ফরাসি দেশের বড় বড় বাড়ি, অট্টালিকাকে বলা হয় শাতো। ফান্স যেহেতু শিল্পের এক সেরা পীঠস্থান, তাই শিল্পের অন্য ধারাগুলোর মতো স্থাপত্যও ফান্সের অবদান কোন অংশে কম নয়। অসংখ্য সুন্দর শাতো রয়েছে ফ্রান্সে। প্রত্যেক শাতোর পিছনে রয়েছে সমৃদ্ধ অতীত, স্থাপনার দিক দিয়ে অনন্য ও স্বাতন্ত্র্য।ইতিহাস আর ঐতিহ্যগতভাবে এসব শাতোর রয়েছে এক বৈচিত্রময় ব্যাপ্তি যা প্রথিবীর অন্য কোন রাজপ্রাসাদের সাথে তুলনা মেলে না।
তার মধ্যে এক অনন্য উচ্চতায় যার অবস্থান, সেই রাজপ্রাসাদটি হচ্ছে ‘শাতো দ্য শ্যঁবর’। এটি এমন এক চমকপ্রদ রাজপ্রাসাদ যা একমাত্র রূপকথা গল্পের বইয়েই পাওয়া যায়।স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে স্বীকৃত এবং অন্যতম রাজপ্রাসাদ হিসেবে এটি অগ্রগণ্য।অসাধারণ সৌন্দর্যে ঘেরা এই রাজপ্রাসাদ ঘিরে রয়েছে অতীতের এক সমৃদ্ধ রাজার গল্প যা নাম রাজা ফ্রান্সিস।
আধুনিক যুগের গোড়ায় ইতালিতে যে বিখ্যাত নবজাগরণ হয়েছিল, সেই জাগরণ সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরিবর্তন ঘটছিল সবকিছুর।সব কিছু পাল্টে যাচ্ছিল, সমৃদ্ধ হচ্ছিল খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে। সেই সময়ের সৌন্দর্যের ছাপ রয়ে গিয়েছে এই শাতোটির গাঁয়ে। একদিকে মধ্যযুগীয় ফরাসি স্থাপত্য রীতির সঙ্গে ইতালীয় নবজাগরণের প্রভাব মিলেমিশে এই শাতোটি যে কেউ মেনে নেবে পৃথিবীর অন্যতম সেরা প্রাসাদ হিসেবে।
তখনকার শাতো সবই তৈরি হতো জলাশয়ের মাঝখানে। তাতে বেশ একটা রূপকথার আবেশ থাকতো। এটিও সেইরকমই। সেসময় ফান্সের এই অঞ্চলটি ছিল ঘন জঙ্গলে ভরা। চারদিকে ছিল হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের আবাস। যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতো হিংস্র ভাল্লুক আর হায়েনারা। রাজা প্রথম ফ্রান্সিস তখন নবীন রাজা। মারিগনানোর যুদ্ধ জিতে বেশ একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। প্রাসাদ তৈরি করতে তিনি নির্দেশ দিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আজো শেষ করা সম্ভবপর হয়নি এই শাতো। তবে এখনও পর্যন্ত এটি শুরুতে যেমন ছিল, এখনও ঠিক তেমনি আছে। খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। প্রাসাদটি কিন্তু রাজার থাকার জন্য করা হয়নি।নিম্ন উপত্যকায় এটি ফ্রান্সিসের শিকারের লজ হিসেবে ব্যবহারের এই প্রাসাদ তৈরি করা হয়। মেরেকেটে কয়েক সপ্তাহ হয়তো রাজা এখানে থেকেছিলেন। রাজা থাকতেন ব্লোয়া এবং আমবোয়ার প্রাসাদে। যতটুকু জানা যায়, এই প্রাসাদের মূল নকশাটি বোধ হয় করেছিলেন দোমেনিকো দ্য করতোনা নামে একজন স্থপতি। কিনউ সপ্তদশ শতকে এই শাতোর একটি কাঠের তৈরি মডেল পাওয়া যায় যা সেসময়ের প্রখ্যাত ডিজাইনার এন্ড্রু ফেলিবিয়ানের তৈরি বলে ধারণা করা হয়।
তবে মনে করা হয়, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির প্রভাবও ছিল এর পিছনে। কারণ, লিওনার্দো শেষ বয়সে রাজা ফ্রান্সিসের কাছেই চলে এসেছিলেন। রাজা খুব ভালোবাসতেন লিওনার্দোকে।
