‘বিমান’ বর্তমান যুগের আধুনিক এবং দ্রুততম পরিবহন ব্যবস্থা। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বা এক দেশ থেকে অন্য দেশে অল্প সময়ে দ্রুত যাতায়াতের জন্য মানুষ দিন দিন বিমানের উপর নির্ভশীল হয়ে পড়ছে। একসময় বিমানকে নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা বলা হলেও বর্তমান সময়ে এসে তা আর বলা যাচ্ছে না। চলতি কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বিমান নিখোঁজ আর বিধ্বস্তের ঘটনা ঘটেছে। হঠাৎই কোন কারন ছাড়া বিমান নিখোঁজ হয়ে পড়ছে। বিমানের কন্ট্রোল প্যানেল থেকে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কখনও হারানো বিমান ফিরে এসেছে নিরাপদে। কখনও হারিয়ে গেছে চিরতরে। হারানো বিমানের খোঁজে আশা আর আতঙ্কের দোলাচলে সময় কাটাতে থাকে যাত্রী বা বিমানকর্মীদের আত্মীয়স্বজন। আপনাদের এমন কয়েকটি নিখোঁজ বিমানের সত্যিকার ঘটনা জানাব যার হদিশ এখনো মেলেনি। রয়েই গেছে রহস্য। কখনও বা উদ্ধার হয়েছে ধ্বংসাবশেষ। এমনই কয়েকটা ঘটনা, যা আলোড়ন তুলেছে নানান সময়ে।
১. ফ্লাইট নম্বর ৩৭০, মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স
রহস্যজনক ভাবে ২০১৪ সালের ৮ মার্চ স্থানীয় সময় ১২ টা ৪১ মিনিটে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে চিনের বেজিং যাওয়ার পথে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৭৭ এর এমএইচ ৩৭০ বিমানটি নিখোঁজ হয়। এই বিমানে প্রায় ২২৭ জন যাত্রী এবং ১২ জন ক্রু ছিলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক সময়ের মধ্যে বিমানটির সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে নিয়ন্ত্রণকক্ষ। তারপর থেকে বিমানটির কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। কোথায় গেল ২৩৯ জন আরোহী নিয়ে বিমানটি? তা আজো রহস্য। প্লেনটি অস্ট্রেলিয়ার কাছে ভারত মহাসাগরে ভেঙে পড়েছে বলে বিশ্বাস অনেকের। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে- এমন মিথও প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু, এর পক্ষে জোরদার কোনও প্রমাণ মেলেনি।
২. মিশরের এয়ার ফ্লাইট-৯৯০
অনেকের ধারণা মিশরের এয়ার ফ্লাইট-৯৯০ এর বিমানটি ইচ্ছা করেই পাইলট ধ্বংস করে । দুই পাইলটের রেষারেষিতে জীবন দিতে হয় ২১৭ জন যাত্রীর সবাইকে। সময়টা ১৯৯৯ সালের ৩১ অক্টোবর। যুক্তরাষ্ট্রের জন এফ কেনেডি বিমান বন্দর থেকে মিশরের রাজধানী কায়রোর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে বিমানটি। কিন্তু আটলান্টিক মহাসাগরে বিধ্বস্ত হয় প্লেনটি। সলিল সমাধি হয় সকল যাত্রীদের প্রাণ। বিমানটির সহকারী পাইলট জামিল আল বতুতী, যৌন অশোভন আচরনের দায়ে পাইলট প্রধান হাতেম রুশদী কর্তৃক কঠোরভাবে তিরস্কৃত হন। মনে করা হয় চাকুরি হারানোর ভয়ে এবং প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে জামিল বিমানটিকে ঢুকিয়ে দেয় আটলান্টিকের অথৈ জলরাশির ভিতর। একজন পাইলটের জিঘাংসার শিকার হয় বিমানটি । ফলশ্রুতিতে কেড়ে নেয় ২১৭ জন যাত্রীর প্রাণ।
৩. ফ্লাইট নম্বর এন এইট ৪৪ এএ
২০০৩ সালের ২৫ মে অ্যাঙ্গোলার লুমান্ডার কোয়ার্টো ডে ফেভেরেইরো বিমানবন্দর থেকে বিমানটি চুরি হয়। একটি ৭২৭-২২৩ বোয়িং বিমান ছিল। এই বিমানের খোঁজে সারা বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধান চালায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ও সিআইএ। অনুসন্ধানে জানা যায় যে, বিমানটি ছাড়ার অনেক আগে থেকেই দুই জন ব্যক্তি যাদের একজন ছিলেন আমেরিকান পাইলট ও ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার এবং অপরজন মেকানিক, ওই বিমানে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু, বিমান নিয়ে দু’জনে কোথায় উড়ে গিয়েছিল তা আজও জানা যায়নি। সে দুই ব্যক্তিরও কোন সন্ধান কেউ দিতে পারে নি।
৪. ফ্লাইং টাইগার লাইন ফ্লাইট ৭৩৯
১৬ মার্চ, ১৯৬২।
৯৩ জন মার্কিন সেনা এবং ভিয়েতনামের তিনজন নাগরিক নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ভিয়েতনামের সাইগনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল বিমানটি। প্রশান্ত মহাসাগরের উপরে উধাও হয় বিমানটি। ধারনা করা হয়, ওই বিমানে বিস্ফোরণ হয়েছিল। কিন্তু বিমানের কোনও অবশিষ্টাংশ না মেলায় তা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
