’১৩-র শেষদিকের কথা। বন্ধু নিলয়ের সাথে আলাপ হচ্ছিল কার কোন লেখককে ভালো লাগে সেসব নিয়ে। অন্য আরো কয়েকজনের সাথে ও মোঃ ফরহাদ চৌধুরী শিহাবে’র নাম বলল। তার প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘অমিয়েন্দ্র’ সংগ্রহ করে পড়া শুরু করে দিলাম। আর সাথে সাথে আমি এক অদ্ভুত মোহের ঘোরে ডুবে গেলাম। গত কয়েক বছর ধরেই ডুবে আছি তাতে। কতো বছর জানেন? চার চারটে বছর! সেই মোহজালের উৎসের ব্যাপারে জানাবো আজ।
অমিয়েন্দ্র
গল্পটা একজন সাদামাটা, কিন্তু মিষ্টি চেহারার মেয়ে নূসরাতের, একজন পাগলাটে অমিতের, একজন মাতাল কিন্তু অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা সম্পন্ন জহর শেখের। গল্পটা দ্বিতীয় দলের মানুষ মোনেম খানের।
অমিতের খুনসুটিতে ভার্সিটি লাইফ কাটানো নুসরাত কখনো বুঝতেই পারেনি, কখন যেন এই আধপাগল ছেলেটা ওর অংশ হয়ে গেছে। বেঁচে থাকতে যতোটা না বুঝেছে, তারচেয়েও বেশি বুঝেছে মারা যাওয়ার পরে…
… কী? খুব সাদামাটা কাহিনি মনে হচ্ছে? আদতে মোটেও তা নয়!
বইটা পড়তে শুরু করেই কেমন অদ্ভুত তৈরি অনুভূতি হবে। যেমনটা আমার হয়েছিল। কেমন তোলপাড় করছিলো মনটা জুড়ে। চাপ চাপ ব্যথা অনুভব করছিলাম। রবীন্দ্রনাথের কবিতার ওই সুখের মতো ব্যথাই। কেমন শিরশিরে অনুভূতি। অযথাই বারবার চোখে বাষ্পায়ন হয়।
প্রেমে পড়ে গেলাম। অমিয়েন্দ্র, অমিয়েত্রা দুজনের উপরই। কী মিষ্টি একটা প্রেম! পুরো বইয়ের প্রতিটা পাতা জুড়ে পাওয়া আর না পাওয়ার আক্ষেপ যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে! এই আক্ষেপের জন্যই কি আমার এতো ভালোলাগা? মেঘলা আবহাওয়ায় শো শো বয়ে যাওয়া বাতাসে কান পাতলে আমি যেন শুনতে পাই, “অমিয়েত্রা… অমিয়েন্দ্র ঘুরে বেড়াবে তোমার জগৎ জুড়ে… আমি তোমার জগৎময় ঘুরে বেড়াই… যেখানেই তোমার নিঃশ্বাস পড়েছে, সেখানেই আমার পদচারণা ঘটবে অন্য সবার আগে…”
এমন একটা বই “আউট অফ প্রিন্ট” শুনলেই বুকের পাশে হাহাকার শুরু হয়। লেখক মোঃ ফরহাদ চৌধুরী শিহাব নিশ্চয়ই জানেন না “অমিয়েন্দ্র” আসলে কোন লেভেলের বই। পাঠকের কাছে বইটা ঠিকমতো পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা উচিৎ। এতো আগে প্রকাশিত বই, এতোদিন কেন এটা আলোচনায় আসে নি সেটাই ভাবছি। নিভৃতচারী লেখক বলেই কি? কতো কতো লেখকের কতো কতো বই পড়েছি। আমার পড়া হাজার হাজার চরিত্রের মধ্যে প্রিয় মেয়ে চরিত্র হলো মাসুদ রানা সিরিজের “সোহানা”। প্রিয় চরিত্র হলেও রানা-সোহানা পড়ার সময় কখনো মনে হয়নি, “যদি সোহানার মতো হতে পারতাম!” কিন্তু এই অমিয়েন্দ্র-অমিয়েত্রা পড়ে মনে হয়েছে- “ইসসস, আমি যদি এই উপন্যাসের নুসরাতের মতো একজন অমিয়েত্রা হতে পারতাম!”
অমিয়েত্রা
গত শতকের এক জমিদার পরিবারের গল্প- অমিয়েত্রা। যে পরিবারের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭০-৮০ বছর ধরে সমান সমান। কখনো বাড়েও না, কমেও না। এক রহস্যজনক কারণে যেদিনই এই পরিবারে কোনও নবজাতকের জন্ম হয়, সেদিনই কোনও না কোনও বয়োজ্যেষ্ঠ মারা যান। প্রায় এক শতাব্দী আগে এই বংশে একজন অশরীরী অমিয়েত্রা এসে ঠাঁই নিয়েছিলো। তারই ধারাবাহিকতায় পরিবারটিতে একজনের পর একজন অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাধর অমিয়েত্রা জন্মে গেছে…
প্রশ্ন জাগতে পারে, অমিয়েত্রা কী? অমিয়েত্রা কারা?
একজন অমিয়েত্রার বরের ভাষায়, “অমিয়েত্রা হলো তারাই, যারা প্রচন্ড ভালোবাসতে জানে, কিন্তু প্রকাশ করে না”
শত্রুদের ভাষায়, “অমিয়েত্রা হলো অমঙ্গল, অশুচি, অলৌকিক অশুদ্ধতা…“
আর একজন অমিয়েত্রার ভাষায়-
“আমারে ডাকিছো বিষাদে-বিবাদে
দো-পারের তরে লাগি,
এইক্ষণ আর ত্রিভুবন যেন
সভয়ে লুকায়ে রাখি।
তোমার আঙ্গিনা ঘুরিছি ফিরিছি
মাটির ওপরে দাঁড়ায়ে,
আমি জন্ম, আমি মৃত্যু- আমি
ডাকিতেছি হাত বাড়ায়ে।
তুমি ভয় আর অতি জিজ্ঞাসে খুঁজো
আমার অর্থ কী?
আমি তোমার অতীতে সুদূর লুকানো
তোমারই রজনী।
আমি অমিয়েত্রা…”
এই বইটা কাহিনি সংক্ষেপ লেখার মতো বই না। শুধু খুব ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে বলতে পারি। দা-কুমড়া সম্পর্ক থাকা বৌ- শাশুড়ির শাশুড়িটা যখন মারা যায়, তখন বৌয়ের মনে যদি নিখাদ শূন্যতা ফুটিয়ে তোলা যায়, হাহাকারে বৌটার মন ভরে ওঠে, সেই সাথে পাঠকের, ওই বইটা নিশ্চয়ই সাধারণ কিছু নয়?
অমিয়েত্রার জন্য লেখকের নিজ হাতে আঁকা ছবি, লেখকের চোখে অমিয়েত্রা ও জমিদার বাড়ি
এটা এমন এক বই, যেটা হাতে নিয়ে আমার মতো ঘুমকাতুরে মেয়ে, প্রথমবারের মতো সারারাত না ঘুমিয়ে বই পড়েছি।
এটা এমন একটা বই, যে বই সাড়ে তিনশ পৃষ্ঠার মোটামুটি বিশাল কলেবরের হলেও, পড়তে পড়তে মনে হবে, শেষ হয়ে যাচ্ছে কেন বইটা? বইটা পড়লেই তো শেষ হয়ে যাবে। এটা আমি জমিয়ে রাখতে চাই, যেন শেষ না হয়। আবার দুর্বার আকর্ষণে না পড়েও থাকতে পারিনি।
কবিতা আমি আগে একদমই পড়তাম না। এখন পড়লেও খুব বেছে বেছে পড়ি। কিন্তু অমিয়েন্দ্র-অমিয়েত্রায় কাহিনির সাথে কবিতার যে সামঞ্জস্য, খুব করে ছুঁয়ে যায়। অদ্ভুত এক আবেশে ডুবিয়ে রাখে। মায়া, ঘোর, ভালোলাগা- কোনও বিশেষণই যেন পরিপূর্ণ হয় না এই দুটোর ক্ষেত্রে। অমিয়েত্রা-অমিয়েন্দ্রকে আমি এতো বছরেও ভুলতে পারছি না!
ক্যাথেড্রাল
চিরতন, হরত্ রুইতন, ইশকাবন- তাসের চার পাতার মত এই বইয়ের মলাটের ভেতর রয়েছে চারটে ভিন্ন স্বাদের অতিপ্রাকৃত গল্প।
প্রথমেই রয়েছে আধিভৌতিক গল্প “অমীমাংসিত”। গল্পে কথক ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত বাস্তবোচিত স্বপ্ন দেখেন। এরপর তার স্বপ্নে দেখা জায়গাগুলো খুঁজে পান। স্বপ্নের সেই জায়গায় পা রাখতেই আরোও অদ্ভুত বিচিত্র সব ঘটনা ঘটতে থাকে। কী ঘটনা, সেটা বলা যাবে না। ২০ পৃষ্ঠার বড়গল্পটা শেষ করে আপনার মনেই হবে না, আপনি কোনও বড় গল্প পড়েছেন। মনে হবে এট্টুখানি একটা গল্প পড়েছেন খালি!
এরপর রয়েছে রহস্য ও আধিভৌতিকের মিশ্রণে বড় গল্প- “চতুরঙ্গ”। গল্পকথক অদ্ভুত পাগলাটে এক চিকিৎসক-লেখিয়ে ডা. এমরানের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালার কিউরেটর হবার ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছেন। সেই চিকিৎসক-লেখিয়ে’র ঘরটাও বড় অদ্ভুত। ঘরের সিলিং জুড়ে দাবা বোর্ড। আর বোর্ডে দাবার বিশাল ঘুঁটিগুলো উলটো হয়ে ঝুলছে…
গল্পকথক একজন ডাক্তার হয়েও কেন এই চাকরি করতে চাইছেন, এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে ডা. এমরান তাকে রিফিউজ করতে চাইলেন, কিন্তু যেচে পড়ে চাকরিটা নিয়ে গল্পকথক মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছেন। চুয়াল্লিশ পৃষ্টার এই বড় গল্পটি অনায়াসে একটা উপন্যাসিকা হতে পারতো… এক নিমিষেই পড়ে ফেলেছি।
তিন নাম্বারে রয়েছে আরোও একটি আধিভৌতিক গল্প- “আঁধিয়ার”। গ্রামের পটভূমিতে গড়ে ওঠা আরো একটি রহস্যময় গল্প। আঁধিয়ার মানে হলো বর্গাচাষী। যে আঁধিয়ারকে নিয়ে গল্পটা, সে একদিন জমি খুঁড়তে গিয়ে একটা শিবমূর্তি আবিষ্কার করে। আরোও কয়েকজন চাষীকে সাথে নিয়ে মাটি খুঁড়ে শিবমূর্তি বের করে সে। খোঁড়ার সময় শিবমূর্তির কাঁধে কোদালের কোপ লাগে। ওটুকু লাগতেই পারে, স্বাভাবিক। কিন্তু কদিন বাদেই যখন সেই আঁধিয়ারের কাঁধে আপনা-আপনি ওই একই রকম ক্ষত তৈরি হয়ে রক্ত ঝরাটা তো স্বাভাবিক না!
এই ক্ষত ডাক্তার কোনভাবেই সারাতে পারলো না। আঁধিয়ারের শরীরে পচন ধরে গেল। একমাস রোগে ভুগে, সে মারা গেল। এবং তারপরেই ঘটতে শুরু করলো আসল ঘটনা! বাকি তিনটের তুলনায় এটাই সবচেয়ে ছোট গল্প, মাত্র সতেরো পৃষ্টা!
