মুভি, নাটক বা গল্পের কল্যাণে সবাই একিলিসের কথা আমরা জেনে গিয়েছি। কে ছিল এই একিলিস? সে কি আদৌ ইতিহাসের অংশ নাকি গ্রীক মিথলজির কাল্পণিক বীরদেরই একজন?
এই প্রশ্নে ঢোকার আগে প্রথমেই একিলিস সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাক। একিলিস হচ্ছে মরণশীল রাজা পিলিয়াস এবং সমুদ্র শঙ্খিনী থেটিসের সন্তান। তার জন্মের পর সে একটা প্রফেসি পেল। সেখানে এমনটা বলা হয়েছে যে সে খুব সাধারণ জীবন যাপন করে বৃদ্ধ বয়সে মারা যাবে নয়তো মারা যাবে খুব অল্প বয়সে বীরের মত। দুশ্চিন্তিত হয়ে পড়ল তার মা থেটিস। ভাবতে লাগল কিভাবে অমর করে নেয়া যায় একিলিসকে। শেষ পর্যন্ত একটা বুদ্ধি বের করল। তাকে চুবিয়ে আনল স্টিক্স নদীতে। বলা হয় স্টিক্স নদীতে গোসল করতে পারলে শরীর অভেদ্য হয়ে পড়ে। একিলিসের শরীরও অভেদ্য হয়ে পড়ল। পুরোপুরি অমর নয় যদিও। তবে থেটিস তাকে নদীতে চুবানোর সময় গোড়ালিতে খুব শক্ত করে ধরেছিলেন। ফলে সে অংশটুকু রয়ে গেল খুব দুর্বল।
থেটিস এরপরে তাকে মেয়ে সাজিয়ে তাকে পাঠিয়ে দিলেন ঈজিয়ান দ্বীপের স্কিরোসে। কিন্তু একিলিসের ভাগ্য ছিল সে যোদ্ধা হবে। সুতরাং একসময় সে যোগ দিল গ্রীক সৈন্যদলে। থেটিস আর কোন উপায় না পেয়ে কামারদেব হেফাস্টাসকে দিয়ে তলোয়ার আর বর্ম বানিয়ে দিলেন ছেলেকে। ট্রয়ের যুদ্ধে সে প্রচুর সাহসীকতার সাথে লড়াই করেছে। ট্রয়ের সেনাপতি এবং যুবরাজ হেক্টরকে বধ করেছে এই একিলিসই। তবে তার শেষটা খুব শোচনীয়। ট্রয়ে হামলার সময় নিষ্কর্মা প্যারিস তীর মারে একিলিসকে লক্ষ্য করে। আর সেটা গিয়ে বিধে তার গোড়ালিতে। তার গোড়ালি অভেদ্য ছিলনা। সুতরাং অল্প আঘাতেই মারা পড়ে বীর একিলিস।
পৌরাণিক অংশ বাদ দিয়ে হলেও একিলিস বাস্তব কিনা তা ধারণা করতে গেলে প্রথমেই ট্রয়ের যুদ্ধের ব্যাপারে খানিক আলোকপাত করে নিতে হবে। ট্রয়ের যুদ্ধ গ্রীক মিথে খুব বিখ্যাত এক কাহিনী। গ্রীক কবি হোমারের অমর মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ এবং ‘অডিসি’র কল্যাণে এই যুদ্ধ স্থায়ী এক রূপ প্রাপ্ত হয়েছে যেন। হোমারের ইলিয়াডে বলা হয়েছে দীর্ঘ দশ বছর চলেছে গ্রীক আর ট্রোজান বাহিনীর মধ্যকার এই যুদ্ধ।
দেবরাজ জিউস একদিন আহারাদি সম্পন্ন করে ঢেকুর তুলে ভাবলেন এবার পৃথিবীর জনসংখ্যা কিছুটা কমানো যাক। এত গিজগিজে জনসংখ্যা তার খুব একটা পছন্দ হচ্ছেনা আর। তাই বলে তো তিনি বজ্র বা ঝড় বন্যা দিয়ে মানুষ মেরে নিজের উপর দোষ চাপাতে পারেন না। দরকার একটা সূক্ষ্ম পরিকল্পণা। এর মাঝে পিলিয়াস আর থেটিসের বিয়ের অনুষ্ঠান সামনে। জিউস ভাবতে বসলেন কি করা যায়। বিয়েতে মৃদু একটা গন্ডগোল লাগানোর পর তা শেষ হল একটা সুন্দরী প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে।
