দ্য ফিজ
প্রিয় পাঠক, আমি কোন কোল্ড ড্রিংকস এর নাম বলছি না। কোন নতুন ইংরেজী শব্দও আপনাদের শেখাচ্ছি না। দেশের অথবা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের যদি একটু সামান্যতম খোঁজও আপনি রেখে থাকেন, তাহলে এই নামটি শোনামাত্রই আপনাদের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠার কথা। মনের পর্দায় ভেসে ওঠার কথা একটি দৃশ্যপটের। লিকলিকে একটি ছেলে বোলিং মার্ক থেকে দৌড় শুরু করেছে। ব্যাট হাতে নিয়ে প্রস্তুত ব্যাটসম্যান। দৌড়ে এসে বাম হাত থেকে একটি বল ছুঁড়ল সেই ছেলে। ব্যাটসম্যান কিছু বুঝে ওঠার আগেই অফস্ট্যাম্প লাফিয়ে উঠে ডিগবাজি খেল আকাশে। দুই হাতে তালি বাজাতে বাজাতে, মুখে সরল একটা লাজুক হাসি নিয়ে উদযাপন করতে লাগলো ছেলেটি।
ঠিকই ধরেছেন। আমি মুস্তাফিজুর রহমানের কথা বলছি।
পৃথিবীতে প্রত্যেকটি মানুষই কোন না কোন লক্ষ্য নিয়ে বাঁচে। কারো লক্ষ্য থাকে বিশাল বড়লোক হওয়া। কারো থাকে উচ্চশিক্ষিত হওয়া। কারো বা আবার স্বপ্ন থাকে ফ্যাশন আইকন হওয়া। কিন্তু শুধু বলের পর বল করে যাওয়া কি কারো জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে? বল করাই কি কারো জীবনের একমাত্র নেশা হতে পারে? মুস্তাফিজকে দেখে এটা অনুধাবন করা যায়। এই ছেলেটা একেবারেই আলাদা। বাকি সবার থেকেই। অতি প্রশংসায় তিনি ভেজেন না। উজ্জ্বল আলোতে তাঁর চোখ ঝলসে যায় না। বিভিন্ন দেশ ঘুরেও প্রিয় তেঁতুলিয়া গ্রামে আসার জন্য যার ভেতরটা অস্থির হয়ে থাকে। বিত্ত-বৈভবের নেশা যাকে টানে না।
তিনি শুধুই বল করে যেতে চান। বাংলাদেশ, ভারত হয়ে ইংল্যান্ডের চেমসফোরড। হাতের বলটাকে নিজের ভাষায় কথা বলাতেই তাঁর যত আনন্দ। যে মাঠই হোক, যে প্রতিপক্ষই হোক, তাঁর যে কিছুই যায় আসে না! কারণ বল করে তিনি আনন্দ পান। এটাই তাঁর নেশা। জাগতিক কোন মোহ তাঁকে স্পর্শ করে না।
কতটুকু জানি আমরা মুস্তাফিজ সম্বন্ধে? “দ্যা ফিজ” হয়ে ওঠার আগের মুস্তাফিজ সম্পর্কে আমাদের জানার পরিধি আসলে কতটুকু? চলুন, দেখে নেই মুস্তাফিজ সম্পর্কে সাধারণ্যে কিছু অজানা তথ্যঃ
১। বাংলাদেশ দল যখন ১৯৯৯ এর বিশ্বকাপে খেলে, তখন মুস্তাফিজের বয়স কত ছিল জানেন? মাত্র সাড়ে তিন বছর! তাঁর জন্ম ১৯৯৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর।
২। মুস্তাফিজকে আমরা বাঁহাতি বোলার হিসেবে জানি। তিনি আমাদের “কাটার মাস্টার।“ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, শুরুর দিকে কিন্তু তিনি একজন ব্যাটসম্যান ছিলেন! যখন টেপ টেনিস বলে ক্রিকেট খেলতেন, পুরোদস্তুর টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে বোলিং এ সিরিয়াস হন তিনি। বাকিটা ইতিহাস।
৩। মুস্তাফিজের আজকের “দ্যা ফিজ” হয়ে ওঠার পিছনে বড় অবদান তাঁর বড় ভাই মোখলেসুর রহমানের। মুস্তাফিজ সবসময়ই তাঁর এই বড় ভাইয়ের কথা বলে এসেছেন তাঁর ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই। মোখলেসুর প্রতিদিন সকালেই মুস্তাফিজকে তাঁর বাইকের পিছনে বসিয়ে ৪০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ট্রেনিং এ দিয়ে আসতেন।
৪। মুস্তাফিজ এর ফার্স্ট ক্লাস ডেব্যু হয় ২০১৪ সালের এপ্রিলে। খুলনা বিভাগের হয়ে তিনি খেলেছিলেন ঢাকা বিভাগের বিপক্ষে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মতো আলো ঝলসানো ছিল না তাঁর এই অভিষেক। পুরো ম্যাচে মাত্র ১ টি উইকেট লাভ করেছিলেন তিনি।
৫। মুস্তাফিজ সর্বপ্রথম নজরে আসেন তাঁর এলাকায় অনুষ্ঠিত একটি অনুর্ধ্ব-১৭ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট এ। এরপর তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম এর একটি ফাস্ট বোলিং ক্যাম্পে তিনি ট্রায়াল দেন।
