টাইগারদের ১৩ দফা ও বিসিবি’রঅবস্থান: কোন পথে হাঁটছে দেশের ক্রিকেট

[আপডেট- আপাতত কেটে গেছে ক্রিকেটের সংকট। আজ রাতে আলোচনার পর ক্রিকেটারদের ১১টি দাবি মেনে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান। আজ যোগ হওয়া দুটি অতিরিক্ত দাবি (রাজস্বের ভাগ ও নারী ক্রিকেটারদের সম মর্যাদা) নিয়ে পরবর্তী সময় আলোচনার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি।- সূত্র- প্রথম আলো

বিনামেঘের বজ্রপাতের মতোই বাংলাদেশ ক্রিকেটের আকাশ অস্থির হয়ে উঠেছে। যদিও ক্রিকেট বোর্ডের সাথে ক্রিকেটারদের মনোমালিন্য আগেও দেখা গেছে কিন্তু জাতীয় ক্রিকেটারদের এরকম ধর্মঘট এই প্রথম। সাকিব-তামিমদের দাবিগুলো অবশ্যই যৌক্তিক কিন্তু তারা যে পথে হেঁটেছে সেটা পুরোপুরি সঠিক ছিল না। তার মানে এটাও নয় যে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ( বিসিবি) সভাপতি ক্রিকেটারদের প্রতি ক্ষোভে তাদেরকে অপমান করে কথা বলতে পারেন। এমনকি ক্রিকেটারদের এই ধর্মঘটকে ষড়যন্ত্র মনে করছেন নাজমুল হাসান পাপন। অপরদিকে, ক্রিকেটারদের কল্যাণের আন্তর্জাতিক সংগঠন ফিকা সাকিবদের পাশে দাঁড়ালেও নেই দেশের সংগঠন কোয়াব। এই ঘটনার সব দিক পর্যালোচনা করে দেখা যাক।

Source: BdCricTime

দেশের ক্রিকেটে এখন চলছে জাতীয় ক্রিকেট লিগ ( এনসিএল)। গত ১৭ অক্টোবর থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত দ্বিতীয় রাউন্ডের চারদিনের ম্যাচগুলো শেষ হয়েছে। পরবর্তী ম্যাচ শুরু হওয়ার কথা আগামী ২৪ অক্টোবর। আবার সামনেই বাংলাদেশের ভারত সফর। এই সফরকে সামনে রেখে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের ক্যাম্প শুরু হওয়ার কথা আগামী ২৫শে অক্টোবর। কিন্তু সেসবই এখন অনিশ্চয়তার মুখে। কারণ ক্রিকেটাররা যেমন দাবি না মানলে ধর্মঘটের সিদ্ধান্তে অনড় থাকার কথা বলেছেন, তেমনই মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সংবাদ সম্মেলনে দাবি না মানার ইঙ্গিতই যেন দিলেন। তার ভাষ্যমতে, বিসিবি আগেই থেকেই এইসব নিয়ে কাজ করে আসছে। যদিও সেসব খুব একটা দৃশ্যমান হয়নি!

খেলা কিংবা রুটিনমাফিক অনুশীলন না থাকলেও গত সোমবার (২১ অক্টোবর) প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন ক্রিকেটার মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে জমায়েত হন। হঠাৎ তাদের এই জমায়েত এবং নিজেরাই সাংবাদিকদেরকে তাদের সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে অবগত করায় বোঝায় যাচ্ছিল বড় কিছুর ঘোষণা আসছে। দুপুর দুইটার সময় তারা সংবাদ সম্মেলন ডাকলেও তিনটার পরে শুরু হয়। স্টেডিয়াম প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়েই দাবিদাওয়া তুলে ধরেন সাকিব-মুশফিকরা। তার আগে হোম অব ক্রিকেটের ইনডোরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন ক্রিকেটাররা। আগে বোর্ডে পেশ না করে, সংবাদ মাধ্যমে বলাটা অবশ্যই ভুল পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই তারা এসব প্রকাশ করলেও ঘটনা কিন্তু আকস্মিক নয়, ক্রিকেটারদের মধ্যে বহুদিনের জমে থাকা ক্ষোভের প্রকাশ মাত্র।

