আমি লোকাল বাসের একজন মহিলা যাত্রী বলছি….

আজ একটা স্পর্শকাতর ঘটনা সবার সাথে শেয়ার করবো। ঘটনাটি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। অনেক মেয়েই হয়তো এই কথাগুলো শেয়ার করে না। কিন্তু আমি মনে করি সমস্যাকে প্রকাশ না করলে তার সমাধান সম্ভব নয়। তাই আজ মুখ ফুটে বলা…

প্রতিদিন কাজের জন্য বা নিজের পড়ালেখার জন্য ঘর থেকে বের হতেই হয়। অন্য আর সব মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের মতো আমিও লোকাল বাসেই আসা যাওয়া করি, যেখানে মেয়েদের জন্য জাতীয় সংসদের মতই কিছু মহিলা আসন সংরক্ষিত থাকে!!! ইঞ্জিনের চরম উত্তাপের উপর সীমাহীন সহ্য ক্ষমতা নিয়ে বসে থাকতে হয় আমাদের, মানে মেয়েদের!!! তার চেয়ে অসহ্য বিষয় হচ্ছে ইঞ্জিনের মেয়েদের সিটের ঠিক উপরেই থাকে হোল্ডার যেটা আঁকড়ে ধরেই অনেক পুরুষ যাত্রি মেয়েদের মুখের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে থাকেন!!! আমাকেও অনেক সময় বাকী অনেকের মতই সেই ইঞ্জিন সিটগুলোর উপর বসতে হয়!!!

অন্য অনেকদিনের মতই সেদিনও ইঞ্জিনের উপর বসার জায়গা পাই। একেবারে ইঞ্জিন প্রান্তে,  দরজার কাছেই। সামনে পুরুষ যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকাই বাধ্য হই পা একপাশে সরিয়ে রাখতে। খেয়াল করলাম, আমার সামনেই একজন ৩৫ বা ৪০ বছর বয়সী শার্ট-প্যান্ট পড়া লোক দাঁড়িয়ে আছে যার পেটের উপরেই হাত দিয়ে জ্যাকেট ধরা!!! যদিও শীতকাল, জ্যাকেট গায়ে না পড়ে হাতে রাখার মানেটা ঠিক বুঝলাম না।

কিছুক্ষণ পর বাসে মানুষ বাড়তে শুরু করায় লোকটি মেয়েদের দিকে আরো সরে আসে। দূরে করে দাঁড়াতে বলায়, সে উত্তর দিলো, পিছনে বেশি মানুষ থাকায় তার পক্ষে সরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়!!! বাসের আর কারো সমর্থন না পাওয়ায় আমিও আর কথা বাড়ালাম না। বাস চলতে শুরু করে।

হঠাৎ কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম, আমার পাশে কিছু একটা আমার শরীরের সাথে বারবার লাগছে বা লাগানো হচ্ছে! নিজের গা গুলিয়ে উঠলো! পাশে তাকিয়ে দেখলাম, লোকটার জ্যাকেটটা আর পেটের উপর নেই। হাতটা সরে গেছে। এবং সে তার গোপনঙ্গ কোনোভাবে প্যান্টের ভিতর থেকে আমার শরীরে লাগানোর চেষ্টা করছে! আমার ধারণা লোকটা সেদিন আন্ডারওয়ারই পড়েনি! বাসের ঝাঁকুনিতে সে বার বার আমার দিকে ঝুকে আসছিলো!

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আশেপাশের কাউকে কিছু বলতে পারছিলাম না। কি বলবো,  তাই তো মাথায় আসছিলো না!

অগত্যা কিছু করার উপায় না পেয়ে, নিজের ভ্যানিটিব্যাগ যেটা আমার কোলের উপর ছিলো, তা একপাশে রেখে লোকটা এবং আমার মাঝে একটা দেয়াল করার চেষ্টা করলাম। যদিও সে অনেক চেষ্টা করেছে, ব্যাগটা সরানোর, কিন্তু আমি শক্ত করে ধরে রাখায়, লোকটি সফল হতে পারেনি। পুরোটা রাস্তা আমাকে এভাবেই থাকতে হয়েছে! ভয়ে পুরো জমে গিয়েছিলাম আমি!

পরবর্তীতে বান্ধবীদের সাথে বিষয়টা শেয়ার করার পর জানলাম, তারাও এধরনের ঘটনার শিকার হয়েছে! কিন্তু কিছুই বলার সাহস পায়নি। সবার একই প্রশ্ন,  কি বলবো? কিভাবে বলা যায়! আসলেই একজন মেয়ের পক্ষে কিভাবে সবার সামনে এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা সম্ভব! বরং নিজের মান সম্মান হারানোর ভয়ে মেয়েরা চুপ করে থাকেন। আমার মতো কেউ কেউ কৌশলের আশ্রয় নেয়। আর বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ভাবেন, যাক বাবা! এ দফায় বাঁচা গেল!

