অবশেষে আজ মুক্তি দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ মোশন পিকচার “বাহুবালি–২”। কেন ভারতের, তাও আবার বলিউডেরও না, দক্ষিণের একটা মুভি নিয়ে সর্বত্র এতো মাতামাতি? কেন হুজুগ এই কাটাপ্পা-বাহুবালির? প্রতিটাই বেশ ভালো প্রশ্ন। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানলেই বাহুবালিকে জানা হয়ে যায়।
আপনি পৃথিবীর যে অংশের বাসিন্দাই হন না কেন, পৌরাণিক যুদ্ধের সিনেমা আপনাকে আকর্ষণ করবেই। শিশুদের সৃষ্টিশীলতার সাথে প্রথম পরিচয়টাই হয় রূপকথা দিয়ে। সেখানে বিপদে পড়া রাজা থাকে, অতীব সুন্দরী রাণী থাকে, মহাপরাক্রমশালী খলনায়ক থাকে, যুদ্ধ থাকে, হাতি-ঘোড়া থাকে, তীর-ধনুক থাকে, তলোয়ারের ঝনঝনানি থাকে, যুদ্ধজয় শেষে রাজা-রাণীর সুখে শান্তিতে বসবাস থাকে, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রাচ্য হোক কিংবা পাশ্চাত্য, জ্যাক দ্যা জায়ান্ট স্লেয়ার হোক আর ডালিমকুমার, গল্প কিন্তু একই। পাশ্চাত্যে পৌরাণিক গল্প, যুদ্ধ নিয়ে সিনেমা কম হয় নি; সেটা ১১ অস্কার পেয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়া বেন হার হোক কিংবা সাম্প্রতিকে জ্যাক স্নাইডারের করা ব্যবসাসফল থ্রি হান্ড্রেড। কিন্তু আমরা যেসব রূপকথা, যেরকম রাজকীয়তা, যেমন যুদ্ধকথা পড়ে এসেছি সেগুলো খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমাদের এদিককার সিনেমাগুলোতে। বলিউড চেষ্টা করেছে হয় নি, সাউথেও আগে চেষ্টা হয়েছে হয়নি। শেষমেশ এস এস রাজামৌলীর হাতেই হল “মাগাধিরা” সিনেমার মাধ্যমে। কিন্তু মাগাধিরাও যে অর্ধেক আধুনিক, অর্ধেক পৌরাণিক। এই বোধ থেকেই হয়তো রাজামৌলীর মাথায় বাহুবালির চিন্তা আসে।
বাহুবালি আমার কাছে একইসাথে সিনেমা আর মার্কেটিং এর পিওর ব্লেন্ড। সিনেমা একইসাথে দুটো পরিচয় বহন করে। এক- আর্ট, দ্বিতীয়- প্রোডাক্ট। রাজমৌলী বাহুবালিকে দুটো পরিচয়ে পরিচিত করাতে চেয়েছেন একদম প্রথম থেকে। প্রথমেই তার মনোযোগ আর্ট নিয়ে, তার ক্রাফট নিয়ে। প্রায় দেড় বছর সময় নিয়ে স্ক্রিপ্ট সাজিয়েছেন তিনি, সে স্ক্রিপ্ট দেখে বুঝতে পেরেছেন যে এক সিনেমায় এই স্ক্রিপ্টকে জাস্টিফাই করা সম্ভব না। কিন্তু দুটো সিনেমা করা মানে বাজেট দুই গুণ বেড়ে যাওয়া। মাগাধিরা যত বড়ই হিট হোক, যতই সফল পরিচালক হন, এতো টাকা কোথা থেকে ম্যানেজ করবেন তিনি? তবুও ঘাবড়ে জাননি রাজামৌলী, তার গল্পের চরিত্র অনুযায়ী কাস্টিং করেছেন খুব যত্ন করে। বাহুবালি চরিত্রে অভিনয় করা প্রভাসকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে আগামী ২ বছর তুমি আর কোন সিনেমা করতে