ক্রিকেটাররা তাদের এগারো দফা দাবির প্রথমটিতে, বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কল্যাণের জন্য গঠন করা কোয়াবের কার্যক্রমে তারা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। ক্রিকেটারদের সমর্থনে কোয়াব কাজ করে না বলে অভিযোগ তুলে নতুন করে এই কমিটি গঠনের দাবি জানানো হয়। ক্রিকেটাররা নিজেরা ভোট দিয়ে কোয়াবের সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচন করার দাবি জানিয়েছেন। মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) দীর্ঘ সময় ধরে বৈঠক করার পর পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিসিবি সভাপতি। তিনি সেখানে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, কোয়াবের ব্যাপারে বিসিবির কিছু করার নেই। অথচ কোয়াবের সভাপতি নাইমুর রহমান দুর্জয়, একজন বোর্ড পরিচালকও। আরেক বোর্ড পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজনও কোয়াবের শীর্ষ কর্তা। সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আছেন, ম্যাচ রেফারি ও কো-অর্ডিনেটর দেবব্রত পাল। তাদের এই চার বছর মেয়াদী কমিটির মেয়াদ ছয়/ সাত মাস আগে শেষ হয়ে গেলেও তারা এখনো পদ আড়কে আছেন। মঙ্গলবার দুপুরে পদত্যাগ করার কথা বললেও, ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে আবার পল্টি নেন।

blank
Source: BdCricTime

ঘরোয়া ক্রিকেটের মান ও পারিশ্রমিক নিয়ে তারা যে দাবিগুলো তুলেছেন সেখানে অযৌক্তিক কিছু নেই। কিন্তু এই ব্যাপারে নতুন করে কোনো কাজ না করার ইচ্ছায় প্রকাশ পেয়েছে নাজমুল হাসান পাপনের বক্তব্যে। বিসিএল, এনসিএল খেলার সময় একজন খেলোয়াড়কে দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করতে হয় বাস এমনকি ট্রেনেও। ভ্রমণক্লান্তি কাটিয়ে না উঠতেই আবার নেমে যেতে হয় মাঠে। একজন ক্রিকেটারকে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যেতে খরচ দেয়া হয় মাত্র ২৫০০ টাকা, তাদের প্রতিদিনের তিনবেলার খাবারের জন্য দেয়া মাত্র ১৫০০ টাকা। সাকিব যেমন উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, রাজশাহী থেকে কক্সবাজারে যাওয়ার জন্য মাত্র ২৫০০ টাকায় বাস ছাড়া আর উপায় থাকে না। জাতীয় দলের জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটাররা নিজ খরচে আকাশ পথে উড়াল দিতে পারলেও সবার ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব না। এভাবে চলে দিনশেষে ফিটনেস ধরে রেখে ভালো খেলা বেশ কষ্টকর তাদের জন্য। যদিও ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার জন্যও ফিটনেস টেস্ট দিয়ে উৎরে আসার নিয়ম করেছে বিসিবি, কিন্তু খেলোয়াড়রা পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। কিন্তু বোর্ড সভাপতির দাবি, তারা সর্বোচ্চ সুবিধা দিচ্ছে! ক্রিকেটারদের এই দাবি নিয়ে কথা বলার সময় তার রুদ্রমূর্তি দেখা যায়।

বেতন বাড়ানোর ইস্যু নিয়ে নাজমুল আগেও কয়েক দফায় বেতন বাড়ানোর উদাহরণ দেন। কেন্দ্রীয় চুক্তি তালিকায় ক্রিকেটারদের সংখ্যা নিয়ে তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশই সবচেয়ে বেশি ক্রিকেটারদের চুক্তিতে রাখা দেশগুলোর মধ্যে একটি। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে আরও বেশি খেলার অনাপত্তিপত্রের দাবি নিয়ে তো তিনি অলরাউন্ডার ফরহাদ রেজাকে রীতিমতো ছোট করে কথা বলেন। এই সময় তিনি ক্রিকেটারদের আরও ব্যক্তিগত ব্যাপারে সাহায্য করার কথা সংবাদ মাধ্যমের সামনে তুলে ধরেন। তিনি এমন আরও কিছু বলেন, যাতে ক্রিকেটাররা অপমানিত হন। অথচ এগারো দফা দাবি উল্লেখ করার সময় তারা বলেছিলেন, প্রাপ্য সম্মানটা অন্তত চান তারা। বোর্ড সভাপতির মতো বিচক্ষণ একজন মানুষের থেকে এই ধরনের কথা অপ্রত্যাশিত এবং দুঃখজনক। আগামী ২৫ অক্টোবর জাতীয় দলের ক্যাম্পে ক্রিকেটারদের যোগ দেয়ার ব্যাপারে নাজমুল যেভাবে, ক্রিকেটাররা আসলে আসুক না আসলে না আসুক বলেছেন সেটাও দেশের ক্রিকেটের জন্য দুঃখজনক।

