বিচিত্রময় পৃথিবীর বৈচিত্রতার ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ করা বা পৃথিবীময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাপকাঠি করা কোনদিনও সম্ভব নয়। আর এটিই সবচেয়ে বড় অমীমাংসিত রহস্য। এমন এক রহস্যেঘেরা অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক নিদর্শন হচ্ছে ‘আয়ারস রক’।
ভৌগলিকাবে আয়ারস রকের অবস্থান অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ নর্দার্ন টেরিটরিতে। উলুরু বা আয়ারস রক নামে পরিচিত একে একটি টিলাও বলা যায়। দেখতে অনেকটা ডিম্বাকৃতির এই আয়ারস রক (Ayers Rock) হল এমন এক পাহাড় যা গিরগিটি বা অক্টোপাসের মত ক্ষণে ক্ষণে নিজের রং বদল করে থাকে। অপূর্ব সৌন্দর্যে ভরপুর পাহাড়টি। পাহাড়টির মনোমুগ্ধকর বাহারী রঙের পরতে পরতে রহস্য ছড়িয়ে দেয়। এমন বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যের জন্য অনেকেই একে জাদুর পাহাড়ও বলে থাকেন। দেখতে ডিমাকৃতির এ পাহাড়টির উচ্চতা ৩৪৮ মিটার, দৈর্ঘ্য ৭ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ২.৪ কিলোমিটার।
১৮৭৩ সালে ডাব্লিউ জি গোসে নামক একজন ইংরেজ পর্যটক এ পাহাড়টি প্রথম আবিষ্কার করেন। তখন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হেনরি আইয়ার। তাঁর নাম অনুসারেই পাহাড়টির নামকরণ করা হয় আইয়ারস রক। পাহাড়টি বেলে পাথর দিয়ে তৈরি। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল দিনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রং ধারণ করা। প্রধানতঃ সূর্যের আলোর উপর নির্ভর করেই এই পাহাড়ের রং বদলায়। পাহাড়টির স্বাভাবিক রং হচ্ছে লালচে কমলা। প্রধানত লাল রঙের বেলেপাথরের এই পাহাড়টি দিনের বিভিন্ন সময়ে কমলা,খয়েরি, হলুদ,মেরুন ইত্যাদি বিভিন্ন রং ধারণ করে। সূর্যরশ্মির আপতন কোণের পরিবর্তনের সাথে পাল্লা দিয়ে এর রঙেরও পরিবর্তন হয়ে থাকে। তবে এর দৃষ্টি আকর্ষক রং বদলটি ঘটে থাকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়।
সকালে সূর্যের আলোর বিচ্ছুরণ পাহাড়ের গায়ে পড়লেই মনে হয় বুঝি আগুন ধরেছে পাহাড়টির গায়ে। বেগুনী ও গাঢ় লাল রঙয়ের শিখা বের হয়ে আসে পাহাড় থেকে। কেবল সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের সময়েই নয়, বরং সারাদিনই চলে রং বদলের এ রঙ্গ তামাশা। সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের সময় সূর্য রশ্মিতে লাল ও কমলা রঙের আধিক্য থাকে বলে এ সময় পাহাড়টিকে লাল কিংবা কমলা মনে হয়। দুপুরের দিকে সূর্য রশ্মিতে অন্যান্য রঙের প্রাধান্য থাকার ফলে ক্ষণে ক্ষণে পাহাড়টিরও রং বদলে যেতে থাকে।পাহাড়টি প্রথমে হলুদ থেকে কমলা, পরে লাল ও মাঝে মাঝে বেগুনী আবার কখনও গুমোট কালো রং ধারণ করে থাকে। পাহাড় জুড়ে চলে অদ্ভূত রহস্যের আনাগোনা। রঙ রহস্যের আয়ারস রকের মাধুর্যতা মুগ্ধ এবং বিস্মিত করে যে কোন মানুষকে। আসলেই রহস্যময় এবং অদ্ভুত সুন্দর। এই পাহাড়টি সম্পূর্ণই একটি প্রস্তর খণ্ড। এর গঠনটাও বেশ অদ্ভুত।
পাহাড়টির রং বদলের রহস্য নিয়ে বিভিন্ন মতবিরোধ রয়েছে। অনেকে মনে করেন সব রহস্য লুকিয়ে আছে পাহাড়টির ভৌগলিক অবস্থানের উপর। ধারণা করা হয় পাহাড়ের নিচে কোন ম্যাগনেটিক ফিল্ড আছে। যার কারণেই বিভিন্ন এ্যাঙ্গেলে সূর্যের আলো পাহাড়টিতে পড়ার সাথে সাথে পাহাড়ের রং ও বদলে যাচ্ছে। অবশ্য অনেক কল্প কাহিনীও প্রচলিত আছে এই পাহাড়কে ঘিরে। স্থানীয় অধিবাসীরা মনে করে, এই পাহাড়ে নাকি এক সময় জাদুকরেরা বসবাস করত। তারাই জাদু মন্ত্র দিয়ে এমন কিছু করে যাবার ফলে এমন অদ্ভূত রকম সৌন্দর্য এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্য বহন করছে পাহাড়টি। অস্ট্রেলিয়ার আদি বাসিন্দাদের কাছে এটি একটি পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত। ঘন ঘন রং বদলের কারণে স্থানীয় উপজাতিরা পাহাড়টিকে ভগবানের আবাসস্থল ভেবে থাকে। পাহাড়টির গোড়ায় অবস্থিত গুহায় স্থানীয় লোকজন পূজা অর্চনাও করে থাকে। ঐতিহাসিক দিক থেকেও অবশ্য এই পাহাড়টির গুরুত্ব কম নয় কারণ এই পাহাড়টির গুহায় প্রাচীনকালের বেশ কিছু চিত্রকর্মের নিদর্শনও পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু আসল রহস্য এখনও গবেষক বা বিজ্ঞানীদের পক্ষে বের করা সম্ভব হয়নি তবে এইটুকুতেই শুধু তাঁরা সন্তুষ্ট বসে নেই।
প্রতিনিয়ত অগণিত পর্যটক আসে আয়ারস রক পাহাড়টি একনজর দেখার জন্য এর অপরুপ সৌন্দর্য অবলোকন করার জন্য। বিভিন্ন গবেষক দলও আসেন পাহাড়টির রহস্যময় রং বদলের কারণ খুঁজতে। তাই পর্যটকদের পরিদর্শণের সুবিধার্থে অস্ট্রেলিয়ান সরকার পাহাড়টির আশেপাশে ৪৮৭ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে ‘মাউন্ট ওগলা ন্যাশনাল পার্ক’ গড়ে তুলেছেন। যেখানে ক্যাঙ্গারুসহ অনেক বিরল প্রজাতির জীবজন্তু ও গাছপালা দেখতে পাওয়া যায়।
তথ্যসুত্র: ইন্টারনেট