উদভ্রান্ত যুগের শুদ্ধতম কবি শফিকুল ইসলাম। তারুণ্য ও দ্রোহের প্রতীক । তার কাব্যচর্চ্চার বিষয়বস্তু প্রেম ও দ্রোহ। কবিতা রচনার পাশাপাশি তিনি অনেক গান ও রচনা করেছেন। তার দেশাত্ববোধক ও সমাজ-সচেতন গানে বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকার।
শফিকুল ইসলামের জন্ম ১০ই ফেব্রুয়ারী, সিলেট জেলা শহরের শেখঘাটস্থ খুলিয়াপাড়ায়। তার পিতার নাম মনতাজ আলী। তিনি পেশায় একজন কাষ্টমস অফিসার ছিলেন। তার মাতার নাম শামসুন নাহার।
শফিকুল ইসলাম সিলেট জেলার এইডেড হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও মদন মোহন মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও সমাজকল্যাণে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। এছাড়া এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে এম,এ ইন ইসলামিক ষ্টাডিজ ডিগ্রী অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে শিক্ষাজীবনে অনন্য কৃতিত্বের জন্য স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন।
কর্মজীবনে একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা কবি শফিকুল ইসলাম চাকরীসূত্রে বিসিএস(প্রশাসন) ক্যাডারের একজন সদস্য। তার কর্মজীবনের শুরু কুষ্টিয়া ডিসি অফিসে সহকারী কমিশনার হিসেবে।তিনি ঢাকার প্রাক্তন মেট্রোপলিটান ম্যাজিষ্ট্রেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সাবেক এডিসি। এছাড়া ও তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তরে উপপরিচালক ছিলেন। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব, অর্থমন্ত্রণালয়ের ইআরডিতে উপসচিব পদে ও বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব। তিনি সরকারী কাজে যে সব দেশ ভ্রমণ করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বৃটেন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইনও সিঙ্গাপুর।

লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবনে স্কুল ম্যাগাজিনে লেখালেখির প্রচেষ্টা থেকে। থেকে। সেটি ছিল ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ। তখন কবি ক্লাস সেভেনে পড়েন। কাব্যচর্চা দিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৮০সালে সিলেটের মুসলিম সাহিত্য সংসদের উন্মুক্ত চত্বরে কবিতা পাঠের মাধ্যমে প্রথম জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ।মদন মোহন কলেজে পড়াকালিন তার সম্পাদনায় ‘স্পন্দন’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা বের হয়। আর সেই ম্যাগাজিনে তার প্রথম লেখা বের হয়। এরপর কলেজ ম্যাগাজিনে তার লেখা কবিতা ও গল্প প্রকাশিত হতে থাকে। চাকরীসূত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে কর্মকালীন সময়ে তার কবিতা ও গান বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে।পরবর্তীতে স্থানীয়, জাতীয় ও অনলাইন পত্র-পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়।
ছা্ত্রজীবনে ১৯৮১সালে তৎকালীন ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে দেশব্যাপী আয়োজিত সাহিত্য প্রতিযোগীতায় বাংলাদেশ পরিষদ সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত হন। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা থেকে লেখক সম্মাননা পদক ২০০৮প্রাপ্ত হন। সম্প্রতি তিনি নজরুল স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য বিভিন্ন পদকে ভূষিত হন।
আপাতদৃষ্টিতে তাকে অনেকে প্রেম ও বিরহের কবি হিসেবে আখ্যায়িত করলে ও তিনি যে একজন সমাজ-সচেতন কবি তা তার দহন কালের কাব্য ও প্রত্যয়ী যাত্রা কাব্যগ্রন্থ পাঠে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। সমাজের বিভিন্ন অসংগতি ও বৈষম্য যে তাকে সংক্ষুব্ধ করেছে, অনায়াসে তা উপলব্ধি করা যায়।