ঘরোয়া ক্রিকেটে বলের মান বাড়ানো, পাতানো ম্যাচ নিষিদ্ধ করার যে দাবিগুলো বলা হয়েছিল তা নিয়ে কথায় বলেননি বোর্ড সভাপতি। কিন্তু দেশের ক্রিকেটের উন্নয়নে ও ভবিষ্যতের জন্য কিন্তু এগুলোই সবার আগে প্রয়োজন। সাকিব যেমন সেদিন বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই চাই ক্রিকেটের উন্নতি হোক। আগামী দিনে যারা খেলতে আসবে, তাদের জন্য ভালো একটি পরিবেশ রেখে যেতে চাই।’

blank
Source: Internet

দেশের ক্রিকেটের উন্নয়নের জন্য সবগুলো দাবি যৌক্তিক হলেও বোর্ডের সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট যে তারা এগুলোকে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলে মনে করছেন। বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট ও সিরিজে দারুণ পারফর্ম করেছে। ফলে দেশের ক্রিকেটের উন্নতি হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়েছে। হ্যা, মাঠে খেলোয়াড়দের পারফর্মে অবশ্যই উন্নতি হয়েছে কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়ন কিন্তু খুব একটা চোখে পড়েনি। জাতীয় দল কিংবা দলের আশেপাশে থাকা ক্রিকেটাররা মিরপুরের সুযোগ-সুবিধা পান কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্যান্য ক্রিকেটারদের সেই সুযোগ নেই। প্রতিটা বিভাগে জিমনেসিয়াম, সুইমিংপুল তৈরির দাবি জানিয়েছেন তারা। কিন্তু সে দাবি তো মানার কথা বলেইনি উল্টো সিলেটে যে একটি জিমনেসিয়াম করা হয়েছে শুধু উদাহরণ দিয়ে গেছেন বোর্ড সভাপতি। মিরপুর স্টেডিয়ামের ইনডোরে পরিবেশ বেশ আবদ্ধ। গ্রীষ্মে তো অবস্থা আরও খারাপ হয়। সেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের (এসি) ব্যবস্থা করার দাবি উঠে আসছে বছরের পর বছর কিন্তু এই সামান্য কাজটাও করতে দেখা যায়নি বিসিবিকে।

ক্রিকেটাররা শুধু তাদের নয় দেশীয় কোচ, আম্পায়ার, মাঠকর্মী, ফিজিও, ট্রেইনারদের বেতন বৃদ্ধির দাবিও জানিয়েছেন। বোর্ড সভাপতি বললেন তাদের্ও বেতন বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু একজন মাঠকর্মী সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে মাস শেষে পান মাত্র ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই সামান্য পরিমাণ টাকায় জীবনযাপন করা খুবই কষ্টসাধ্য।

সর্বোপরি, দেশের ক্রিকেটে অস্থির অবস্থা ও ক্রিকেটারদের ক্ষোভের পেছনে বোর্ডের অনিয়মও দেখা যাচ্ছে। দেশের ক্রিকেটকে বাঁচাতে হলে অবশ্যই দুইপক্ষকেই (বিসিবি ও ক্রিকেটার) সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

এদিকে আজ দুপুরে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান ও অন্যতম পরিচালক নাঈমুর রহমান। সেখান থেকে বিকেল সাড়ে তিনটায় তাঁরা গিয়েছেন বিসিবি কার্যালয়ে। তার আগে নাজমুল বলেন, ক্রিকেটারদের দাবি-দাওয়া মেনে নিতে তাঁরা প্রস্তুত।

সর্বশেষ দৈনিক প্রথম আলো’র প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, আগের ১১ দফা দাবির সঙ্গে আরও দুটি দাবি যোগ হয়েছে ক্রিকেটারদের। মোট ১৩ দফা দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে একটি চিঠি দিয়েছেন তারা। রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে কিছুক্ষণ আগে আন্দোলনরত ক্রিকেটারদের প্রতিনিধি ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদমাধ্যমের সামনে এই ১৩ দফা দাবি তুলে ধরেন।