বিশ্বের ১২ টি সৌন্দর্যমন্ডিত ট্রেন ষ্টেশন

ঝকঝকা ঝক ট্রেন চলেছে ট্রেনের বাড়ী কই? আজ ট্রেনের বাড়ির কথাই বলবো। তাও আবার যে সে বাড়ির কথা না, সারা পৃথিবী থেকে বাছাই করা সেরা ট্রেনের বাড়িগুলোর কথা বলবো। যে বাড়িগুলো সবচেয়ে সুন্দর, যে বাড়িগুলোতে মানুষ শুধু প্রয়োজনেই আসেনা। যে বাড়িগুলো এক নজর দেখে মানুষ চোখ জুড়াতে আসে ঐ বাড়িগুলোর কথা বলবো। সবাই হয়তো ভাবছেন ট্রেনের বাড়ি আবার কি? ট্রেনের কি আবার বাড়ি আছে নাকি! কেন থাকবেনা ভাই? মানুষের বাড়ি থাকতে পারে, ট্রেনের বাড়ি থাকতে পারেনা?  ট্রেন ষ্টেশনকে কি আপনার ট্রেনের বাড়ি বলতে পারিনা? পারিতো মনে হয়। জ্বী ট্রেন ষ্টেশনকেই ট্রেনের বাড়ি বলছি। ট্রেনের সবচেয়ে সুন্দর যে বাড়িগুলো তার মধ্যে একটি আমাদের বাড়ির পাশেই আমাদের প্রতিবেশীর বাড়িতে অবস্থিত। মানে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে অবস্থিত। শুরু যখন করবো তাহলে বাড়ির কাছের ট্রেনের বাড়ির বর্ণনা দিয়েই শুরু করি। কি বলেন সবাই? ওকে তাহলে শুরু করি।

১. ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাল, ইন্ডিয়া: বাংলা সিনেমায় বহু বছর অাগে মেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের সাথে হঠাৎ ভাইয়ের দেখা হলে তাদের মধ্যে যে ফিলিঙস কাজ করে এই  ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনালের ছবি দেখে অধিকাংশমানুষের মাঝেই সেই লেভেলের একটা ফিলিঙ কাজ করবে, অার মনে হবে ‘কোথায় যেনো দেখেছি, কোথায় দেখেছি’ অামি শিওর! প্রশ্ন করতে পারেন, ‘ক্যামনে?’ অার তখনই যদি বলি, ‘স্লাম ডগ মিলিনিয়র দেখেছেন?’ তখন দেখা যাবে অাপনারা বলা শুরু করেছেন, ও হ্যা, হ্যা, মনে পড়েছে,মনে পড়েছে। ঐ মুভিতেইতো এই টার্মিনাল দেখিয়েছিলো। হুম ‘স্লাম ডগ মিলিয়নার’ মুভিতে দেখানো হয়েছিলো এই টার্মিনাল।পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ট্রেনের বাড়িগুলোর একটি হলো এই ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাল।

ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাল

ছত্রপতি টার্মিনালের নামেও কিন্তু কাহিনী আছে। এটি একজীবনে দুটি নাম পেয়েছে। এটি কিন্তু শুরুতে ছত্রপতি নামে পরিচিত ছিলোনা। এটির প্রথম নামকরন করা হয়েছিলো মহামান্য রানী ভিক্টোরিয়ার জুবিলীর নামানুসারে। সেজন্য এখনও অনেকে একে ভিক্টোরিয়া টার্মিনাল বলে ডেকে থাকে। ১৮৮৭ সালে এটি মহারাণী ভিক্টোরিয়ার নাম অনুসারে এই টার্মিনাল ভবনটি উন্মুক্ত হয় এবং ১৯৯৬ সালে মারাঠা প্রদেশের প্রতিষ্ঠাতা ছত্রপতির নামে এর নামকরন করা হয়। সুদর্শন এই ট্রেন ষ্টেশনটি ইটালিয়ান গথিক রিভাইবাল এবং ভারতীয় মোগল শৈলীর অাশ্চর্য সংমিশ্রনে তৈরী। এর নকশা করেছেন ফ্রেডেরিক উইলিয়াম। বর্তমানে এটি ইন্ডিয়ার সবচেয়ে ব্যস্ততম একটি ট্রেন ষ্টেশন।