জ্ঞানদেবী এথেনা, বিয়ে ও পরিবারের দেবী হেরা আর ভালবাসার দেবী আফ্রোদিতির মাঝে ঝগড়া লাগল কে বেশি সুন্দরী তা নিয়ে। দেবরাজ তাদের পাঠালেন প্যারিসের কাছে, যে হচ্ছে ট্রয়ের যুবরাজ। যদিও যখন এ প্রতিযোগিতা চলছে তখন সে নিজেও জানত না যে সে রাজকুমার। প্যারিসও দেবীদের মধ্য থেকে কে বেশি সুন্দর তা বের করতে পারল না। তখন দেবীরা তাকে ঘুষ দেয়ার প্রস্তাব করল। আফ্রোদিতির প্রস্তাবনা ছিল, যদি তাকে জিতিয়ে দেয়া হয় তবে প্যারিসের কপালে জুটবে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে হেলেনের ভালবাসা। প্যারিসের আর কিচ্ছু শুনতে হল না। সে এক বাক্যে ঘোষণা দিল আফ্রোদিতিই সবচেয়ে সুন্দরী।
এর পরে নানান কাহিনী হল। যুবরাজ প্যারিস নিজের পরিবারের সাথে মিলিত হল। এবং অবশ্যই স্পার্টার রাজা মেনেলাউসের স্ত্রী হেলেনের ভালবাসাও পেল। শুধু তাই না সে একসময় রাণী হেলেনকে স্পার্টা থেকে অপহরণ করে ট্রয়ে নিয়ে চলে আসল। ফলে যা হবার তাই। জিউস উপর থেকে একটা তৃপ্তির হাসি দিল। আর একটা প্রলয়ংকারী যুদ্ধ লেগে গেল গ্রীক আর ট্রোজানদের মধ্যে। যা কিনা চলল টানা দশ বছর যাবৎ। শেষে গ্রীকরা চতুরতার আশ্রয় নিল। একটা বিশাল কাঠের ঘোড়া বানিয়ে সেটা ট্রয়ের ফটকে রেখে আসল তারা। ট্রোজানরা ভাবল গ্রীকরা বোধহয় যুদ্ধে ক্ষান্তি দিয়ে তাদেরকে উপহার স্বরূপ ঘোড়াটা দিয়ে গেছে। কিন্তু কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে ঘোড়াটার ভেতরে আসলে গ্রীকদের সেরা যোদ্ধারা লুকিয়ে ছিল। ট্রোজানরা তাদের শহরের ভেতর নিয়ে গেল এই ট্রোজান হর্স। আর রাতের আধারে সেখান থেকে বের হল মূর্তিমান গ্রীকরা। এবং ধ্বংস করল ট্রয় নগরী। আর এই দশ বছর দীর্ঘ যুদ্ধে জনসংখ্যা যে বিপুল কমেছে তা তো বলাই বাহুল্য। আমাদের একিলিস যে এই জনসংখ্যা কমানোয় খুব ভাল ভূমিকা রেখেছে তাও নিশ্চয়ই বলতে হবেনা। একিলিস গ্রীক শিবিরের হয়ে ট্রয়ের যুদ্ধে লড়েছে।
এখন কথা হচ্ছে এই ট্রয় কি বাস্তব ছিল? নাকি পুরোটাই কল্পগাঁথা? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে গবেষকদের শরণাপন্ন হতে হবে। গবেষকরা ধারণা করেন বর্তমানে তুরস্কের হিসারলিক নামক জায়গাটাই প্রাচীন ট্রয় নগরী। জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ এবং প্রত্নতত্ত্ববিদ এরিক ক্লিনের মতে ট্রয়ের যুদ্ধের মত কিছু একটা সত্যিই ঘটেছিল সে সময়। তবে তিনি বলেন এখানে একক কোন যুদ্ধ নয়, বরং দীর্ঘ সময়ের মাঝে একাধিক ছোট ছোট যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। কবি হোমার কল্পণার আশ্রয় নিয়ে সবগুলোকে একত্র করে হয়তো দশ বছর লম্বা এক যুদ্ধের গল্প বলেছেন। হোমার তার কাব্য লিখেছেন খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম বা নবম শতাব্দীতে। আর ট্রয়ের যুদ্ধগুলো কমপক্ষে আরো চারশ বছর আগে ঘটেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