পারবেনা, যেটা পরে বেড়ে গিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ বছরে পড়লো। কোন প্রথম সারির অভিনেতাই এই প্রস্তাবে রাজি হতেন না কারণ ৩-৪ বছর কোন কাজ হাতে না নিয়ে কেবল একটা সিনেমার পেছনে ইনভেস্ট করার মতো অভিনেতা এই জমানায় নেই বললেই চলে। কিন্তু রাজামৌলী সফল হলেন, প্রভাস কাজটা নিলেন। আর্টের দিক দিয়ে গুছিয়ে কাজটা, প্রোডাক্টে মনোযোগ দিলেন রাজামৌলী। জানতেন যে বিগ বাজেট সিনেমা হবে, প্রথম পর্বে খরচ হল গুণে গুণে ১৮০ কোটি রুপি। করণ জোহরের মতো ঝানু প্রোডিউসার রাজামৌলীর ভিশনে কনভিন্সড। টাকা তাই আর কোন ফ্যাক্টর রইল না। সেই টাকা রাজামৌলী খরচ করলেন খুব চমৎকারভাবে। যেখানে বর্তমান যুগ প্রোমোশনের যুগ, সেখানে কন্টেন্টই আসল প্রমোটার এই মূলমন্ত্র নিয়ে এগুলেন রাজামৌলী। আর দশটা সাধারণ সিনেমার মতোই হয়েছিল প্রথম বাহুবালি মুভির প্রমোশন। কিন্তু তাক লাগালো সিনেমার ট্রেইলার। এতো সুন্দরভাবে শ্যুট করা ট্রেইলার, দুর্দান্ত সিনেম্যাটোগ্রাফি, এতো চমৎকার করে এডিটেড, যুদ্ধের সিনগুলোর সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সিঙ্ক্রোনাইজেশন, মুগ্ধকর। কন্টেন্ট কথা বলল, মানুষ ছুটে গেল বাহুবালি দেখতে। এবার সিনেমার কন্টেন্টের কথা বলার পালা।
এমন সিনেমা হল এক্সপেরিয়েন্স ভারতের মানুষের আগে কখনো হয়নি। মুহূর্তের মাঝে নিয়ে গেলেন পরিচালক মধ্যযুগের মহেষ্মতী নাম্নী এক রাজ্যে। যে রাজ্য থেকে এক শিশুকে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন এক নারী, যিনি কিনা প্রাক্তন রাণী সে রাজ্যের। কে এই শিশু যাকে জীবন দিয়ে বাঁচালেন সে নারী, যাকে কোলে পেয়ে নিঃসন্তান গরীব বাবা-মা খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলো। এমনটা আমরা আগেও দেখেছি, নদীতে ভেসে আসা রাজপুত্র বড় হয়ে মাহমুদ কলি নয় ইলিয়াস কাঞ্চন হয়, পুরোনো সে গল্পই। কিন্তু রাজমৌলী পরিবর্তন আনলেন প্রেজেন্টেশনে। চরিত্রের সাথে হালকা ভাব করিয়ে দিলেন আর মুগ্ধ করালেন চরিত্রের উপস্থাপনায়। বাজেটের টাকা দেদারসে ঢাললেন যুদ্ধের সিনগুলোতে। ক্লাস অডিয়েন্সকে টানলেন সিনেম্যাটোগ্রাফি আর এপিক ব্যাটল সিনগুলো দিয়ে। মাস অডিয়েন্সকে টানলেন পেশীবহুল নায়ক ও অপরূপা সুন্দরী নায়িকার প্রেম আর চটকদার গান দিয়ে। আর শেষ মাস্টারস্ট্রোকটা মারলেন সিনেমার শেষে এসে। কারণ জানতেন যে পরের সিনেমা তৈরি করতে তার আরও এক থেকে দেড় বছর লাগবে, যা এখন প্রায় দুই বছর হয়ে গেছে। এতো সময় ধরে এই সিনেমার সাথে কীভাবে দর্শককে হুক করে রাখা যায়! সে কাজটাই করলেন রাজমৌলী সিনেমার শেষে রহস্য রেখে