“মরণ সাগর পারে তোমরা অমর, তোমাদের স্মরি”

গল্প উপন্যাসে ঠাঁই না পাওয়া মুক্তিযুদ্ধের কিছু সত্যিকার গল্প : ‍সিরিজ-১

প্রতি বছরের মতো আবার এসেছে ১৬ ডিসেম্বর। বাঙালির বিজয় দিবস। বাঙালির এক আত্ম অহংকারের দিন। যুগ যুগ ধরে এই বাঙালি জাতি নানাভাবে শোষিত। পরাধীনতা তাদের শরীরে যেন জন্মতিলক হয়ে দেখা দিয়েছিলো যতদিন না বঙ্গবন্ধু নামে মহামানবের জন্ম হয়েছে।

আজ স্বাধীনতা দিবস ফেইস বুক আর স্ট্যাটাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমরা কতটুকু মনে রেখেছি সেসব মানুষদের, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই দেশ। আজ পর্যন্ত একটা ভালো চলচ্চিত্র পেলাম না যেখানে পরিপূর্ণভাবে ফুটে উঠেছে স্বাধীনতা সংগ্রাম। এখনো পর্যন্ত লেখা হয়নি এমন কোন উপন্যাস যেখানে স্বাধীনতাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।আমাদের প্রজন্ম যারা মুক্তিযদ্ধ দেখেনি তারা এমন এক পরিবেশে জন্মেছে যারা মুক্তিযুদ্ধকে সেভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে এসে আমরা এক নতুন দিগন্তের সন্ধান পেয়েছি। আমরা স্বাধীনতাকে পেয়েছি এক নবরূপে। আজকের এই লেখা তেমনি এক প্রয়াস।

আমাদের সবার জীবনে স্বাধীনতাযুদ্ধ নানাভাবে এসেছে যা লেখা থাকবে না কোন গল্প উপন্যাসে। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এরকম কিছু পরিবারের টুকরো টুকরো জীবন ছবি যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রেখে গেছে প্রত্যক্ষ ছাপ। স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলো কেমন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কেটেছে এরকম কয়েকটি পরিবারের সত্যিকার জীবনচিত্র আমরা ধারাবাহিকভাবে পাঠকদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

কাট্টলির নাথপাড়ায় নিরুবালার সে পরিবার

চট্টগ্রাম শহরের অদূরে কাট্টলিতে ৩১ মার্চ ১৯৭১ সালে ঘটেছিল এমন এক বর্বরতা। তিন ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে হরিপদ নাথ ও নিরুবালার সুখের সংসার। তিন ছেলের মধ্যে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের বি-কম শ্রেণির ছাত্র দুলাল এবং চট্টগ্রাম কলেজের অনার্সের ছাত্র বাদল ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি এবং ১১ দফার সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল। পাড়ায় তাদের বেশ পরিচিতিও ছিলো। তাদের দুইজনেরই কমন বন্ধু সুনীল যে তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতো একদিন বড় কবি হবে। সুনীলের সাথে এই দুই ভাইয়ের এমন ভালো বন্ধু ছিল যে দুজনের পরিবারের মধ্যে তাদের অবাধ যাতায়াত ছিল। হয়তো নিরুবালা মনে মনে ভেবেও নিয়েছিল তার বড় মেয়ের সাথে সুনীলের বিয়ের ব্যাপারে। হয়তো তা এক সময় চূড়ান্ত পরিণতিও পেতো। কিন্তু যুদ্ধের এক ঝাপটা চিরদিনের মতো এই নিরুবালার পরিবারটিকে তছনছ করে দিল। সেসময় কাট্টলি এলাকাটি ছিলো বিহারীদের দাপট।১৯৭১-এর ২৫ মার্চ। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে হালিশহর ইপিআর ঘাঁটি থেকে মেজর রফিকের নেতৃত্বাধীন ইপিআর বাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দক্ষিণ হালিশহরের লোকজন এ সময় ইপিআর বাহিনীর সদস্যদের নানাভাবে সহযোগিতা করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে পাক হানাদার বাহিনী। খবর পেয়ে ২৯ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বঙ্গোপসাগর উপকূল হয়ে দক্ষিণ কাট্টলীর ইপিআর ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হয়। পরদিন পাকবাহিনী নগরীর উত্তরে গহনা খাল এবং দক্ষিণে ইপিআর ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকা ঘিরে ফেলে। সামান্য অস্ত্র নিয়ে ইপিআরের পক্ষে পাক বাহিনীকে মোকাবেলা করা সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় অধিকাংশ ইপিআর সদস্য এলাকা ত্যাগ করলেও ৪০-৪২ জন মধ্যম নাথপাড়ার বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ৩১ মার্চ সকালের দিকে ১০ থেকে ১২ জন ইপিআর সদস্য নীরুবালার বাড়িতে আশ্রয় নেয়।  পরিশ্রান্ত ইপিআর  সৈন্যরা আবার আক্রমণের ভয়ে খাবার খেয়ে ঐ এলাকা ত্যাগ করে।  ঐদিন  দুপুরের দিকে  বিহারিরা জল্লাদ শওকতের নেতৃত্বে ৩১ মার্চ নাথপাড়ায় আক্রমণ চালায়। শুরু হয় গণহত্যা। বেছে বেছে হত্যা করতে থাকে তরুণ যুবকদের। নারী ও শিশুদের ঘরে আটকে রেখে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন । এই বিহারীদের একটি দল কিরিচ, কুড়াল নিয়ে আক্রমণ করে নিরুবালার বাড়িতে। তারা জওয়ানদের খবর জানতে চায় নিরুবালার কাছে।  নিরুবালার চোখের সামনে বিহারীরা তার দুই ছেলে দুলাল ও বাদলকে ধরে হত্যা করে। মায়ের সামনে এগারো দফা সমর্থনকারীদের এগারো টুকরো করতে থাকে। এরপর যা হলো তা চোখের স্বপ্ন দেখে নিরুবালা সহ্য করতে পারেন নি। টুকরো টুকরো হওয়া সন্তানের রক্ত দিয়ে জল্লাদরা তাদের মায়ের শরীর ভিজিয়ে দিতে থাকে। সন্তানের রক্তে মায়ের শরীর ভিজতেই মা অজ্ঞান হয়ে পড়েন।

বিহারী সেই জল্লাদরা অট্টহাসি দিয়ে বলতে থাকে,  ‘গোসল কর ছেলেদের রক্ত দিয়ে। তোদের জয় বাংলা বেরিয়ে যাবে’। এ সময় নিরুবালার পুরো শরীর দুই সন্তানের রক্তে ভিজে যায়।’
এতেই সন্তুষ্ট হয় না  জল্লাদরা। নিরুবালার স্বামী হরিপদ এবং তাঁর শ্বশুর খীরোদ বাঁশী নাথকেও নির্মমভাবে হত্যা করে পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠে। ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যায়। তুলে নিয়ে যায় তাদের বড় মেয়েকে। স্বাধীনতার বড় দাম দিতে হলো এই নিরুবালার পরিবারকে। এই নারীর জীবন কাহিনী লেখা হবে না কোন গল্প গাথাঁয়। এই সংগ্রামী নারীকে সশ্রদ্ধ সালাম।

এই সত্যিকার গল্পের একটি পাদ টীকা আছে। ৩১ মার্চের আগের রাতে সুনীলও ছিলো এই পরিবারের সাথে নানা গল্প আড্ডায়। হঠাৎ গল্পে উপস্থিত হয় নানা রাজনৈতিক চেতনা। মাও সেতুংয়ের সমাজতন্ত্র না কি লেলিনের বিপ্লব কোনটা আদর্শ হওয়া উচিত । এই তর্কের মধ্যে তিন বন্ধুর মধ্যে নানা কথা কাটাকাটি চলতে থাকে। হঠাৎ সুনীল রাগ করে মাঝ রাতে দুলালদের বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে পড়ে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে। নিরুবালার অনুরোধও তাকে টলাতে পারে নি। হয়তো বা বিধাতা সুনীলের জীবনকে দীর্ঘায়িত করার দায়িত্ব নিয়েছিলো। তা না হলে পরদিন হয়তো সুনীলও দুলাল, বাদলের মতো জল্লাদদের নির্মম শিকার হতো। তবে এই যুদ্ধ সুনীলের পরিবারের জীবনে এসছিলো, সে এক অন্য গল্প। হয়তো আমাদের ধারাবাহিক লেখায় তা তুলে আনার চেষ্টা করা হবে।

স্বাধীনতার দাম মানুষ এক জন্মে পরিশোধ করতে পারে না। বংশ পরিক্রমায় এই দাম পরিশোধ করতে হয়। সেই দাম পরিশোধ করা শুরু হয়েছে। আমাদের আশে পাশেই এমন অনেক নিরুবালা ছড়িয়ে রয়েছে যার সন্ধান আমরা এখনো পায়নি বা জানি না। ছোটবেলায় আমাদের দাদা-দাদী, নানা-নানীর মুখে এই ধরনের অনেক নিরুবালার গল্প শুনেছি বা আমাদের দাদী-নানীও হয়তো এক একজন নিরুবালা। আমাদের সবারই উচিত মুক্তিযুদ্ধের এইসব সত্যি গল্প সংরক্ষণ করা। তা না হলে বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ যে একটি গণযুদ্ধ ছিলো, তা আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কখনোই বলতে পারবো না।

মুক্তির মন্দির সোপান তলে            কত প্রাণ হলো বলিদান,

লেখা আছে অশ্রুজলে৷
কত বিপ্লবি বন্ধুর রক্তে রাঙা,          বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙা
তাঁরা কি ফিরবে না আর?             তাঁরা কি ফিরবে এই সুপ্রভাতে-
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে৷

যারা স্বর্গগত তারা এখনো জানে,         স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি
এসো স্বদেশ ব্রতের মহা দীক্ষা লভি,       সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ চুমি
যারা জীর্ণ জাতির বুকে জাগালো আশা,    মৌন মলিন মুখে জাগালো ভাষা
আজ রক্তকমলে গাঁথা                আজ রক্তকমলে গাঁথা মাল্যখানি,
বিজয়লক্ষী দেবে তাঁদেরি গলে।