তুরস্কের উত্তর দক্ষিণাঞ্চলে ১৮৭০ সালে হেনরিক শ্লিম্যান খনন কাজ চালান। এটিকেই ট্রয় নগরী বলে ধরা হয়। তবে হিসারলিকে এই খনন কাজে শহরটির প্রায় নয়টি স্তর পাওয়া যায়। শহরের মাঝে একটা দূর্গ যার চারপাশে রয়েছে বিভিন্ন দালান। এর মাঝে ষষ্ঠ বা সপ্তম স্তরের ধ্বংসাবশেষের সময়কালই ট্রয়ের যুদ্ধের সাথে মেলে। কিন্তু খননের পর দেখা গেল ষষ্ঠ স্তরটা হোমারের বর্ণনার মত বিশাল হলেও এর সমাপ্তি কোন যুদ্ধের মাধ্যমে ঘটেনি। এর পতন হয়েছিল বরং ভয়াবহ এক ভূমিকম্পের মাধ্যমে। আবার সপ্তম স্তরের পতনে বড় কোন যুদ্ধই দায়ী ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এটি হোমারের বর্ণনামত এত বিশাল বা জাঁকজমকপূর্ণ নয় মোটেও।
তবে ষষ্ঠ স্তর নিয়ে একটা কথা আছে অবশ্য। কবিতায় কখনোই প্রায় মূলভাব সরাসরি প্রকাশ করা হয়না। হতে পারেনা কি যে হোমারও হয়তো কোন মেটাফোর ব্যবহার করেছেন? আমরা ইতোমধ্যেই জানি ট্রয়ের পতন কিভাবে হয়েছে বলে হোমার বলেছেন। একটা বিশাল কাঠের ঘোড়ার মাধ্যমে। এখন আমরা একটু ভাবি। গ্রীক পুরাণ মতে সমুদ্র, ঝড় আর ভূমিকম্পের দেবতা হলেন পসাইডন। আর পসাইডনকে বলা হয় ঘোড়ার রক্ষক। অর্থাৎ এখানে হোমার যদি ঘোড়াটাকে প্রতীকী হিসেবে উপস্থাপন করেন তাহলে কি একটা মেটাফোর পাওয়া যাচ্ছেনা? এটি দিয়ে হয়তো ভূমিকম্পের কথাই বোঝানো হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তারপরেও প্রচুর দ্বিধা রয়ে যায়। কারণ কোনটা সম্পর্কেই পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়না। দশ বছর যাবৎ দীর্ঘ যুদ্ধের যেমন কোন চিহ্ন নেই। তেমনি হিসারলিকে পাওয়া রত্নগুলো, যা মনে করা হত হেলেনের, আবিষ্কৃত হয়েছে তা আসলে সে সময়ের চেয়েও হাজার বছরের প্রাচীন।
তো এখন প্রশ্ন হচ্ছে একিলিস কি আসলেই ছিল? বা এই ট্রয় নগরীও কি সত্যিকার অর্থেই ছিল? সত্যি বলতে এর উত্তর নিশ্চিতভাবে দেয়া একদমই সম্ভব না। হয়তো একিলিস সত্যিই একজন বীর ছিল। হিসারলিকে হয়তো জমজমাট ট্রয় নগরী ছিল একসময়। সত্যিই হয়তো গোড়ালিতে আঘাত নিয়ে মারা গিয়েছিল একিলিস। কিংবা হতে পারে পুরোটাই হোমারের কল্পণা। পাঠক আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন কোনটা বিশ্বাস করবেন!