ক্লাব মিটিংটা সেরে জোরে জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল অন্বয়। আজ মদ্যপানটা একটু বেশিই হয়ে গেছে । অনিতা চলে যাবার পর নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে এই জীবনে আর মদ ছোঁবে না। কিন্তু আজ প্রতিজ্ঞা ভেঙে নিজেরই আবার খারাপ লাগছে। ন্যাশনাল হাইওয়ে এর উপর দিয়ে গাড়ির স্পীডোমিটারের কাটাটা বাড়ালো অন্বয়। জলদি ঘরে ফিরতে হবে। পূর্ণিমার আলোর সাথে রাস্তার ফ্লুওরোসেন্ত এর আলো মিলেলিশে কি সুন্দর দ্যাখাচ্ছিলো তখন। হঠাৎ চোখ গেল, আরে রাস্তার পাশে ঐ ভদ্রমহিলাটা কে! পাশে শোয়ানো একটা স্কুটার! আহারে পরে গেছে বোধ হয়। অন্বয় গাড়ি থেকে নেমে ওনাকে সাহায্য করতে গেল। “আরে শুনছেন , ব্যস্ত হবেন না; দাঁড়ান আমি তুলে দিছি” বলতে বলতেই, মহিলাটা ওর দিকে ঘুরে তাকাল আর সাথে সাথেই অন্বয়ের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা শিহরন খেলে গেল। এ ও কাকে দেখছে! এটা অনিতা না!! কিন্তু সেতো, না না এ হতে পারেনা। অনিতা দৌড়ে এসে অন্বয়ের হাতদুটো ধরল, “আরে শুনেছ ঋজুর একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে, খুবই করুণ অবস্থা; জলদি চল, রক্ত দিতে হবে। ঋজুটা আবার কে? একে অনিতা! তায়ে আবার ঋজু, অন্বয়ের মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল আর ফ্ল্যাশব্যাকে মনে পড়ে গেল ২০ বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই বিভীষিকাময় ঘটনা।
– “আর মদ খেওনা প্লিজ! আর খেওনা বলছি! আমি আছি তো তোমার সাথে, কি এমন দুঃখ তোমার?”.
– “সরো, সরো বলছি; চলে যাও এখান থেকে, চলে যাও, কাউকে লাগবে না আমার। “
অনিতা অনেক চেষ্টা করেছিল অন্বয়ের মদ ছারানোর কিন্তু পারেনি, নেশার রিপু যখন কাউকে গ্রাস করে কালের গতিবিধিও স্তব্ধ হয়ে যায়। মদ খেয়ে অন্বয়ের তখন কোনো হুঁশ থাকত না। কত শখ ছিল অনিতার যে ওদের দুজনের ফুটফুটে একটা বাচ্চা হবে। অন্বয় কোন কথা শুনলে তো। সারারাত মদের নেশায় চুর হয়ে শুয়ে থাকতো।এমনিতে ওদের অবস্থা খারাপ ছিলোনা। বাবার ইম্পোর্ট এক্সপোর্ট এর ব্যবসাটা অন্বয় বণিক একাই সামলেছে বলতে গেলে। আর্থিক দিক দিয়ে ধনীই বলতে হয়। কিন্তু ওই মদের নেশা সর্বনাশা। এদিকে অনিতারও জিদ ছিল মারাত্মক, অন্বয়ও মদ ছাড়বে না, আর অনিতাও না ছাড়িয়ে ছাড়বে না। এই নিয়ে যেদিন ঝগড়া একদম চরমে রাগের মাথায় শপাটে এক ছড় কশিয়ে দেয় অন্বয় অনিতার গালে। মেরেই বুঝতে পারে যে কি ভুল করেছে! সাথে সাথে ওই ঘর ছেড়ে চলে যায়। পরদিন যখন অনুতপ্ত হয়ে ঘরে ফিরেছে এক ফুলের তোরা হাতে নিয়ে ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ডাইনিং রুমে দেহটা ঝুলছিলো, হাতে একটা চিঠি, লেখা ছিল — “অন্বয় আমি তোমাকে দায়ী করছি না, ভাগ্যের কাছে আমি হেরে গেলাম। আমার আত্মমর্যাদা আমায় আর বেঁচে থাকার অনুমতি দিল না, অনেক স্বপ্ন ছিল তোমায়ে নিয়ে সুখেশান্তিতে ঘর বাঁধবো , যাই হোক আমার আক্ষেপ একটাই যে, তোমার নেশামুক্তি ঘটিয়ে, সন্তান সুখ দিয়ে যেতে পারলাম না, তবে আমার শেষ ইচ্ছেটা তুমি রেখো; অন্তত আমার মুখটার দিকে চেয়ে মদ খাওয়াটা ছেড়ে দিও। অনিতার সদ্য তাঁজা গোলাপি পাঁপড়ির মতো মুখটার দিকে চেয়ে অন্বয় পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল, মনে পরে গিয়েছিলো ওর উপরে করা প্রতিটি অবহেলার কথা, আকুল নয়নে কাঁদতে কাঁদতে দাঁতে দাঁত চিপে প্রতিজ্ঞা করেছিল আর জীবনে মদ ছোঁবে না। প্রায়শ্চিত্তও করেছে অন্বয়, কোর্টে গিয়ে পুরো দোষ নিজের নামে নিয়ে প্রায় বছর পনেরো হলো জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে, এর মধ্যে সে আর আগের অন্বয় নেই। এখন সে সংযমী এবং কঠোর অধ্যবসায়ী। বাবা মা আগেই গত হয়েছিলেন, নিজের হাতে এর মধ্যেই ব্যবসাটাকে পুরো দাঁড় করিয়েছে। কালকের একটা বড়োসড়ো কোম্পানির অফার একসেপ্ট করার পর বন্ধুরা একটা পার্টির বন্দোবস্ত করেছিল, সেখানেই পরশুরামের সংযমে চির ধরলো, আনন্দের আতিসয্যে পান করে বসলো কয়েক পেগ। অনেকদিনের অনভ্যাস; ফলে অল্পতেই মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করছে।
“আরে ঋজু আমাদের ছেলে গো!” অনিতার ডাকে আবার হুঁশ ফিরলো। এতো আচ্ছা মুশকিল! আমাদের আবার ছেলে হলো কবে? আর তুমিই বা কী করে। ..!! “আরে দুর দুর, অতো কথা সোনার সময় আর নেই; একরকম ঠেলেই গাড়িতে অন্বয়কে নিয়ে বসলো অনিতা, আর এস কে এম হাসপাতাল এর দিকে গাড়িটা নাও জলদি। যেতে যেতে নিজে থেকেই ঘটনাটা বলতে শুরু করলো, “আমি ছেলেকে নিয়ে আসছিলাম টিউশন থেকে, হঠাৎ করে একটা মারুতি ভ্যান বাঁক নিয়ে মারলো ধাক্কা, বিশাল কিছু নয়, আর তাতেই ঋজু রাস্তায় পরে রক্তারক্তি কান্ড। ওরাই আবার ওকে নিয়ে হাসপাতালে গেল, আর আমি আরেকটা গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করতে গিয়ে দেখি তুমি; ওগাড়িতে আর জায়গা ছিল না, আমি তোমাকেও কল করতে যাচ্ছিলাম ।” এতসব শুনতে শুনতে অন্বয়ের মাথাটা আবার গুলিয়ে যাচ্ছিলো, তবে কিছু একটা হচ্ছে যা ওর বোঝার বাইরে। ঠিক আছে, দেখাই যাক না শেষ পর্যন্ত কি হয় এই ভেবে, চুপ করে সব দেখে যেতে লাগলো ও। কথা বলতে বলতে হঠাৎই অন্বয়কে জড়িয়ে ধরলো অনিতা, “আচ্ছা শোনো না, ওর যেন কখনো কিছু না হয়, আমি থাকি বা না থাকি ঋজু কে কিন্তু তুমি রক্ষা করবে কেমন, প্রাণ দিয়ে হলেও আগলে রাখবে।” অন্বয়ের এবার একটু হাসি পেয়ে গেল, কে না কে এই ঋজু!, আচ্ছা এই মেয়েটা অনিতার সমদর্শী নয়তো? না না তা কি করে হবে? সেটা হলে অন্বয়কেই বা নিজের স্বামী বলে ভাববে কেন ? কিছু একটা গন্ডগোল আছেই যেটা আর এস কে এম এ গিয়েই পরিষ্কার হবে। যাই হোক অনিতার চেহারার করুণ অবস্থা দেখে অন্বয়ের বুকটা একটু মোচড় দিয়ে উঠলো। আজ যদি সত্যিই অনিতা থাকতো তাহলে ওই বহুতল বাড়িতে অন্বয়কে আর একা একা থাকতে হতো না। মাঝে মাঝে বড় খালি খালি লাগে। মদ ছেড়ে দেবার পর বন্ধুবান্ধবও তেমন আসেনা আর আরেকটা বিয়ের কথা অন্বয় কখনো ভাবেই নি। অজান্তেই চোখ দিয়ে কয়েকফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। অনিতা দেখতে পেয়ে বললো, “আরে দূর বোকা কাঁদছো কেনো? ঋজু ঠিক হয়ে যাবে দেখ, তুমিই ওকে বাঁচিয়ে রাখবে, আমি তাহলে চলি, কেমন?…..” কি??!! এই কথা শুনে অবাক হয়ে অন্বয় যখন ক্ষনিকের জন্যে চোখ ফিরিয়ে ছিল সামনের কাঁচ থেকে। হঠাৎ সামনের দিক থেকে চলে আসা একটা তীব্র আলো আর হর্নের জোরালো শব্দ তারপর আর কিছু মনে নেই।
জ্ঞান যখন ফিরলো, মাথায় প্রচন্ড ব্যথা, তখন চারিদিকে পুলিশে পুলিশে সয়লাব। আবছা আবছা মনে পড়লো তেরো নম্বর হাইওয়ে তে একটা টাটাসুমো আর ওর নিজের সেডান গাড়িটা যাচ্ছিলো , টাটাসুমোটা হঠাৎই নিজের গতিহারিয়ে আছড়ে পড়ে ওর সেডানের উপর; সেদান এর এয়ারব্যাগ এর মধ্যে সুরক্ষিতই ছিল অন্বয় কিন্তু সুমো কিছুক্ষণ পরেই যখন ব্লাস্ট করলো, ও সোজা ছিটকে গিয়ে পড়লো পাথরের রাস্তার উপর; ব্যাস! তারপর আর কিছু মনে থাকেনি, কিন্তু এতক্ষণ ও যেটা দেখছিলো সেটা কি স্বপ্ন!! শুধুই স্বপ্ন!! অনিতা এতটা রিয়েল, এতটা বাস্তবে ওর সামনাসামনি কোনোদিন আসেনি, কোনোদিন না, আজ ওর কথা বড় মনে পড়ছে। অন্বয়ের দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে এলো। “ঋজু বণিক..” হঠাৎ করে সামনের পুলিশটার এই ডাকে চমকে উঠে ও বলে ওঠে “কি বললেন, কি বণিক?”। পুলিশটা বলল “আর বলবেন না আরেকটা গাড়ির পাশেই ওর বডিটা পড়েছিল আইডি কার্ডে নাম দেখছি ঋজু বণিক।” ‘বডি!!’- অন্বয় নিজের মনে বিড়বিড় করে বলে ওঠে। “বডি মানে, ওই আরকি; এখনো প্রাণ আছে কিন্তু মা বাবা তো দেখছি স্পটডেড, কে বাঁচাবে ওকে, এখন হাসপাতালে নিয়ে যাও রে, রক্ত দাওরে ! অনেক হ্যাপা বুঝলেন “– পুলিশটা ভারিক্কি স্বরে বলে ওঠে। “বুঝলাম! আমিই ওর বাবা, নিন এবার নিজে উঠুন আর আমাকেও ওঠান, হাত পা নাড়িয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন”| ” আপনি ওর বাবা!” পুলিশটা অবিশ্বাসের সাথে তাকায় অন্বয়ের দিকে। নিজের আইডি কার্ডটা বাড়িয়ে দিতে দিতে অন্বয় বণিক এবার একটা ধমক লাগায় পুলিশটাকে। এতবড়ো একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে; এতক্ষণ এখানে বসে বসে কি মজা দেখছিলেন, না অপেক্ষা করছিলেন, আমরা যদি মরে যাই তাহলে কেসটা ক্লোস করে দিতে সুবিধা হবে বলে। ধমক খেয়ে আর অন্বয়ের এর আইডি দেখে পুলিশটা আর কথা বাড়ালো না চটজলদি একটা অ্যাম্বুলেন্স ডেকে দুজনকে তুলে দিলো আর এস কে এম এর পথে, ঋজু আর অন্বয় চলতে লাগলো চাঁদের আলোমাখা এক পথ দিয়ে। “কথা দিলাম অনিতা, যতদিন আমি বেঁচে আছি কিছু হতে দেবোনা এই শিশুটার, বুক দিয়ে আগলে রাখবো। আমার একাকিত্বের জীবনে তুইই আমার এক নতুন সাথী।” ঋজুর ছোট্ট সুন্দর মুখখানার দিকে চেয়ে অন্বয় একবাক্যে কথাগুলো বলে গেল। মাঝে সাক্ষী রইলো চাঁদ।
-অর্ণব দে সরকার, কলকাতা, পশ্চিম বংগ, ভারত