কল্পনা করুন আপনার বাড়ির পেছনের দরজার কথা, সদর থেকে একটু ব্যক্তিগত। এই সদর দরজাটি এমন এক গণ্ডি বা সীমারেখা, যা পার করে আপনার নিজের ও বাড়ির গোপনীয়তা ও সুরক্ষা করে। আপনি যদি এই দরজাটির রক্ষক হন তাহলে সেই দরজা দিয়ে আপনি যে কাউকেই বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দিবেন কিনা, কাকে ড্রইংরুমে বসাবেন, কাকে অন্দরমহল দেখাবেন আর কার সাথে দূরত্ব বজায় রেখে উভয়পক্ষকেই শারীরিক ও মানসিকভাবে নিজ নিজ বিশ্বাসযোগ্যতা, আস্থা প্রমাণের সুযোগ করে দেবেন সেটি আপনার উপর নির্ভর করছে। তেমনিভাবে আমরা যখন কারো সাথে কথা বলি, যোগাযোগ করি অথবা কোন সম্পর্ক তৈরি করি, প্রথমেই প্রয়োজন হয় একটি স্পষ্ট সীমারেখার। যেমন আপনি তাকে আপনার সম্পর্কে কতোটুকু তথ্য দিবেন, তাকে কতোটুকু কাছাকাছি আসতে দিবেন ইত্যাদি। শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তীয়, সামাজিক, আধ্যাত্মিক দিক সহ নেশাজাতীয় দ্রব্য ও যৌন হয়রানি থেকে রক্ষা এবং নিজের যত্ন নিশ্চিত করাই একটি সুস্থ গণ্ডি নির্ধারণের উদ্দেশ্য।
কোন সম্পর্কে পরস্পর পরস্পরের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল, সহযোগিতাপূর্ণ এবং যত্নশীল তা ব্যক্তির বাউন্ডারি বা সীমারেখার স্পষ্টতার উপর নির্ভর করে। এই গণ্ডির নমনীয়তার ধরণই পরিচয় দেয় আমাদের আত্মসম্মানবোধের। আপনার সাথে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করছে, আপনার দুর্বলতায় হাসছে অথবা আপনার ভাল ব্যবহারের অন্যায় সুবিধা নিচ্ছে এমন সময়গুলোয় অনেক সময় আমরা অপরপক্ষকে এমন কি নিজেকে দোষারোপ করে ফেলি।
তাই ব্যক্তিগত বাউন্ডারি বা সীমারেখা নির্ধারণ করা নিজের শারীরিক ও মানসিক সুরক্ষায় নিজেকেই বলিষ্ঠ হতে সাহায্য করে। এর স্পষ্টতা ও দৃঢ়তা সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষা, আত্মসম্মান বজায় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতায় সাহায্য করে। ব্যক্তিগত গণ্ডি বজায় না রাখা আর বাড়ির সদর দরজা খোলা রাখা একই কথা, প্রত্যাশিত-অপ্রত্যাশিত যে কেউই যখন তখন অরক্ষিত বাড়িতে ঢুকতে ও বের হতে পারবে। আবার কঠোর সীমারেখা আপনাকে দুর্গের মত অনুদার দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন, একাকী আর বিচ্ছিন্ন করে রাখবে, আপনি নিজেও বের হতে পারবেন না অন্য কেউও কাছে এসে মিশতে পারবে না। এই অস্বাস্থ্যকর সীমারেখাই আমাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্কে সমস্যা বাড়ায়। যার কারণে তৈরি হয় অতিনির্ভরশীলতা, বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা এবং শারীরিক অসুস্থতা।
অস্বাস্থ্যকর মানসিক সীমারেখার কয়েকটি লক্ষণ
১। কাউকেই বিশ্বাস না করা অথবা সবাইকে বিশ্বাস করা –যেটাকে ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট থিঙ্কিং বলা হয়।
২। যার সাথে কথা বলছেন সে ঐ মুহূর্তে ঐ বিষয়ে শুনতে আগ্রহী কিনা লক্ষ্য না করে একবারে বাজারদর থেকে শুরু করে পারিবারিক সমস্যা,গসিপ সব বলতে থাকা।