দিয়ে। রাজভৃত্য ও বাহুবালির রক্ষাকারী কাটাপ্পা কেন বাহুবালিকে হত্যা করলো! যাকে সন্তানের মতো স্নেহ করতো তাকে কেন শেষমেশ খুন করতে হল! নোলানীয় কোন টুইস্ট না, স্রেফ আবেগীয় একটা প্রশ্ন। এই এক প্রশ্নই মাত করে রাখলো দর্শকদের ঠিক দুটো বছর। সেই রহস্য আর প্রশ্নই হয়ে উঠলো বাহুবালির মার্কেটিং টিমের প্রধান অস্ত্র। একটু আন্দাজ করলেই মোটামুটি ধরতে পারা টুইস্টটাই হু হু করে ছড়িয়ে গেল। ট্রলে, মিমে, অনুষ্ঠানে, আড্ডায় সবার একই প্রশ্ন- কাটাপ্পানে বাহুবালি কো কিউ মারা! পজেটিভ ওয়ার্ড অফ মাউথ ছড়াতে দেরি হয় নি। প্রথম বাহুবালি মুভি কামালো ৬৫০ কোটি রুপি প্রায়।
সেই ব্যবসাসফলতাই রাজামৌলী এন্ড গং কে উদ্বুদ্ধ করলো আরও বেটার কিছু করার। দুই সিনেমার জন্য বাজেট ৩০০-৩৫০ কোটি থেকে বেড়ে দাঁড়ালো ৪০০-৪২০ কোটি। প্রথম মুভি থেকে প্রায় ৭০-৮০ কোটি রুপি বেশি বাজেট দ্বিতীয় বাহুবালি মুভির। অর্থাৎ আরও অসাধারণ সব ব্যাটল সিন, সিনেম্যাটোগ্রাফি আর প্রেজেন্টেশন দেখতে পাবো বাহুবালি-২ তে। আর পাওয়া যাবে সেই বহুল আকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উত্তরও। এরই মাঝে বাহুবালি-২ এর ইতিহাস গড়ার সকল প্রস্তুতি নেয়া শেষ। ভারতের সর্বকালের সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা হতে যাওয়া বাহুবালি ফ্রাঞ্চাইজের ঘরে প্রথম মুভির ৬৫০ কোটি টাকা তো আছেই, দ্বিতীয় মুভি দিয়ে হয়তো ছুঁয়ে ফেলবে ১০০০ কোটি টাকার অসম্ভব মাইলফলকটিও। ইতিমধ্যেই টিভি সত্ত্বসহ নানা রকম সত্ত্ব বিক্রয় করেই আয় চারশ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, বাকি থাকেই আর কত? অনেক ট্রেড পন্ডিতরা আশা করছেন যে কেবল প্রথম দিনেই এই সিনেমার আয় হতে পারে সব মিলিয়ে ৯০-১০০ কোটি টাকা। কেন পারবেনা আয় করতে এতো! ভারতে সর্বকালের সবচেয়ে বেশি স্ক্রিনকাউন্ট প্রায় ৬৫০০ স্ক্রিন দখল করে নিয়েছি বাহুবালি ২। সবমিলিয়ে দেশ-বিদেশের প্রায় ৯০০০ স্ক্রিনে একযোগে রিলিজ পাচ্ছে বাহুবালি ২। ভারতের অনলাইন টিকিট বিক্রির ওয়েবসাইট বুক মাই শো জানিয়ে দিয়েছে যে ২৪ ঘণ্টায় তাদের সাইট থেকে প্রায় ১০ লাখ টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে এডভান্সড বুকিং এ। হারিকেন, সুনামি সবকিছুর জন্য প্রস্তুত তাই বক্স অফিস আর সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের মন।
এমনটা আর কখনো দেখা যায় নি। এমনটা হয়তো আর কখনো দেখা যাবার নয়। অপেক্ষার পালা শেষ। মুক্তি পেয়েছে ইতিহাস! বাহুবালির ইতিহাস!
লেখকঃ মেহেদী হাসান মুন। ক্রিয়েটিভ কন্টেন্ট অর্গানাইজার ও কন্টেন্ট ডেভেলপার।