আমি শুধু আজ নিজের একটি ব্যক্তিগত বিড়ম্বনা তুলে ধরলাম। মেয়েদের এমন হাজারো বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় প্রতিদিন। কখনও সেটা বাসে উঠা নিয়ে, কখনও বাসে সিট পাওয়া নিয়ে, কখনওবা সিট পাওয়ার পর নিশ্চিন্তে গন্তব্যে পৌছা নিয়ে! অনেক সময় বাসে সিট না পাওয়ার কারণে মেয়েদের ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, হয়তো দেখা যায়, মেয়েদের জন্য বরাদ্দ সিটগুলো পুরুষদের দখলে! অনেকবার দেখেছি, বাসের হেল্পার যখন পুরুষদের মহিলা সিট ছেড়ে দিয়ে মহিলাদের জায়গা দিতে বলে, তখন ঐ পুরুষরাই তেড়ে আসে হেল্পারকে আক্রমণ করতে! তাদের যুক্তি তারা আগে উঠেছে, তাই তারা বসে যাবে। এখন যদি বলি তাহলে মেয়েরা দাঁড়িয়ে যাক, তাতেও তাদের আপত্তি। তখন তাদের পিতৃসত্ত্বা জেগে উঠে! মেয়ে মানুষ,  দাঁড়িয়ে যাবে কেন? তাহলে সমাধান কি? তাদের ভাষায় সমাধান হচ্ছে, মেয়েদের বাসে তোলার দরকার কি? বাসে না তুললেই হয়!

এখন আমার প্রশ্ন, আপনারা মেয়েদের বসার জায়গা দিবেন না, দাঁড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ দিবেন না, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারা আপনাদের চলে যাওয়া দেখবে,  তাহলে তারা গন্তব্যে পৌছাবে কেমন করে? এখন আপনারা বলবেন, মেয়ে মানুষ ঘর থকে বের হওয়ার দরকারই বা কি! সমস্যা মেয়েদের, আর সমাধান দাতা সবসময় পুরুষ! অথচ, এই পুরুষই কখনও বাবা, আবার কখনও বাসে মহিলাদের সহযাত্রী! একজন পুরুষ যদি এটুকু ভাবে যে, তার মেয়ে বা বোন আর সব মেয়েদের মতই বাসে যাওয়া আসা করে, তবে হয়তো পরিস্থিতিটা অনেক সুন্দর হতো!

এখন কথা হচ্ছে, সমস্যাটা তো বুঝলাম, এর সমাধান কি? মেয়েরা কি গাড়িতে চড়াই ছেড়ে দিবে? অনেকে বলবেন, বাসে মেয়েদের জন্য আসন বাড়ানো উচিত। কেউ কেউ বলবেন, শুধু মহিলাদের জন্য আলাদা বাস নামানো উচিত। যদিও ঢাকায় ৭টি এবং চট্টগ্রামে ৩টি এধরনের বাস চালু আছে বলে শুনেছি, কিন্তু এখনও পর্যন্ত চড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি! আবার কারো উপদেশ থাকবে, বাসে মেয়েদের বসার স্থান আর ছেলেদের বসার স্থানে প্রতিবন্ধকতা থাকা উচিত।

না, আমি এতো উপদেশ দিবো না। শুধু বলবো, মানসিকতার পরিবর্তন করুন। ছেলে এবং মেয়ে উভয়েরই! অনেকে বলবেন, ছেলেদের মানসিকতার পরিবর্তন তো বুঝলাম, মেয়েদের কেন? কারন অনেক সময়,  বাসে মহিলা সিট ফিল আপ হয়ে যাওয়ার পর, মহিলা যাত্রিরাই বলে উঠে, “আর মহিলা নিয়েন না!” আবার অনেক সময় কোনো মহিলা যাত্রি উঠে পড়লেও, ৫জনের সিটে ৪জন দখল করে রাখে! অনেকবার অনুরোধ করার পরও জায়গা করে দিতে রাজি হন না। তাই মহিলাদের বলছি, ‘ আপনার যেমন নিজের গন্তব্যে সঠিক সময়ে পৌছানো জরুরি, ঠিক তেমনি রাস্তায় গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকা অন্য মহিলাদেরও ব্যাপারটা সমান অথবা বেশি জরুরি। তাই বুঝুন। সহানুভূতিশীল হতে শিখুন, নিজের প্রতি এবং অন্যের প্রতি।

আর ছেলেদের বলছি, এমন নয় যে, একজন মহিলা গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছে, আপনি গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে তাকে জায়গা করে দিবেন। কিন্তু আপনি যদি মহিলা সিট দখল করে থাকেন, তবে উঠে দাঁড়ান। আর যদি অন্যকে দখল করে থাকতে দেখেন, তবে তাকে জায়গা দিতে বলুন। যদি কোনো মহিলা দাঁড়িয়ে থাকে, বলছি না, তার জন্য নিজের সিট ছেড়ে দিন। শুধু এটুকু করুন, নিজের ব্যবহারে এটুকু প্রকাশ করুন যে, তাকে আপনার পাশে বা সামনে দাঁড়ানোর জন্য অন্তত আপনার কাছ থেকে বিব্রত কিছুর সম্মুখীন হতে হবে না। বিব্রত কোনো ব্যবহার অথবা বিব্রত কোনো টিপ্পনী, কোনো কিছুই নয়। আর কিছু না পারুন, অন্তত মুখের ভাষাটা সংযত রাখুন।

২০১৭ সালের প্রারম্ভে দাঁড়িয়ে যখন আমরা নারী পুরুষ সমান অধিকারের কথা বলছি, তখন আমি বলবো না, মেয়েরা অবলা। এতে বরং মেয়েদেরই সম্মানহানি হয়। কিন্তু একথাও সত্যি, পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে পুরুষের সহযোগিতা ছাড়া মেয়েদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা অসম্ভব। তাই বাসে মেয়েদের প্রতি সংযত আচরণ প্রকাশ করুন এবং আপনার পাশেরজনকে কোনোরূপ অশ্লীল আচরণ করা  থেকে বিরত রাখুন…..

ধন্যবাদ…