৩। প্রথম পরিচয়েই ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলা।
৪। পরস্পরকে ভালভাবে বুঝার আগেই দ্রুত প্রেমে পড়া
৫। নিজের ক্ষমতা, পছন্দ, বিকাশের দিকে লক্ষ্য না করে অন্যের দ্বারা ভীষণ প্রভাবিত হওয়া, যেমন কোন ধরনের ড্রেস পরবে, কোথায় কি দিয়ে যাবে, কোন বন্ধু বা বান্ধবীর সাথে মিশবে ইত্যাদি বলে দেয়া ও মেনে নেয়া।
৬। নিজের প্রয়োজনীয় কাজগুলোর জন্যও যথেষ্ট সময় না রেখে সারাখন অন্যজন যেন কষ্ট না পায় সেদিকে অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকা।
৭। ফলাফল বা দায়িত্ব চিন্তা না করেই শারীরিক সম্পর্কে জড়িত হওয়া।
৮। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে পার্টনারের মন রক্ষা করতে শারীরিক সম্পর্ক করা
৯। নিজের মূল্যবোধ ও অধিকার খর্ব করে অন্যকে খুশি করার প্রবণতা।
১০। অন্যজন পছন্দ বা অনুমতি দিচ্ছে কিনা তা খেয়াল না করে তার ব্যক্তিগত সীমারেখার ভেতরে ঢুকে পড়া। যেমন অনেকেই কথা বলার সময় এত কাছে এসে কথা বলেন যে অপরজন অস্বস্তিবোধ করেন।
১১। যখন আপনি চাইছেন না, তারপরেও খাদ্যদ্রব্য, উপহার, স্পর্শ (যেমন- শরীরের কোথাও হাত রাখা) গ্রহণ করা, যৌন আবেদনে সাড়া দেয়া, অর্থাৎ “না” বলতে না পারা।
১২। অনুমতি ছাড়াই কাউকে স্পর্শ করা, যেমন হাত ধরা, কাঁধে বা পিঠে হাত রাখা, শরীরের গোপন স্থান স্পর্শ করা। কেননা সকলের উদ্দেশ্য সরল নাও হতে পারে, ব্যক্তি যৌন হয়রানির স্বীকার হতে পারেন।
১৩। আরেকজনের উদারতা ও বিনয়কে পরোয়া না করে নিজের জন্য সুযোগ-সুবিধা নিতে থাকা।
১৪। নিজের পরোয়া না করে অন্যদেরকে ইচ্ছামত স্বার্থ আদায় করে নেয়ার অনুমতি দেয়া।
১৫। ‘আমার যা আছে সব তুমি নাও’- এই প্রবণতাটিও অস্বাস্থ্যকর সম্পর্কের লক্ষণ।
১৬। নিজের সক্ষমতায় আস্থা না রেখে কোন প্রশ্ন ছাড়াই অন্যের নির্দেশনা অনুযায়ী চলা ও সিদ্ধান্ত নেয়া।
১৭। ‘সব তো শুনলেন, এখন আপনিই বলেন, আমার কি অবস্থা, আসলে আমি কেমন’ – অর্থাৎ অন্যের মাধ্যমে নিজেকে মূল্যায়ণ করার প্রবণতা, যা মূলত ঐ ব্যক্তির বুদ্ধি-বিবেচনার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে, ফলে নিজের প্রকৃত অবস্থা অনেক সময় চাপা পড়ে যায়।
১৮। ‘তুমি বল তো আসলে আমি কেমন?’- এভাবে আরেকজনকে দিয়ে নয়; আপনি নিজে নিজেকে জানুন ও সংজ্ঞায়িত করুন।
১৯। অন্যরা বা একমাত্র বিশেষ কেউই আপনার প্রয়োজন পূরণ করতে পারবে বলে বিশ্বাস করা।
২০। নিজের প্রয়োজন, আপনি কি চাচ্ছেন তা স্পষ্টভাবে না বলে অন্যজন নিজ থেকেই আপনার চাহিদা বুঝে নেবে বলে আশা করা।
২১। নিজে সচেষ্ট না হয়ে নিজের যত্ন ও খেয়াল রাখার জন্য অন্য কারো উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া।
২২। ইতিবাচক ও সফলতার সময়গুলোর কথা না ভেবে নেতিবাচক ও ব্যর্থতার দিকগুলো মনে করে করে নিজেকে করুণা করা ও নিজের সমালোচনা করা।
লেখিকা সম্পর্কেঃ আফরিন উপমা। Trainee Counselling Psychologist , Psychological Services, DECP, DU