এমেলিয়া এয়ারহার্ট-১ম নারী পাইলট যিনি একা পাড়ি দিয়েছিলেন আটলান্টিক মহাসাগর

huffpost.com
huffpost.com

বিশাল এই পৃথিবীতে প্রতি পদক্ষেপে প্রতিটি নারীকে বাধা অতিক্রম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে একজন নারী তাদের নিজস্ব বাঁধা পেরিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, অসম্ভব বলে কিছুই নেই। শুধুমাত্র সাহস এবং ইচ্ছার বলেই সবকিছু জয় করা সম্ভব। তেমনি একজন মহীয়সী নারী ছিলেন আ্যমেলিয়া এয়ারহার্ট। যিনি ছিলেন প্রথম মহিলা বিমানচালক যিনি একাই পাড়ি দিয়েছিলেন আ্যটলান্টিক মহাসাগর।

১/ আ্যমেলিয়া এয়ারহার্ট ১৮৯৭ সালের ২৪শে জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পৃথিবীর ১৬তম নারী যিনি বিমানচালক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। ১৯২৮ সালে তিনি আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেন কোন সহকারী বিমানচালক ছাড়াই। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন সর্বপ্রথম বিমানচালক যিনি যুগপৎভাবে আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগর একা পাড়ি  দিয়েছিলেন।

২/ ১৯১৫ সালের কিছু পরে, গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়ার পর এক ক্রিসমাসে, আ্যমেলিয়া বেড়াতে যান কানাডার টরেন্টোতে। সেখানে তার বড় বোনের বাড়ি। সেখানে তিনি দেখতে পান প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত হয়ে ফিরে আসা সৈনিকদের। তিনি রেডক্রসের হয়ে আহতদের সেবাদানের জন্য নার্স হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং আহতদের সেবায় নিজেকে নিযুক্ত করেন। আ্যমেলিয়া সেখানে বহু আহত বিমানচালকদের সংস্পর্শে আসেন এবং তার মধ্যে এ নিয়ে আগ্রহ জন্ম নেয়। ১৯১৯ সালে তিনি মেডিকেল স্কুলে যোগ দেন কিন্তু একবছর পর তা ছেড়ে দিয়ে বাবামায়ের কাছে চলে আসেন ক্যালিফোর্নিয়াতে।

৩/ ১৯২০ সালে লং বিচ এয়ার শো তে আ্যমেলিয়া একটি এয়ারপ্লেন রাইডে অংশ নেন। মাত্র ১০ মিনিটের অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝতে পারেন, ঠিক এই কাজটাই তিনি চান। তিনি ঠিক করেন, তিনি বিমানচালনা শিখবেন। তিনি তার সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে বিমানচালনা শিখলেন পাইলট আনিটা স্নুক এর কাছে। ১৯২১ সালে তিনি একটি সেকেন্ডহ্যান্ড উজ্জ্বল হলুদ রঙের “Kinner Airster Biplane” কোম্পানির বিমান কেনেন। তার বিমানের নামকরণ তিনি করেন “দ্যা ক্যানারি”। ১৯২২ সালের অক্টোবরে তিনি তার বিমানকে নিয়ে যান ভূমি থেকে ১৪ হাজার ফুট উপরে, যা ছিলো মহিলা বৈমানিকদের ক্ষেত্রে বিশ্বরেকর্ড। ১৯২৩ সালের ১৫ই মে, “দ্যা ফেডারেশন আ্যরোনেটিক” আ্যমেলিয়া এয়ারহার্টকে বিশ্বের ১৬তম নারী বৈমানিকের লাইসেন্স প্রদান করেন। এভাবেই একের পর এক মাইলফলক অতিক্রম করতে থাকেন আ্যমেলিয়া এয়ারহার্ট।

