অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সাথে যখন চার্লি চ্যাপলিনের প্রথম দেখা হলো তখন আইনস্টাইন চ্যাপলিনকে বলেছিলেন- ‘আপনাকে আমি যে কারণে খুব পছন্দ করি সেটা হলো আপনার বিশ্বজনীন ভাষা। আপনি যখন অভিনয় করেন, তখন আপনি হয়তো কোনো ডায়লগই বলছেন না, কিন্তু সারা পৃথিবীর মানুষ ঠিক বুঝতে পারে আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন এবং তারা সেজন্য আপনাকে অসম্ভব ভালোও বাসে।’ উত্তরে চ্যাপলিন হেসে বলেছিলেন- ‘ড. আইনস্টাইন, আপনাকে আমি তার চেয়েও বড় কারণে পছন্দ করি। আপনার থিওরি অফ রিলেটিভিটিসহ অন্যান্য গবেষণার বিন্দুবিসর্গও কেউ বুঝে না, তবুও গোটা পৃথিবীর মানুষ আপনাকে শ্রদ্ধা করে’। – এই হল সত্যিকারের চ্যাপলিন, স্যার চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন জুনিয়র, যাকে কথার মার প্যাঁচে কেউ কখনো হারাতে পারেনি। গত ১৬ই এপ্রিল ছিলো, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের একজন, চার্লি চ্যাপলিনের ১২৮ তম জন্মদিন। তাই তাকে নিয়েই বাংলাহাবের আজকের এই বিশেষ আয়োজন।
চার্লি চ্যাপলিনের জীবন যেন আগাগোড়া পুরোটাই রহস্যে ঘেরা। জন্ম ১৮৮৯ সালে, কিন্তু জন্মস্থান সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। কেউ বলে ফ্রান্সের ফঁতেউব্ল শহরে তার জন্ম, আবার কারো মতে তিনি ইষ্ট স্ট্রিট, ওয়ালওয়ার্থ, লন্ডনে জন্ম গ্রহণ করেন। আল-জাজিরা তো একবার প্রচার করে বসল যে চ্যাপলিনের জন্ম আসলে রাশিয়ায়! এমনকি তার নাম চার্লি চ্যাপলিন নিয়েও সন্দেহ আছে অনেকের! যুক্তরাজ্যের জাতীয় আর্কাইভ থেকে প্রকাশিত নথি থেকে জানা যায়, চার্লি চ্যাপলিনের আসল নাম হলো ইসরায়েল থর্নস্টেইন। চ্যাপলিন তার ছদ্মনাম! তবে শেষ পর্যন্ত অবশ্য যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দারা চ্যাপলিনের ছদ্মনাম নিয়ে কোনো প্রমাণ খুঁজে পাননি।
চ্যাপলিনের বাবা সিনিয়র চ্যাপলিন সংগীত শিল্পী ছিলেন। আর্থিক অবস্থা ভালই ছিল। কিন্তু এক সময় মাদকের নেশায় পড়ে দেউলিয়া হন, পরে অসুখে পড়ে মারা যান মাত্র ৩৭ বছর বয়সে। মা হান্নাহ চ্যাপলিন থিয়েটারে কাজ করতেন। ঘটনাটি চার্লির পাঁচ বছর সময়কার। একদিন হান্নাহ মঞ্চে গাইছিলেন, গাইতে গাইতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন, বাধ্য হয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে হয়। উপায়ন্তর না দেখে পিচ্চি চ্যাপলিন মঞ্চে গাইতে উঠেন। সেই পাঁচ বছর বয়সেই আধো আধো কন্ঠস্বর আর অপক্ক অভিনয় দিয়ে প্রথম মঞ্চ মাতান তিনি!
চার্লি চ্যাপলিনের শৈশব কাটে দুর্দশায়। ১৮৯৮ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে চ্যাপলিন একটা নাচের দলে যোগ দেন। নাচ দেখিয়ে যা পেতেন তাতেই কোন মতে তার সংসার চলত। কিন্তু অভাব কখনো তার প্রতিভাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। যোগ্যতা প্রমাণ করেই ১৯ বছর বয়সে ‘ফ্রেড কার্নো’ থিয়েটার কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ইংল্যান্ড থেকে চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে৷ এখানেই ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র জগতে বিচরণ শুরু৷ ১৯১৪ সালে ২৫ বছর বয়সে প্রথম সিনেমাতে অভিনয় করেন চ্যাপলিন। মুভিটির নাম ছিল ‘মেকিং এ লিভিং’। ১০ মিনিট দৈর্ঘের সিনেমাটি ব্যবসায়িক ভাবে ব্যর্থ হলেও অভিনয়ে নিজের জাত চেনাতে ভোলেন নি চার্লি। অভিনয়ের পাশাপাশি এসময় চলচিত্র পরিচালনায়ও হাত দেন। ১৯১৪ সালে চ্যাপলিন পরিচালিত প্রথম চলচিত্র ‘কট ইন এ ক্যাবার’ মুক্তি পায়। একই বছর নিজের লেখা কাহিনী দিয়ে চ্যাপলিন নির্মাণ করেন ‘কট ইন দি রেন’। ১৯১৫ সালে চ্যাপলিন অভিনয় করেন ‘দ্য ট্র্যাম্প’ বা ‘ভবঘুরে’ চলচিত্রে। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিশ্বব্যাপী সমান জনপ্রিয়তা পায় ঢিলে ঢালা-প্যান্ট, ছেঁড়া কোট, ছেঁড়া জুতো, খানদানি হ্যাট আর টুথব্রাশ স্টাইলের গোঁপের ভবঘুরে চরিত্রটিকে দর্শক অসম্ভব ভালোবেসে ফেলে। দর্শকের এই ভালোবাসাকে পুঁজি করেই ট্র্যাম্প সিরিজের মোট ১২টি চলচিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এই এক চরিত্র দিয়েই খ্যাতি-বিত্ত-ভালোবাসা সব জয় করে নেন চার্লি।
সুন্দরীদের প্রতি বিশেষ দূর্বলতা ছিল চ্যাপলিনের! নিজের প্রথম ভালোবাসায় ব্যর্থ হয়ে পরে একে একে চারটি বিয়ে করেন! প্রথম তিন স্ত্রী মিলড্রেড হ্যারিস (১৯১৮ – ২০), লিটা গ্রে (১৯২৪ – ২৭) ও পোলেট গোদা (১৯৩৬ – ৪২)- র সাথে সম্পর্কের শেষটা ছিল তিক্তকর। খারাপ হতে হতে বিবাহ বিচ্ছেদে গিয়ে গড়ায় প্রতিটি সম্পর্ক। তবে শেষ স্ত্রী উনা ও নীল কে সম্ভবত সত্যিকারে ভালোবসেছিলেন তিনি। চার্লিকে একবার দুঃখ করে বলতে শোনা গিয়েছিল, “আমার জীবনে আরো কয়েক বছর আগে উনা আসেনি কেন?” ১৯৪৩ সালে উনা-র এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন চ্যাপলিন। জীবনের বাকিটা সময় এক সাথেই কাটিয়েছেন দুজন।
ছবিঃ চার্লি চ্যাপলিন এবং উনা
চার্লির এই ঘটনাটি জানেন তো? তিনি তখন পৃথিবী বিখ্যাত। তার অনুকরণে অভিনয়ের একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। গোপনে চার্লি চ্যাপলিন নাম দেন সেই প্রতিযোগিতায়। মজার বিষয় হলো প্রতিযোগিতা শেষে দেখা গেলো চার্লি নিজে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছেন! পরে পুরষ্কার বিতরণীতে নিজের সত্যিকারের পরিচয় দিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিলেন- ‘যাক! একটা ব্যাপার জেনে ভাল লাগলো! আমার নিজের অভিনয় আমার চেয়ে আরো দুজন মানুষ বেশি ভাল করে করতে জানে!’
চার্লির অভিনীত মোট চলচ্চিত্রের সংখ্যা ৩৫ টি। এর মাঝে তার অমর কিছু কাজ হল-
- Modern Times
- City Lights
- The Circus
- Nice and Friendly
- The Kid
- A Dog’s Life
- Easy Street
- Shanghaied
- The Tramp
- Recreation
- The Star Boarder
- Kid Auto Races at Venice
চার্লির জনপ্রিয় কিছু উক্তি আছে যা মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত। এর মাঝে নির্বাচিত ১০টি উক্তি হল-
- Nothing is permanent in this wicked world – not even our troubles.
- What do you want a meaning for? Life is a desire, not a meaning.
- We think too much and feel too little.
- To truly laugh, you must be able to take your pain, and play with it.
- This is a ruthless world and one must be ruthless to cope with it.
- Your naked body should only belong to those who fall in love with your naked soul.
- I always like walking in the rain, so no one can see me crying.
- I have many problems in my life. But my lips don’t know that. They always smile.
- A day without a laughter is a day wasted.
- My pain may be the reason for somebody’s laugh. But my laugh must never be the reason for somebody’s pain.
১৯৬৪ সালে চার্লির আত্মজীবনী My Autobiography প্রকাশিত হয়। বইটিকে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক বিক্রিত বইগুলোর একটি হিসাবে ধরা হয়। ১৯৭৭ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর সুইজারল্যান্ডে তিনি শেষ নিঃশ্বাষ ত্যাগ করেন।
চার্লি সম্পর্কে কিছু ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্টঃ
* চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন প্রথম এক্টর যে কিনা টাইমস ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছিলেন।
*তিনি ৪ বার বিয়ে করেছিলেন।
*তিনি একটি মাত্র অস্কার পেয়েছিলেন। তিনি “লাইমলাইট” মুভির জন্য বেস্ট মিউজিক এর জন্য অস্কার পেয়েছিলেন।
*তার মেয়ে Geraldine Chaplin ১৯৯২ সালের “Chaplin” মুভিতে তার মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
*তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন এমন সন্দেহে হলিউড “ওয়াক অফ ফেইম” থেকে তার নাম উঠিয়ে দেয়া হয় এবং সেটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এক নজরে চার্লি চ্যাপলিনঃ
পুরো নামঃ স্যার চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন জুনিয়র।
জন্মঃ ১৬ই এপ্রিল, ১৮৮৯।
মৃত্যুঃ ২৫ শে ডিসেম্বর, ১৯৭৭, ভিভে, সুইজারল্যান্ড।
পেশাঃ অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার ও সংগীতশিল্পী।
বাবাঃ চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন সিনিয়র।
মাঃ হান্নাহ হেরিয়েট চ্যাপলিন।
স্ত্রীঃ মিলড্রেড হ্যারিস (১৯১৮ – ২০), লিটা গ্রে (১৯২৪ – ২৭), পোলেট গোদা (১৯৩৬ – ৪২), উনা ও-নিল (১৯৪৩ – ৭৭)