২. গ্রান্ড সেন্ট্রাল টার্মিনাল, ইউএসএ: সেন্ট্রাল টার্মিনালটি ১৯১৩ সালে নির্মিত হয়।রেড ও স্টিম এবং ওয়ারেন ও ওয়েটমোরের স্থাপত্য সংস্থা কতৃক এই স্টেষনটি ডিজাইন করা হয়। ওয়ারেন এবং ওয়েটমোর ওয়ারেন ও ওয়েটমোরকতৃক যুক্ত বিআাওক্স শীল্প শৈলী এই টার্মিনাল ভবনকে আইকোনিক করে তোলে। হেনরি এএডওয়ার্ড  বেডফোর্ডের নকশাকৃত আইকোনিক ঘড়িটি এর প্রধান আকর্ষন।

blank
গ্রান্ড সেন্ট্রাল টার্মিনাল স্টেশন

৩. লেইজে গুইলিয়ামস, বেলজিয়াম : লেইজে গুইলিয়ামস ষ্টেশনটির ডিজাইনার স্থপতি সান্তিয়াগো ক্যাতরাভাভা। ক্যাতরাভাভার নকশাটি আশ্চর্যজনকভাবে আধুনিক, এটি খিলানের উচ্চতা ১০৫ ফুট। এটি ইস্পাত, কাচ এবং সাদাকংক্রিটের তৈরী। স্টেশনে পাঁচটি প্ল্যাটফর্ম রয়েছে, এটি বেলজিয়ামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাবগুলির অন্যতম কারণ এর সমস্ত ট্র্যাক উচ্চ গতির ট্রেনগুলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। লেইজে গুইলিয়ামসের নির্মান ভিক্টোরিয়ান অথবা এডওয়ার্ডযুগের কথা নয়। এই সেদিনের কথা, ২০০৯ সালে লেইজে গুইলিয়ামস ষ্টেশনটি নির্মিত হয়।

blank
লেইজে গুইলিয়ামস স্টেশন

৪. সেইন্ট প‌্যানক্রাস ইন্টারন্যাশনাল, ইউকে: এই ষ্টেশনটির ডাকনাম রেলওয়ের ক্যাথিড্রাল।পূর্ব মিডল্যান্ড এবং ইয়র্কশায়ার মাঝে রেল সংযোগের উদ্দেশ্যে ১৮৬৮ সালে উইলিয়াম হেনরির নকশায় এই রেলওয়ে স্টেশনটি খোলাহয়। এর খিলানযুক্ত ট্রনটি তখন পৃথিবী সর্ববৃহত ছাদ হিসেবে বিবেচিত ছিলো।বর্তমানে এর ১৫ টি প্লাটফর্ম আছে। এখানে একটি লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড স্টপ, একটি শপিং সেন্টার ও একটি বাসষ্টেশন রয়েছে।

blank
সেইন্ট প‌্যানক্রাস ইন্টারন্যাশনাল

৫. ডুনেডিন স্টেশন, নিউজিল্যান্ড: ১৯০০ সালের প্রথম দিকে নিউজিল্যান্ডের বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল ডুনিডিন। ১৯০৬ সালে এখানে একটি সুদৃঢ় রেলওয়ে স্টেশন বসানো হয়। এই ষ্টেশনটিই ডুনেডিন স্টেশন। কাজের মতো কাজ শুধু একজন মানুষকে না, তার নামও বদলে দিতে পারে। এই যেমন ডুনেডিন ষ্টেশনের স্থপতির কথাই ধরুননা! ফ্লেমিশ পুনর্নবী শৈলীতে করা অনন্য সুন্দর এই স্থাপনা তাকে সবার কাছে জিন্জারবার্ড জর্জ নামে পরিচিত করে তোলে। ১৯০৬সালে এর নির্মানকাজ সম্পন্ন হয়। বছরের পর বছর যাত্রী রেল ট্রাফিকগুলোর ব্যাপক বৃদ্ধির কারনে বর্তমানে এটি যেনো রেল ব্যাবসার চেয়েও বেশী কিছু হিসেবে ব্যাবহৃত হয়।

blank
ডুনেডিন স্টেশন

৬. এন্টুয়ার্প সেন্ট্রাল, বেলজিয়াম: এন্টুয়ার্প সেন্ট্রাল যেন বেলজিয়ামের দ্বিতীয় শহর। পাথরের ভবন এবং ওয়েটিং কক্ষের ভবনটির ওপর বিশাল গম্বুজের সমন্বয়ে গঠিত সুন্দর ও বিশ্ববিখ্যাত ষ্টেশনটি ১৯০৫ সালে উন্মুক্ত করা হয়।বিভিন্ন স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে লুইস ডেলাকেনসেরি এর ডিজাইন করেছিলেন।

blank
এন্টুয়ার্প সেন্ট্রাল স্টেশন

৭. মিলানো সেন্ট্রাল, ইতালি: মিলানো সেন্ট্রালের শুরুর গল্পটা বেশ দীর্ঘ। ১৯০৬ সালে মূল সিম্পলন টানেলটি উন্মুক্ত হওয়ার পর দেখা গেলো আসল মিলান স্টেশনটি অতিরিক্ত ট্রেন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেনা। ১৯১২ সালপর্যন্ত এর কোনো নকশাই নির্বাচন করা ছিলোনা আর ১৯৩১ সাল পর্যন্ত এটি উন্মুক্ত ছিলোনা। যদিও রাজা দ্বিতীয় ভিক্টর ১৯০৬ সালে এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।স্থপতি উলিস্সে নকশা তৈরী করলেও ডব্লিও ডব্লিও অাই এর সময় ইতালি অর্থনৈতিক সংকটে ভোগার কারনে এর নির্মান কাজে ভাটা পড়ে। বেনিতো মুসলিনি ইতালির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এটিকে তার ফ্যাসিস্ট শাসনের প্রতীক হিসেবে আরও সুন্দর করে তৈরী করেন। বর্তমানে এটি শুধু ইতালির না, সমগ্র ইউরোপের একটি ব্যাস্ততম ষ্টেশন।

blank
মিলানো সেন্ট্রাল স্টেশন

৮. ইস্তাম্বুল  সারকেসি ট্রেন ষ্টেশন, তুরষ্ক: ইস্তাম্বুল সারকেসির ডাকনাম হলো ইস্তাম্বুল টার্মিনাল। এই ষ্টেশনটি জ্যাকমুন্ডের নকশায় ১৮৯০ সালে প্রথম উন্মুক্ত হয়। ইস্তাম্বুল সারকেসি স্টেশনটি অটোমান শিল্পের একটি নিদর্শন। এটি বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর রেল ষ্টেশনগুলোর একটি। এর প্রাচ্যের মোটিফ, রঙীন টাইলস এর ভিতরটাকে সম্পূর্ন অালোকিত করে রেখেছে। যদিও এর সদর দরজা এখন বন্ধ, তবুও মানুষ অাজও এর অাভন্তরীন সৌন্দর্যের বর্ননা ও বন্দনায় যেন বুদ হয়ে থাকে।

blank
সারকেসি ট্রেন ষ্টেশন

৯. হায়দার পাশা টার্মিনাল, তুর্কী : এখন যে ট্রন ষ্টেশনের কথা বলবো এটি ছিলো ব্যস্ততম ট্রেন ষ্টেশনগুলোর একটি। বর্তমানে এটি সংস্কারের জন্য বন্ধ রয়েছে। কারন এর অধিকাংশ পথ ব্যাবহার অনুপযোগী হয়ে গিয়েছে। আর্কিটেক্ট ওট্টো রিটার এবং হেলমুট কনুর ডিজাইনে ১৯০৯ সালে এই ষ্টেশনটি নির্মিত হয়। হায়দার পাশার ট্রেনগুলো ঐতিহ্যগতভাবে এশিয়ার দিকে ট্রেন সেবা দিয়ে থাকে।

blank
হায়দারপাশা টার্মিনাল

১০. লুজ ষ্টেশন, ব্রাজিল: বিশ্বের সুদর্শন ট্রেন ষ্টেশনের একটি এই লুজ ষ্টেশন। এর নকশাকার ওয়াল্টার ম্যাকফার্লান এবং কো সারাকেন ফাউন্ড্রি গ্লাসগো। ১৯০১ সালে এই ট্রেন স্টেশনটির নির্মান কাজ সম্পন্ন হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এটি সাও পাওলোর প্রবেশ পথ ছিলো।  কিন্তু দিন কি আর সবার সবসময় এক থাকে? থাকেনা। আজ ব্রাজিলের অন্যান্য রেলপথের মত এরও অনেক অবনতি ঘটেছে। কিন্তু ঐযে কথায় আছেনা নদী মরে গেলেও নদীর বাঁক ঠিকই থাকে। তেমনি অবনতি স্বত্তেও  লুজ স্টেশন এখনও এর এর সৌন্দর্য দ্বারা বেশ সংখ্যক পর্যটক টেনে আনে। এদের অধিকাংশই এর ভিতরে অবস্থিত পূর্তগীজ ভাষার যাদুঘরটি দেখতে আসে।

blank
লুজ ষ্টেশন

১১. ক্যামিনহো ডি ফেররো ডি মোচাম্বিক: মোজাম্বিকের রাজধানী মাপটোতে এই রেলস্টেশনটি অবস্থিত। এই স্টেশনটি ভিক্টোরিয়ান শৈলীতে নির্মিত। উজ্জল সাদা ও সবুজ ভবন অসংখ্য গম্বুজ ও পিলারের সমন্বয়ে এটি গঠিত। এটি বর্তমানে শুধু ট্রেন স্টেশন হিসেবেই পরিচিত নয়, পাশাপাশি এটি এখন পাবলিক প্লেস হিসেবে পরিচিত এবং এখানে কন্সার্ট ও ফ্যাশন শো আয়োজিত হয়ে থাকে। এটি নিউজউইক কতৃক স্বীকৃত বিশ্বের দশটি ট্রেন ষ্টেশনের একটি।

blank
ক্যামিনো ডি ফেররো ডি মোচাম্বিক স্টেশন

 

১২. অটোচা ট্রেন স্টেশন, স্পেন:  অটোচা  ষ্টেশন মাদ্রিদের বৃহত ট্রেন ষ্টেশন।  আর্কিটেক্ট আলবার্তো দ্যা পালাসিও গুস্তাভ আইফেলের সাথে মিলে অটোচা স্টেশনের নকশা প্রস্তুত করেন। ইস্পাত ও কাচের নির্মান শৈলী একে করে অন্যান্য স্থাপনার তুলনায় ব্যতিক্রম করে তুলেছে। যাত্রীরা স্টেশন মধ্যে ভাস্কর্য প্রদর্শন উপভোগ করতে পারেন। এটি অাপনার ট্রেনের অপেক্ষায় বসে থাকা সময়টুকু বিরক্তির চাদরে না মাখিয়ে করে তুলতে পারে অারামদায়ক। অটোচা স্টেশনের নামকরন করা হয় কাছের একটি চার্চে নিবেদিত নারী অটোচার নামানুসারে। ১৮৯২ সালে মাদ্রিদের বৃহৎ এই ট্রনস্টেশনটি নির্মিত হয়।

blank
অটোচা ট্রেন স্টেশন