৪/ ধীরেধীরে একজন দক্ষ বৈমানিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে থাকেন আ্যমেলিয়া। তিনি তার পেশাকে আরাধনার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সকলে তাকে একজন নির্ভীক, সৎসাহসী এবং বুদ্ধিমতী বলেই জানতেন। তিনি কখনো ভয় পেতেন না। যেকোন পরিস্থিতিতে তিনি থাকতেন শান্ত, বিভিন্ন অভিযানে তিনি প্রমাণ দিয়েছেন তার উপস্থিতবুদ্ধির। ১৯৩১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি জর্জ পাটন্যামের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জর্জ ছিলেন একাধারে লেখক, প্রকাশক এবং অভিযাত্রিক। ১৯৩২ সালের শুরুর দিকে আ্যমেলিয়া সিদ্ধান্ত নেন, তিনি একাই পাড়ি দিবেন আটলান্টিক মহাসাগর। চার্লস লিন্ডেনবার্গের আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার পঞ্চম বর্ষপূর্তিতে তিনি ঘোষণা করেন এ কথা। ১৯৩২ সালের ২০ই মে ভোরবেলা তিনি তার যাত্রা শুরু করেন।

৫/ যাত্রা শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বিপদের সম্মুখীন হন। আকাশে ছিলো ঘন কালো মেঘ, ঝড়ো বাতাস বইছিলো। ১২ ঘণ্টা পর অবস্থা আরো খারাপ হতে শুরু করে। বিমানে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয়। যদিও তার গন্তব্যস্থান ছিল প্যারিস, তিনি ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং করার সিদ্ধান্তগ্রহণ করেন। তিনি নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের ছোট্ট একটি শহর কালমোরে ল্যান্ড করেন। ২২ই মে তিনি লন্ডনের হ্যানওয়র্থ এয়ারফিল্ডে পৌছান এবং সকলে তাকে সম্মানের সাথে স্বাগত জানায়। তার এই ঐতিহাসিক ১৫ ঘন্টার যাত্রা রাতারাতি থাকে “International Hero” এর খ্যাতি এনে দেয়।

৬/ এছাড়া আরো বহু অভিযানে আ্যমেলিয়া তার দক্ষতার প্রমাণ দেখিয়েছেন। তিনি সহকারী পাইলট ছাড়া একাই গিয়েছেন হনলুলু থেকে ক্যালিফোর্নিয়া। তার এই ফ্লাইট তাকে প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বের প্রথম বৈমানিক হিসেবে যে কিনা একাই পাড়ি দিয়েছিলো আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগর। ১৯৩৫ সালের এপ্রিলে তিনি লস আ্যঞ্জেলস থেকে যাত্রা করেন মেক্সিকো শহরে। এর একমাস পর তিনি আবার যাত্রা করেন লস মেক্সিকো থেকে নিউ ইয়র্কে। একের পর এক দুর্দান্ত অভিযানের মাধ্যমে আ্যমেলিয়া নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন একজন দক্ষ অকুতোভয় বৈমানিক হিসেবে। এভাবে খ্যাতির শীর্ষে পৌছে যান আ্যমেলিয়া এয়ারহার্ট। এই ১৯৩৫ সালেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন বিশ্ব জয় করার।

৭/ ১৯৩৭ সালের ১৭ই মার্চে বিশ্বভ্রমণের উদ্দেশ্যে তিনি যাত্রা করেন হাওয়াই দ্বীপের উদ্দেশ্যে। সাথে ছিলেন সহকারী বৈমানিক পল মান্টজ। কিন্তু যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে তিনি বিমানের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। যার কারণে ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং করতে হয়। বিমানটিকে পাঠানো হয় কারখানায়। জুন মাসে তিনি আবার মায়ামিতে যান, তার বিশ্বভ্রমণের যাত্রা শুরু করতে। তখন তার সাথে ছিলেন পাইলট ফ্রেড ন্যুনান। কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি যোগাযোগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ফেলে রেখে চলে যান। অনেকের ধারণা, যেহেতু বিশ্বভ্রমণ একটি লম্বা সময়ের ব্যাপার, তিনি বিমানচালনার জন্য অতিরিক্ত জ্বালানি মজুদ করে রাখার জায়গার জন্য সে সকল যোগাযোগমাধ্যম ফেলে রেখে গেছেন। দীর্ঘ ২১ দিনের যাত্রায় তারা নিউগিনি পৌছান। সেসময় আ্যমেলিয়া ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন। তাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল ছিলো ছোট্ট হওল্যান্ড আইল্যান্ড, যা প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝামাঝি অবস্থিত। ২ জুলাই, ১৯৩৭, আ্যমেলিয়া এবং ফ্রেডের কথা হয় তাদের নিকটবর্তী কোস্ট গার্ড শিপের রেডিও অপারেটরের সাথে। পৃথিবীর সাথে সেটাই ছিলো তাদের শেষ যোগাযোগ।