কবি শফিকুল ইসলামের হাতে প্রকৃতির সকল বৈচিত্র সমাহৃত হইয়া কবির হাতে নূতন রূপে রূপায়িত হইয়া উঠিয়াছে। তুণাঙ্কুর, ধুলিকণা, শিশিরকণাটি পর্যন্ত নব নব শ্রী ও সম্পদ লাভ করিয়াছে। কবি পাঠকের মনেও সৃজনী-মাধুরীর প্রত্যাশা করিয়া তাঁহার সৃষ্টিকে ব্যঞ্জনাময়ী করিয়াছেন- ছবির আদ্রা আঁকিয়া কবি পাঠককে দিয়াছেন তাহার নিজের মনের রং দিয়া ভরিবার জন্য। কবি কবিতাকে নব নব রূপ দান করিয়াছেন। তিনি নিজের সৃষ্টিকে নিজেই অতিক্রম করিয়া নূতন রূপসৃষ্টি করিয়াছেন। কবি নব নব ছন্দ আবিস্কার করিয়াছেন। তাঁহার বাগ-বৈভবে ও প্রকাশ ভঙ্গিমায় কবি মানসের যে একটি অভিনব রূপ তিনি প্রকাশ করিয়াছেন তাহা বিস্ময়কর।
তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থসমূহ
একুশে বইমেলায় বিভিন্ন সময়ে তার কাব্যগ্রস্থ প্রকাশিত হয়।এই ঘর এই লোকালয়(২০০০) প্রকাশিত হয় প্রবর্তন প্রকাশন থেকে । একটি আকাশ ও অনেক বৃষ্টি(২০০৪) প্রকাশিত হয় আমীর প্রকাশন থেকে। তবু ও বৃষ্টি আসুক(২০০৭) ও শ্রাবণ দিনের কাব্য (২০১০) প্রকাশিত হয় আগামী প্রকাশনী থেকে । দহন কালের কাব্য(২০১১) ও প্রত্যয়ী যাত্রা(২০১২) প্রকাশিত হয় মিজান পাবলিশার্স থেকে। গীতি সংকলন ঃ মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর(২০০৮) প্রকাশিত হয় আগামী প্রকাশনী থেকে। এছাড়া দেশে বিদেশে তার গ্রন্থাবলী নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে পাঠকের দৃষ্টি কেড়েছে এবং ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে।
সকল স্রষ্টার সৃজনীপ্রতিভা যে ভাবে ক্রমবিকাশ লাভ করে কবি শফিকুল ইসলাম প্রতিভার বিকাশও সেই ভাবেই হইয়াছে। প্রথম যৌবনে অন্তর্গূঢ় প্রতিভার বিকাশ-বেদনা তাঁহাকে আকুল করিয়াছে– তখন কুঁড়ির ভিতর কেঁদেছে গন্ধ আকুল হয়ে, তখন ‘কস্তুরীমৃগসম’ কবি আপন গন্ধে পাগল হইয়া বনে বনে ফিরিয়াছেন। প্রথম জীবনের রচনায় এই আকুলতার বাণী, আশার বাণী, উৎকন্ঠা, উচ্চাকাঙ্খা, সংকল্প, ক্ষণিক নৈরাশ্যে আত্মসাধনা, মহাসাগরের ডাক, বাধা বিঘ্নের সহিত সংগ্রাম ইত্যাদির কথা আছে।
বাস্তবিক কবি শফিকুল ইসলামের সমস্ত রচনার মধ্যে এই সীমাকে উত্তীর্ণ হইয়া অগ্রসর হইয়া চলিবার একটি আগ্রহ ও ব্যগ্র তাগাদা স্পষ্টই অনুভব করা যায়। যাহা লব্ধ তাহাতে সন্তুষ্ট থাকিয়া তৃপ্তি নাই, অনায়ত্তকে আয়ত্ত করিতে হইবে, অজ্ঞাতকে জানিতে হইবে, অদৃষ্টকে দেখিতে হইবে- ইহাই কবি শফিকুল ইসলামের কথা।
সাধারণ কবিদের মত তিনি ভাববিলাসিতায় ভেসে যাননি। ভাবের গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেকে অবলুপ্ত করে দেননি। প্রকৃত কবির মত তার কবিতায় কাব্যিক মেসেজ অনায়াসে উপলব্ধি করা যায়। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগতে পারে কি সে মেসেজ? তার কাব্যসৃষ্টিতে সাম্য, মৈত্রী ও মানবতার নিগূঢ় দর্শন অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মত প্রবহমান। তার ‘তবুও বৃষ্টি আসুক’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতায় কবি বলেছেনঃ-
তারও আগে বৃষ্টি নামুক আমাদের বিবেকের মরুভূমিতে,
সেখানে মানবতা ফুল হয়ে ফুটুক-
আর পরিশুদ্ধ হোক ধরা, হৃদয়ের গ্লানি…
(কবিতাঃ ‘তবুও বৃষ্টি আসুক’)
পংক্তিগুলো পাঠ করে নিজের অজান্তে আমি চমকে উঠি। এতো মানবতাহীন এই হিংস্র পৃথিবীতে বিশ্ব মানবের অব্যক্ত আকাংখা যা কবির লেখনীতে প্রোজ্জ্বলভাবে প্রতিভাত হয়েছে। এতো শুধু কবির কথা নয়, এতো একজন মহামানবের উদ্দীপ্ত আহ্বান। তার কবিতা পাঠে আমি অন্তরের অন্তঃস্থলে যেন একজন মহামানবের পদধ্বনি শুনতে পাই। যিনি যুগ মানবের অন্তরের অপ্রকাশিত আকাংখা উপলব্ধি করতে পারেন অনায়াসে আপন অন্তরের দর্পনে। তাই তিনি বিশ্ব মানবের কবি। বিশ্বমানবতার কবি।
লেখক : নিজাম ইসলাম, সাংবাদিক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে।