলে তা ঐ নির্দিষ্ট জায়গাটিতে যোগ করে দেওয়া হয়।
৮০০ বর্গফুটের সীমিত পরিসরে গড়ে উঠেছে সংবাদপত্রটির এক কক্ষবিশিষ্ট কার্যালয়। কিন্তু তাতে তাঁদের কাজের আগ্রহের কোনো কমতি নেই। কর্মীগণ তাঁদের কাজের প্রতি একনিষ্ঠ, বিশ্বস্ত এবং তাঁদের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তাঁরা এ কাজ করে যেতে চান বলে জানান প্রধান প্রতিবেদক রেহমান হুসেইন। আরিফুল্লাহ খালিজ টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, তাঁরা সবাই একটি পরিবারের মত।

blank
হায়দ্রাবাদ, কোলকাতা, মুম্বাই, নিউ দিল্লীসহ সমগ্র ভারতেই দ্যা মুসলমানের সংবাদদাতা রয়েছে। এসব এলাকায় পত্রিকাটির গ্রাহকও রয়েছে, যাদের বেশিরভাগই মুসলিম, তবে উর্দু ভাষা জানেন এমন হিন্দু গ্রাহকও কম নয়। সংবাদপত্রটির মোট গ্রাহকসংখ্যা ২৩০০০। এছাড়া যাঁরা এর নিয়মিত গ্রাহক নন, তাঁরা পত্রিকার দোকান থেকে মাত্র পঁচাত্তর পয়সা মূল্যে এটি সংগ্রহ করতে পারেন। অনেক খ্যাতনামা ধর্মীয় নেতা, ক্ষমতাসীন ব্যক্তি, লেখক ও কবির অবদান রয়েছে এই সংবাদপত্রটিতে। পত্রিকাটির মূল্যমান খুব কম হলেও অধিকাংশ সরকারী এবং কিছু বেসরকারী বিজ্ঞাপন সংস্থা থেকে যে অর্থ আসে, তা কর্মীদের বেতনের জোগান দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। সাধারণভাবে পত্রিকাটি সাদা-কালো, তবে বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনে এটি রঙিনও করা হয়ে থাকে। দ্যা মুসলমান পত্রিকা প্রকাশনার কাজটি একটি শিল্প, প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন এবং কর্মীরা আনন্দ নিয়েই এর জন্যে কাজ করে থাকেন