৮/ এরপর আ্যমেলিয়া, ফ্রেড ও তাদের প্লেন যার নাম “দ্যা ইলেক্ট্রা “, তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। বহু খোঁজাখুঁজি হয়েছে, আজও হচ্ছে। তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রর প্রেসিডেন্ট ফ্র‍্যাংকলিন ডি রুসভেল্ট বিশাল এক উদ্ধারকার্যের ব্যবস্থা করেছিলেন শুধুমাত্র তাদের খোঁজার জন্য। তাছাড়া আ্যমেলিয়ার স্বামী জর্জ ছিলেন একজন ধন্যাঢ্য ব্যক্তি। তিনিও নিজ খরচে নানানভাবে চেষ্টা করেছেন আ্যমেলিয়ার হদিশ পাওয়ার। কিন্তু কিছুতেই কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

৯/ তাদের অন্তর্ধান নিয়ে রয়েছে নানান রহস্যময় তত্ত্ব। তাদের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে এখনো চলছে গবেষণা। তাদের অন্তর্ধান নিয়ে দুইটি তত্ত্ব প্রচলিত আছে। একটি হচ্ছে, ইলেক্ট্রার জ্বালানি শেষ হয়ে গিয়েছিল অথবা তাতে কোন যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিয়েছিলো। যেহেতু ইলেক্ট্রাতে যোগাযোগব্যবস্থা তেমন কিছু ছিলো না তাই তারা সাহায্য চাইতে পারেনি এবং প্রশান্ত মহাসাগরে তাদের সলিলসমাধি ঘটেছে। আবার এটাও ধারণা করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের আদেশে কোন গোপন অভিযানে কর্মরত ছিলেন আ্যমেলিয়া। হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের কোন শত্রুপক্ষের হাতে পরেছিলেন তারা। যার কারণে তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি এখনো। আ্যমেলিয়া এয়ারহার্টের অন্তর্ধান রহস্যের সমাধান আজো হয়নি। কি ঘটেছিলো তাদের ভাগ্যে?

১০/ আ্যমেলিয়া এয়ারহার্ট তার জীবনে বহুসম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি থেকে স্বর্ণ পদক, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে “দ্যা ফ্লাইং ক্রস”, ফ্রেঞ্চ সরকারের পক্ষ থেকে পেয়েছেন “দ্যা ক্রস অব দ্যা নাইট অব দ্যা লিজিয়ন অব অনার”। আরো পেয়েছেন লক্ষ কোটি মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। আজও তিনি সকলের মাঝে বেঁচে আছেন সাহসিকতার অনুপ্রেরণা হয়ে।

লেখিকা সম্পর্কেঃ তাসনিয়া আজমী। শখ বই পড়া, বই সংগ্রহ করা। লেখালেখি শুরু করেছি বেশীদিন হয়নি, কিন্তু এরই মধ্যে লেখালেখি ভালবেসে ফেলেছি। ইচ্ছে ছিল সাংবাদিকতা নিয়ে পড়ার, বিভিন্ন কারণে হয়নি। ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে নিজের বই নিজের বুকশেলফে তুলে রাখার। ইচ্ছে আছে লেখিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার।