আজকাল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর হোম পেজ স্ক্রল করার সময় প্রায়ই একটা ছবি চোখে পড়ে। ছবিটা অনেকটা এরকম যে, চারদিকে পানিবেষ্টিত দ্বীপের মতো এক টুকরো জায়গায় অসম্ভব সুন্দর একটা বাড়ি। ছবিতে লেখা থাকে, “খাবার আর পানি পেলে এই বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি, মোবাইল, ইন্টারনেট ছাড়া ছয়মাস কাটাতে পারবেন?”
কেউ কেউ মন্তব্য করে, বই পেলেই থাকতে পারবো এখানে। কেউবা বলে ফিশিং করে, সুইমিং করেই ওখানে খুব ভালো সময় কাটাতে পারবেন।
যারা এই মন্তব্যগুলো লেখেন, তারা হয়তো ভাবেনই না যে এরকম কোনও সুযোগ সত্যি সত্যিই তার কাছে আসতে পারে। কিন্তু আমি যদি বলি এরচেয়ে ভালো ফ্যাসিলিটি দিয়ে ছবির মতো সুন্দর জায়গায় থাকার সুযোগ আছে? উপরন্তু ওখানে থাকতে গেলেই পাবেন নগদ অর্থ!
কী? চমকে গেলেন? এমনটাই অফার করছেন ইটালির বোরমিদা গ্রামের মেয়র।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না; এককথায় অপরূপ। এখানকার মতো নয়নাভিরাম সূর্যোদয়ের দৃশ্য ধরার খুব কম জায়গা থেকেই প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রকৃতির সৌন্দর্যপিপাসুদের জন্য এটি হতে পারে তীর্থস্থান। তবুও সেখানে মানুষজন বিরল; শতচেষ্টা করেও বাড়ানো যাচ্ছে না মানুষের সংখ্যা, বরং প্রতিবছর তা কমছেই। সংখ্যা কমতে কমতে একসময় নিঃশেষই হয়ে যায় কি-না, সে শঙ্কাও অবান্তর নয়। বলছিলাম, ইতালির পর্বতবেষ্টিত ছোট্ট গ্রাম বোরমিদা’র কথা।
https://www.youtube.com/watch?v=ofv76u4pUG4
স্থানীয় মেয়র দ্যানিয়েল গ্যালিয়ানো জনসংখ্যা আর অর্থনীতির বিষয়ে নিজ শহরের এ করুণাবস্থা আর সইতে পারছেন না। এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে চালিয়ে যাচ্ছেন অবিরাম চেষ্টা। এ জনপ্রতিনিধি কোনো কিছুতেই আর ত্রুটি রাখছেন না। শেষমেশ শরণাপন্ন হয়েছেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর। সেখানে নয়নাভিরাম সূর্যোদয়ের দৃশ্য পোস্ট করার পরেও আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছেন না দেখে সুচতুর মেয়র বেছে নিয়েছেন অভিনব এক কৌশল। মাত্র ৩৯৪ জনের প্রতিনিধি হওয়ার কারণে তিনি প্রস্তাব রেখেছেন, নতুন করে কেউ তাঁর শহরের বাসিন্দা হতে চাইলে তিনি পাবেন নগদ দুই হাজার ইউরো!
বিশ্ব ম্যাপে ছোট্ট শহর বোরমিদা
মেয়র আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে লোকজনকে নিজ শহরের প্রতি আকৃষ্ট করতে চাইছেন। নগদ অর্থের পাশাপাশি ইচ্ছুক ব্যক্তিকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য দেয়া হবে প্রশস্ত একটি কক্ষ, যার মাসিক ভাড়া মাত্র ৫০ ইউরো। অথচ ইউরোপের অন্য যে কোনো স্থানে এমন একটি কক্ষে থাকতে হলে প্রতি মাসে গুনতে হবে কমপক্ষে ১২০ ইউরো। যেসব কারণে এবার অন্তত কিছু লোক ইতালির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় লিগুরিয়া অঞ্চলের এই ক্ষুদ্র গ্রামটিতে বসবাসের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে তাদের সংখ্যাটা একেবারে নগণ্য, মাত্র কয়েক ডজন। এরাও আবার প্রস্তাবটি পাওয়া মাত্রই লুফে নিচ্ছে না; পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখছে নতুন স্থানে সম্পূর্ণ নতুনভাবে বসবাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়াদি।
গুগল স্ট্রিট ভিউতে বোরমিদা’র প্রধান সড়ক
আগ্রহী প্রার্থীদের মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, হাঙ্গেরি ও ইন্দোনেশিয়ার লোকও রয়েছে। তাদের প্রায় সবার মাথাতে আর্থিক সুবিধার বিষয় কাজ করলেও এমন কয়েকজন আছেন, যারা নাগরিক জীবনের সব জটিলতা ছেড়েছুঁড়ে একেবারে সহজ-সরল জীবনযাপনের লক্ষ্যে চলে যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে শান্ত ও সুনিবিড় ইতালির বোরমিদা শহরে, যেটি নামে শহর হলেও শহুরে জীবনের অনেক সুবিধাই দিতে পারে না তার নাগরিকদেরকে। ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কয়েকজন জানতে চেয়েছেন সেখানে উচ্চগতিসম্পন্ন ওয়াইফাই সুবিধা রয়েছে কিনা। থাকলে সেখানে থেকেও আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে রুটি-রুজির ব্যবস্থাও করতে চান তারা। তবে মেয়র এখনই কাউকে বিমানের টিকেট কাটতে নিষেধ করেছেন। কেননা নগদ দুই হাজার ইউরো দেয়ার প্রস্তাবটি স্থানীয় বোর্ডে এখন পর্যন্ত উত্থাপিত হয়নি, পাস হওয়াতো পরের কথা।
ব্যয়ভার (মাস প্রতি ৫০ ইউরো) বহনযোগ্য কক্ষগুলো বোরমিদা শহরে এখনো দৃশ্যমান হয়নি। মেয়রের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, এগুলোর নির্মাণকাজ আগামী দুই মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে। কোলাহলহীন এ ক্ষুদ্র শহরটিতে ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত হাজার খানেক লোক ছিল। বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষেই ব্যাপক নগরায়ণের কারণে এ ধরনের গ্রাম বা গ্রামধাঁচের ছোট্ট শহরগুলো ছেড়ে যাওয়ার হিড়িক পড়ে, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। বোরমিদা’র উঁচু রাস্তা মোটের উপর সক্রিয়। চারটি রেস্টুরেন্টের সবগুলোই দিনের বেশিরভাগ সময়েই থাকে ক্রেতাশূন্য। লাইব্রেরি, কর্ণার শপ ও ফার্মেসি আছে একটি করে। ডাক্তারখানা ও পোস্ট অফিসটি খোলা থাকে সপ্তায় তিনদিন; ডাক্তার আসেন নিকটবর্তী বড় শহর জেনোয়া থেকে। বিনোদিত হতে চাইলে সেখানেই যায় বোরমিদা’র নাগরিকরা। স্থানীয়দের বিনোদন বলতে যা রয়েছে, সেটি হচ্ছে গিটার, ইউকলেলে, টামবোরিন ও একোরডিওন আদযন্ত্র সহকারে বার্ষিক ইস্টার্ন “এগ” সং উৎসবে অংশ নেয়া। স্থানীয় এক রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার প্রসঙ্গক্রমে গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিককে বলছিলেন, ‘এখানে এর চেয়ে বেশি কিছুই নেই। অত্যন্ত সহজ-সরল জীবনযাপন। আমাদের রয়েছে বন, গীর্জা, প্রচুর ভালো খাদ্য এবং অনেক ছাগল। নিঃসন্দেহে আমাদের জীবন একেবারেই চাপমুক্ত’।
স্থানীয় এক কাউন্সিলরও প্রায় একই অভিমত ব্যাক্ত করেন, ‘আমরা আমাদের পরিকল্পনা নিয়ে এখনো কাজ করছি। কিন্তু যে কেউই ইচ্ছে করলে আমাদের ভুবনে এসে বসবাস শুরু করতে পারেন। আমাদের সম্প্রদায় ছোট হলেও অন্যদের স্বাগত জানাতে কার্পণ্য করি না। পর্বত অঞ্চল হয়েও সমুদ্র থেকে খুব বেশি দূরে নয় বলেই লাইফস্টাইল স্বাস্থ্যসম্মত; বায়ু খুবই পরিষ্কার’।
নগদ দুই হাজার ইউরো, সঙ্গে মাসপ্রতি মাত্র ৫০ ইউরোতে বিশাল ঘরে থাকার অফারটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লেও সব প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, এমন হলে হয়তো বিজ্ঞাপনের খুঁটিনাটি পরীক্ষার পর আরো অনেকেই বোরমিদায় থাকার আগ্রহ প্রকাশ করবে। তখন জেনে নেবে, স্বামী-স্ত্রী একত্রে গেলে নগদ অর্থের পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা। ছেলেমেয়ের সংখ্যার ভিত্তিতে নগদ প্রাপ্তি কমানো-বাড়ানো হলে প্রস্তাবটি নিঃসন্দেহে আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
বিজ্ঞাপনটি ছাপা হলে যেসব বিদেশি সত্যিকার অর্থেই বোরমিদা নামক ছোট্ট শহরটিকে স্থায়ী ঠিকানা বানানোর বিষয়ে আগপাছ ভাববে, তাদের জন্য কিঞ্চিত্ দুঃসংবাদ হচ্ছে, ওই শহরের আশেপাশে যে গ্রাম বা শহরগুলো রয়েছে, সেসব স্থানের কেউতো নয়ই, উপরন্তু পুরো ইতালির কোনো নাগরিকই এখন পর্যন্ত বোরমিদায় থিতু হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করছে না।
নিউজ সোর্সঃ এইখানে ক্লিক করুন