মৃত্যু বলতে জীবনের সমাপ্তি বুঝায়। কি ছোট্ট একটি শব্দ! মৃত্যু শব্দটা মনে পড়লে আমাদের সবার মনের ভিতর কেমন এক অজানা ভয় কাজ করে।যা আমাদের নিয়ে যায় অজানা কোন রাজ্যে,যার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।আর সে মৃত্যু যদি হয় আপরাধের বিনিময়ে তবে? সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন সম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল আর সম্রাজ্যের ছিল আইন-কানুন।অপরাধী মানুষের জন্য ছিল কঠিনতম শাস্তি।সেই প্রচীনকাল থেকে চলে আসা চোখের বদলে চোখ, হাতের বদলে হাত নেওয়ার আইন; এরপর গোত্রপ্রধানের উৎপত্তি আর নতুন নতুন সব নিয়মের জন্ম- এভাবেই সবসময় চলে এসেছে রাষ্ট্রের নানাবিধ ব্যবস্থা আর বিধি-নিয়ম। হয়তো তখন রাষ্ট্র ছিল কিংবা ছিলনা। কিন্তু মানুষ তার নিজের মতন করে গোত্র, সমাজ, রাজত্ব, নগর রাষ্ট্র এবং সর্বশেষ শহরের মাধ্যমে চেষ্টা করেছে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি করতে ও মেনে চলতে। আর সেই নিয়ম মানার ও নিয়ম ভাঙার মনোভাবই মানুষকে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে রাষ্ট্রের দিকে।প্রাচীন যুগের পদ্ধতিতে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পন্থা ছিল অমানবিক।সে যা-ই হোক, সেই শাস্তিগুলো বাস্তবায়নের উপায় জানলে বিস্মিত না হয়ে থাকার উপায় নেই।প্রাচীন পৃথিবীর এমনই কিছু শাস্তি,যা নিয়ে আজ মৃত্যুদন্ডের দ্বিতীয় পর্ব।চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক প্রাচীন পৃথিবীর মৃত্যুদন্ড পদ্ধতি।
চামড়া ছড়ানো
চামড়া ছাড়ানো (Flaying Skin) এক বীভৎস মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে জীবিত মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামিকে টেবিলের সাথে বেঁধে জীবন্ত অবস্থায় তার চামড়া ছাড়ানো হতো । আর ছাড়ানো চামড়া জনসম্মুখ্যে টানিয়ে রাখা হতো, যাতে সবাই দেখতে পারে এবং শাসককে ভয় পায়। ভয় তৈরি করার বেশ ভাল পন্থাই বলা যায়!! কি বলেন?
বেস্টিয়ারাই
ভাবুন তো আপনাকে একটা বিশাল মাঠে ভয়ংকর কিছু প্রানীর মাঝে ছেড়ে দেওয়া হল চারপাশে অনেক মানুষ কিন্তু কেউ আপনাকে সাহায্য করতে এলো না।কি ভয়ংকর ঠিক না!!!!!ভাবলেই মেরুদন্ড দিয়ে ঠান্ডা শিহরন বেয়ে যায়।আদি রোমান সম্রাজ্যের সময় কিন্তু ঠিক এমনটাই করা হত।
বেস্টিয়ারাই (Bestiarii), আদি রোমান সম্রাজ্যের একটা খেলা। যেখানে বীরেরা হিংস্র প্রানির সম্মুক্ষীন হয়ে তাদের পরাস্ত করত। কিন্তু এই খেলাকেও ব্যবহার করা হত মৃত্যুদন্ড কার্যকরের উপায় হিসেবে। যাদের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হত তাদের উলঙ্গ করে ছেড়ে দেওয়া হত হিংস্র প্রানীদের মাঝে। আর কোন প্রতিরোধ ছাড়াই হিংস্র প্রানীরা মেরে ফেলত মৃত্যুর সাজা পাওয়া ব্যক্তিকে এবং খেয়ে ফেলত। আর এই মৃত্যু দেখে এই খেলা দেখতে আসা দর্শকেরা উল্লাসে গলা ফাটাতো। তাদের জন্য এটা ছিল শুধু মাত্র বিনোদন।
মাজাটেল্লো
মাজাটেল্লো (Mazzatello),মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার সব থেকে বীভৎস প্রক্রিয়া গুলির মধ্যে অন্যতম একটি। এক্ষেত্রে শহরের মাঝে উঁচু মঞ্চে আসামিকে এনে তার মাথায় কাঠের তৈরি এক হাতুরি দিয়ে জোড়ে আঘাত করে তার মাথা থেতলে দিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হত। এই প্রক্রিয়া চালু ছিল ১৮শ দশকের দিকে ইউরোপের সেসকল দেশে, যেখানে পোপের আইন চালু ছিল।
ন্যায়ের ঝাঁকি
ন্যায়ের ঝাঁকি (Upright Jerker) এর প্রথা প্রথম চালু হয় আমেরিকাতে, কিন্তু আমেরিকাতে বর্তমানে এই পদ্ধতি নিষিদ্ধ হলেও বর্তমানে ইরানে এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। অনেকটা বাংলাদেশে চালু ফাঁসির কার্যকর করার পদ্ধতির মত হলেও কিছুটা ভিন্ন। এক্ষেত্রে আসামিকে জনসম্মুক্ষে গলায় দড়ি পরিয়ে দড়িটি উপরে দিকে টেনে তোলা হয়। আর দড়িটি তোলার সময় ঝাঁকি দেওয়া হয়, যাতে আসামির ঘাড় ছিড়ে যায়। দড়িটি তুলতে সাধারনত ক্রেন ব্যবহার করা হয়।
নিষ্পেষণ
নিষ্পেষণ (Crushing) পদ্ধতি অনেকটাই হাতি দ্বারা কার্যকর করা মৃত্যু দন্ডের মত। তবে কিছুটা ভিন্ন। এই পদ্ধতি মূলত মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামির ক্ষেত্রে ব্যবহার হত না, তবে যে সকল আসামির উপর ব্যবহার করা হত তারা সকলেই মৃত্যুররন করত। কি ধাঁধার মধ্যে পরে গেলেন। আচ্ছা এবার একটু ভেঙ্গে বলি, এই পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল আমেরিকায় আর সেখান থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এটির বিস্তার ঘটে। তৎকালীন সময়ে কোন সাধারন ব্যক্তি বা দাস যদি কোন সম্ভান্ত পরিবারের বিশেষ ব্যক্তিদের দ্বারা দোষী হিসেবে আক্ষা পেত, তাহলে তাদের দিয়ে দোষ স্বীকার করানোর কাজেই ব্যবহার করা হত এই পদ্ধতি। এক্ষেত্রে আসামিকে মাটিতে শুইয়ে তার উপর ভারি বস্তু রাখা হত, আর প্রতিবার তাকে তার দোষ স্বীকার করার কথা বলা হত। স্বীকার না করা পর্যন্ত ওজন বাড়িয়ে যাওয়া হত, যতক্ষন পর্যন্ত না সে মারা যায়। তবে দোষ স্বীকার করলেও যে মুক্তি পেত তা নয়, সেই দোষের জন্য এবং সবাইকে মিথ্যা বলার দ্বায়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হত। মানে কোন ভাবেই নিস্তার নাই।
ক্যাথেরিনের চাকা
ক্যাথেরিনের চাকা (Catherin Wheel) নামটি কেন এসেছে তা জানা নেই, তবে কোন নারীর নামের সাথে যে সম্পর্কিত তা না শুনেই বোঝা যায়। হয়তবা ক্যাথিরিন নামে কেউ এই মৃত্যদন্ড কার্যকর পদ্ধতি আবিস্কার করেছিল। এই ক্যাথেরিনের চাকার আরেকটি নাম আছে, তা হল “Breaking Wheel”। এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা মানে সত্যিকার অর্থে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর করা। এই পদ্ধতিতে আসামিকে একটি চাকার সাথে শক্ত করে বাঁধা হয়, এর পরে চাকাটি জোড়ে জোড়ে ঘুরতে থাকে, এ সময় জল্লাদ চাবুক বা লাঠি দিয়ে ঘুরতে থাকা আসামির গায়ে সর্বোচ্চ জোড় দিয়ে আঘাত করতে থাকে। আঘাত করতে করতে জল্লাদের মন ভরলে সে তখন মোটা লোহা দিয়ে আসামির হাতে আর পায়ে পেরেক পুতে দেয়, তারপর আবার আঘাত হানা শুরু করে জল্লাদ। যত সময় মন চায় চালিয়ে যায়। মন তৃপ্ত হলে তখন পেরেক পোতা অবস্থায় আসামিকে শহরের মাঝে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়, যাতে সবাই দেখতে পারে। অনেকটা ক্সুসের মত শুধু পার্থক এখানে ক্রুস না দিয়ে ক্রস (X) আকৃতির খুটির সাথে পেরেক দিয়ে হাত পা লাগানো থাকে।
এই ছিল মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার বীভৎস পন্থা। বর্তমান যুগে এই সকল পদ্ধতির মধ্যে কয়েকটি বাদে বাদবাকি পদ্ধতি গুলি ব্যবহৃত হয় না। মৃত্যু সকল জীবের চিরন্তন সত্য একটি বিষয়। আসুন সবাই দোয়া করি যেন আল্লাহ আমাদের সকলকে শান্তিতে মৃত্যুবরণ করার তৌফিক দান করেন। আমিন।