৫. আন্তোনভ ৩২, ভারতীয় বায়ু সেনা
আন্তোনভ ৩২ ভারতীয় বায়ু সেনার একটি যুদ্ধ বিমান। সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে এই যুদ্ধবিমানটি কিনেছিল ভারতীয় বায়ুসেনা। ঘটনাটি ঘটে ২৫ মার্চ, ১৯৮৬। ঐ দিন গুজরাতের জামনগরের কাছে ভারত মহাসাগরের উপরে বিমানটি নিখোঁজ হয়ে যায়। বিমানে থাকা ৩ জন ক্রু এবং ৪ যাত্রীদের কারোই কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
৬. এয়ার ফ্রেন্স ফ্লাইট-৪৪৭
সময় ২০০৯ সাল। ২৮৮ জন আরোহী নিয়ে ব্রাজিলের রিওডি জেনিরিও থেকে ফ্রান্সের প্যারিসের উদ্দেশে যাত্রা করে এয়ার ফ্রেন্স ফ্লাইট-৪৪৭। পথে আটলান্টিকের বুকে হারিয়ে যায় বিমানটি। পরবর্তীতে আটলান্টিক মহাসাগর থেকে ৫০ জন যাত্রীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০১১ সালে বিমানের ব্ল্যাক বক্স রেকর্ডারটির সন্ধান পাওয়া যায়। সঙ্গে ১০৪টি মৃতদেহও। বাকি ৭৪টি মৃতদেহের সন্ধান মেলেনি আজও ।
৭. উরুগুয়ে ফ্লাইট ৫৭১
১৯৯৩ সালে উররুগুয়ের ফ্লাইট ৫৭১ বিমানটি বিধ্বস্ত হয় আন্দিজ পর্বতমালায় । ৪৫ জন আরোহীর মধ্যে ঘটনাস্থলেই মারা যায় ১২ জন। পরদিন মারা যায় আরো ৬ জন। এরপর মারা যায় আরো ৮ জন। কিন্তু বেঁচে যায় ১৬ জন। ৭২ দিন ধরে তাদের থাকতে হয়েছে ওই পর্বতে। কিন্তু কিভাবে বেঁচে ছিল তারা? কি খেয়ে নিজেদের সুস্থ রেখেছিল তারা? অদ্ভুত হলেও সত্য, খেয়েছে তাদের মৃত বন্ধুদের লাশ। এদের ২ জন দশ মাইল দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে এক চিলিয়ান ভদ্রলোকের সাক্ষাত পায়। সে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অবশেষে তাদের উদ্ধার করা হয়। গা শিউরে ওঠা ১৯৯৩ সালের কাহিনী যেন আজও জীবন্ত। ইতিহাসের সাক্ষী।
৮. ফ্লাইট নম্বর ৪০৪, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স
২৫ অগাস্ট,১৯৮৯। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনন্সের ৪০৪ নম্বর বিমানটি গিলগিট থেকে ইসলামাবাদের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু, বিমানটি ইসলামাবাদে পৌঁছায়নি। প্লেনটি যাত্রাপথের কোথায় নিখোঁজ হয় তা জানা যায়নি। তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালানোর পরেও বিমানটির কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। আজ রহস্যময় অন্তর্ধানের ইতিহাসে নাম তুলে রেখেছে ফ্লাইট নম্বর ৪০৪। বিমানটি নিখোঁজের সময়ে তাতে ৫৪ জন যাত্রী ছিল।
৯. যুক্তরাষ্ট্র ফ্লাইট-১৯১
১৯৭৯ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা ঘটে এসময়। শিকাগোর এক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সবেমাত্র বিমানটি উড়েছে ফ্লাইট-১৯১। কয়েক মিনিটের মাথায় বিমানবন্দরেই বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। মৃত্যুবরণ করেন ২৫৮ জন যাত্রী ও ১৩ জন ক্রুর সবাই।
১০. গারুডা ইন্দোনেশিয়া ফ্লাইট ৫৪২
৩ ফেব্রুয়ারি,১৯৬১।
গারুডা ইন্দোনেশিয়া ফ্লাইট ৫৪২ ইন্দোনেশিয়ার মাদুরা আইল্যান্ড থেকে বিমানটি উড়েছিল। কিন্তু এই যাত্রীবাহী বিমানটি আকাশে ওড়ার পর তার আর খোঁজ মেলেনি। বিমানের ৫ ক্রু এবং ২১ জন যাত্রীর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
১১. ইরানের এয়ার ফ্লাইট-৬৫৫
১৯৮৮ সালে ঘটনা এটি। ইরানের এয়ার ফ্লাইট-৬৫৫ ২৯০ আরোহী নিয়ে তেহরান থেকে দুবাই যাচ্ছিল। ধারনা করা হয় বিমানটি সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধবিমান ভেবে পারস্য উপসাগরে অবস্থিত মার্কিন নৌবাহিনীর ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয় এবং বিমানের আরোহীদের সবাই নিহত হয়।
১২. স্টার এড়িয়াল, ব্রিটিশ সাউথ আমেরিকান এয়ারওয়েজ (বিএসএএ)
ব্রিটিশ সাউথ আমেরিকান এয়ারওয়েজ (বিএসএএ) এর একটি বিমান হল স্টার এড়িয়াল । ১৯৪৯ সালের ১৭ জানুয়ারি বিমানটি রহস্যপুরী বার্মুডা ট্রায়াঙ্গালে হারিয়ে যায়। আবহাওয়া ছিল পরিস্কার। বিমানটিতে যান্ত্রিক কোন ত্রুটিও ছিল না। তারপরও ডুবে গেল প্লেনটি। এর পূর্বেও পরপর তিনটি বিমান একই জায়গায় বিধ্বস্ত হয়। শুরু হল তদন্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তদন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। “দূর্ঘটনার কারণ” অজানা।
লেখকঃ প্রকাশ কুমার নাথ