৬। মুস্তাফিজের সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্র “স্লোয়ার অফকাটার” নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। তিনি যখন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্যাম্পে ছিলেন, তখন একদিন প্র্যাক্টিসের সময় এনামুল হক বিজয় তাঁকে স্লোয়ার অফকাটার করতে বলেন। তো মুস্তাফিজ সেই বল করা মাত্রই এনামুল আউট হয়ে যান। এর পর থেকেই তিনি স্লোয়ার অফকাটার নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। যার ফলাফল এখন আমাদের সামনেই দৃশ্যমান। খুব সাধারণ একটি দৃশ্য এখনঃ মুস্তাফিজ বল করলেন। কাটার হলো কি হলো না বোঝা গেল না। ব্যাটসম্যানের ব্যাটে লেগে চকিতে বল উঠে গেল আকাশে। কিংবা অফস্ট্যাম্প উড়ে গেল। ব্যাটসম্যানের হতভম্ব চাহনি।
৭। তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকটাও একেবারে আলাদা। তাঁকে যখন পাকিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টি-২০ ম্যাচে স্কোয়াডে রাখা হলো, অনেকেরই চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। জনমনে প্রশ্ন ছিল, কে এই মুস্তাফিজুর রহমান? কবে থেকে খেলেন? বেশিরভাগ মানুষই তাঁকে চিনতো না। চিনলো সেই ম্যাচ শেষ হওয়ার পর। ৪ ওভার বল করে মাত্র ২০ রান দিয়ে ২ উইকেট নেওয়ার পর। উইকেটগুলো ছিল শহীদ আফ্রিদি আর মোহাম্মদ হাফিজের। এই ম্যাচের পারফরম্যান্সই ভারত সিরিজে তাঁর দলে আসার রাস্তা খুলে দিল। এরপরে কি হয়েছে, তা আর এখানে বলছি না। পুরো পৃথিবী এখন তা জানে।
৮। জিম্বাবুয়ের ব্রায়ান ভিটরির পর মুস্তাফিজই একমাত্র বোলার, যিনি তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম দুই ওয়ানডেতেই ৫ বা তার বেশি উইকেট লাভ করেছেন। এত বছরের ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে এই রেকর্ড এই দুইজন ছাড়া আর কারো নেই। মজার ব্যাপার হলো, ব্রায়ান ভিটরির এই রেকর্ডটি আবার বাংলাদেশেরই বিপক্ষে!
৯। ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে মুস্তাফিজই একমাত্র বোলার, যিনি তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম ৩ ওয়ানডেতেই ১৩ টি উইকেট লাভ করেছেন। আমরা তাঁর মধ্যে ওয়াসিম আকরাম কিংবা চামিন্দা ভাসের ছায়া খুঁজি। কিন্তু মজার ব্যাপার এটাই যে তাঁদেরও এই রেকর্ড নেই। এই বিরল রেকর্ড ক্রিকেট ইতিহাসের আর কোন রথী-মহারথী বোলারেরই নেই।
১০। প্রত্যেক বোলারেরই একজন আদর্শ থাকে। যাকে অনুসরণ করে তাঁরা বোলিং করার চেষ্টা করেন। মুস্তাফিজের বোলিং এর এই আদর্শ হলেন পাকিস্তানের পেসার মোহাম্মদ আমির। অনেকের কাছেই বিষয়টা খারাপ লাগতে পারে এইজন্য যে আমির স্পট ফিক্সিং এর দায়ে নিষিদ্ধ ছিলেন ৫ বছর। যদিও তিনি বর্তমান সময়ের অসামান্য প্রতিভাবান একজন পেসার। কিন্তু মুস্তাফিজের কাছে প্রাধান্য পেয়েছেন শুধুই “বোলার” আমির। “স্পট ফিক্সার” আমির নন। মোহাম্মদ আমিরও মুস্তাফিজের একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত। বিভিন্ন ইন্টারভিউ বা অন্যান্য জায়গায় সুযোগ পেলেই মুস্তাফিজকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন আমির। শুভকামনা জানিয়েছেন।
আপাতত মুস্তাফিজ ইংল্যান্ডে গিয়ে তার ক্যারিশমা দেখাচ্ছেন সাসেক্সের হয়ে। এগিয়ে চলুক আমাদের লিটল টাইগার।
লেখক সম্পর্কেঃ ইশফাক জামান। পেশায় প্রকৌশলী, নেশায় কবি ও লেখক। শখ কবিতা লেখা, ফিচার লেখা, অনুবাদ করা। বিভিন্ন অনলাইন (অফলাইন ও) ম্যাগাজিনে লেখালেখি করছি বেশ কয়েক বছর।