১৫১৯ থেকে ১৫৪৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ আটাশ বছর ধরে এটি তৈরি হয়েছিল। ১৫১৯ সালে লিওনার্দো মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু এরকম চমৎকার ডাবল হেলিক্স সিঁড়ির ধাপ, হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা বা ছাদের গঠনরীতি দেখে ভীষণভাবে এই ইতালীয় কিংবদন্তির কথাই মনে হয়। তিনি ছাড়া এমন আশ্চর্য কীর্তি অন্য কারো সেই সম্ভব ছিল না বলে অনেকেই মনে করেন। প্রাসাদটির চতুর্দিক একটি পরিখা দ্বারা বেষ্টিত। প্রাসাদটিতে প্রবেশের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি বড় বড় প্রবেশদ্বার।
প্রকৃতপক্ষে, সেইসময় ফ্রান্সে প্রথম ফ্রান্সিসের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন পঞ্চম চার্লস। এই মস্ত প্রাসাদটি করে রাজা ফ্রান্সিস চার্লসকে একটু খাটো করতে চেয়েছিলেন আর কি! এছাড়াও আরো আশপাশের সমস্ত বড় বড় রাজারাজড়ারা কিন্তু এই প্রাসাদ দেখে চমকে গিয়েছিলেন। সেসময় এমন প্রাসাদ ছিল বৈভব আর ক্ষমতার আয়না।তবে সুন্দরের তো অতো ক্ষমতা নেই যে, ধ্বংস থেকে রক্ষা পেয়ে যাবে।এই শাতোকেও পার হতে হয়েছিল নানা বিপর্যয়।
রাজা ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর পরবর্তী রাজারা প্রাসাদটি বন্ধ করে দেন এবং কয়েক দশক প্রাসাদটি বন্ধই ছিল। ১৬৩৯ সালে রাজা পঞ্চদশ লুই তার ভাই গ্যাস্টন দি অরল্যান্সকে প্রাসাদটি হস্তান্তর করেন।অরল্যান্সের হাত ধরেই প্রাসাদটি সংস্কার করা হয় এবং এটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়।একদা শিকারের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত প্রাসাদ পরবর্তীতে রাজা পঞ্চদশ লুই মাঝে মাঝে এটিকে থাকার বাসস্থান হিসেবেও ব্যবহার করেন।
১৭৯২ সালে যখন ফরাসি বিপ্লব হলো, এই প্রাসাদও নিজেকে বাঁচাতে পারেনি বিপ্লবের ছায়া থেকে। অনেক মূল্যবান আসবাবপত্র বের করে এনে বেঁচে দেয়া হয়। কাঠ খুলে নেয়া হয়। অনেকদিন এটি প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল।
আবার ঊনবিংশ শতকে এটি পুনরায় সংস্কার কাজে হাত দেয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লুভ্র জাদুঘর এবং অন্য জায়গা থেকে নামীদামি শিল্পসংগ্রহ এখানে সরিয়ে আনা হয়। এখন বিভিন্ন দেশের পর্যটক এই প্রাসাদ দেখতে আসেন। বছরে প্রায় ৭০ হাজারের উপরে মানুষ এখানে ঘুরতে আসেন।
২০১৬ সালে ফ্রান্সে যে ভয়াবহ বন্যা হয় তাতে এই প্রাসাদও রক্ষ পায়নি। বন্যায় শাতোর চারদিকের মাঠে পানি উঠে এসেছিল। তবে শাতোটির তেমন উল্লেখযোগ্য কোন ক্ষতি হয়নি। তবে কিছু দিনের জন্য এর রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে পর্যটকদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। প্রতিবছর দেশ বিদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক পর্যটক আসেন এই শাতোটি দেখার জন্য।ফরাসি দেশের ঐতিহ্য আর শিল্পের এক অনন্য স্মারক এই শাতো দ্য শ্যঁবর।