সবশেষে রয়েছে অ্যাডভেঞ্চার, আধিভৌতিক, প্রত্নতত্ত্ব আর রহস্যের মিশেলে টেকনো উপন্যাসিকা “ক্যাথেড্রাল”। ফরেস্ট অফিসার বন্ধুর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মাহিনকে নিয়ে খাগড়াছড়ির পাহাড়ি এলাকায় এলো মেজর রবি। কেন যেন বন্ধু বার বার করে বলে দিয়েছিলো মাহিনকে নিয়ে আসতে। এখানে আসার পর জানা গেল আসল কাহিনি। ওই এলাকায় পাহাড় ভেঙে মাটির নিচ থেকে বের হয়েছে রোমানদের ক্যাথলিক চার্চের মত দেখতে অবিকল একই রকম একটি স্থাপনা। বৃষ্টিভেজা পাহাড়ের পিচ্ছিল বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে ওটা দেখতে গেল। ওখানে গিয়ে দেখলো, স্থাপত্যের ছাদ জুড়ে রয়েছে ভ্যাটিক্যানের ক্যাথেড্রালের মতো অবিকল একই রকম চিত্রকর্ম আঁকা। উপরি হিসেবে রয়েছে অসংখ্য মূর্তি। মূর্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে ইতিহাসের চার বিখ্যাত রাজা- কিং ডেভিড, আলেক্সান্ডার দি গ্রেট, চার্লস দি গ্রেট, জুলিয়াস সিজার এবং একজন রহস্যময় বামনের মূর্তি। কে এই বামন?
জায়গাটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রচুর আর্মি নিয়োগ দেওয়া হলেও প্রতিনিয়তই চুরি হচ্ছে। এমনকি একজন আর্কিওলজিস্ট খুনও হয়ে যান। মোটামুটি রবি আর মাহিন মিলে সব রহস্যের সমাধান প্রায় করেই ফেলেছিলেন, ঠিক তখনই ভয়াবহ এক দুর্যোগ নেমে আসে এই নকল ক্যাথেড্রালের উপর!
একটা আধিভৌতিক অ্যাডভেঞ্চার কী করে এতো মায়া ধারণ করতে পারে, আমার জানা নেই। একবার শুরু করলে শেষ না করে উঠা যাবে না। প্রধান চরিত্রগুলো বেশ ভালো লেগেছে। মাহিন-রবির হালকা পাতলা রোমান্টিকতা বেশ উপভোগ্য। লেখার সাথে সাথে আঁকার হাতও দারুণ এই লেখকের। চমৎকার কিছু ছবি তৈরি করে ক্যাথেড্রাল বইয়ের গল্প চারটার সাথে জুড়ে দিয়েছেন তিনি।
উপরের তিনটির বাইরেও লেখক মোঃ ফরহাদ চৌধুরী শিহাবে’র আরো একটি প্রকাশিত বই আছে- ‘ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া’। বইটি শিশুতোষ ঘরানার হওয়ায় এই পোস্টে তাই এর কথা বাদ দিলাম। তবে তার সব বইয়ের ক্ষেত্রেই একটা কথা না বললেই নয়, তার লেখায় প্রথমেই যে জিনিসটা মন কাড়বে, তা হলো তার মায়াকাড়া লেখনি। অদ্ভুত মায়াঘোর পাওয়া যাবে এর প্রতিটি পাতায়। নিখুঁত বর্ণনায় বইয়ের প্রতিটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ডিটেইলিংয়ের কাজটা লেখক এমনভাবে করেন, বর্ণনা পড়ে মোটেও একঘেয়ে লাগে না। ডায়লগ আর বর্ণনায় হালকা হিউমারও থাকে, পড়তে বেশ লাগে। এই বইগুলোকে প্রচলিত কোন জনরা বা বিভাগের কাতারে ফেলা যাবে না! আমি উনার এই জনরার নাম দিয়েছি- “মায়া-আধিভৌতিক”। উনার লেখায় অতিপ্রাকৃত ব্যাপারগুলোর সাথে সাথে প্রবল মায়া, ঘোর, ভালবাসা আর মোহ থাকে বলেই এই নাম। এক একটা বই শেষ করে আচ্ছন্ন হয়ে বসে থাকতে হয়, দীর্ঘসময়। এরকম করে আর কেউ কখনো লিখেনি।
হালের “ক্রাশ” জাতীয় কোনও অনুভূতি নয়। তবে হ্যাঁ, অমিয়েন্দ্র-অমিয়েত্রার মতো তাদের স্রষ্টাকেও আমি ভালোবাসি!