বিশ্বকাপের মঞ্চে জাপানীদের পরিচ্ছন্নতা অভিযান এবং আমাদের অবস্থা

প্রায় গ্রুপ পর্বের গণ্ডি পার করে ফেলেছে, ২০১৮’র “রাশিয়া বিশ্বকাপ”। বিশ্বকাপ নাকি বিশ্বযুদ্ধ এর সদুত্তর পাওয়া যাবে ফেইসবুক,টুইটার সহ নানা সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন দলের সমর্থকদের উত্তাপ ছড়ানো কথা বার্তার দিকে নজর দিলে। আমাদের বাংলাদেশের ফুটবল প্রেমীরাও এর থেকে পিছিয়ে নেই, বরং আর দশটি দেশ থেকে এগিয়েই আছে বলা যায়। একে অপরের সাথে পছন্দের দল নিয়ে তর্ক-বিতর্ক অনেক সময় লিমিট পার করে ব্যক্তিগত রেষা-রেষিতে রূপ নেয়।

রাশিয়ায় অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের সমর্থকরা তো আরেক কাঠি সরেস। মাঠে এবং মাঠের বাইরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য প্রায়ই শিরোনামে আসছে এসকল সমর্থক গোষ্ঠীদের নাম। প্রতিপক্ষ দলের হোটেলের সামনে হট্টগোল করে প্লেয়ারদের রাতে ঘুমের ব্যাঘাত করা, প্লেয়ারদের বহনকারী টিম বাসে আচমকা হামলা,মাঠে স্মোক গান, বেলুন ইত্যাদি ছুড়ে মারাতে পটু অনেক সমর্থকরা। তবে এদের মধ্য থেকে কোন কোন দেশের মানুষ আবার পায় সম্মানের আসন। আর এবারের আসরে সকলের মুখে মুখে জাপানের সমর্থকদের প্রশংসা।

  ৯০মিনিটের খেলায় থাকে টান-টান উত্তেজনা। দর্শকরা খেলার পুরোটা সময়ই গলা ফাটিয়ে সমর্থন জানায় প্রিয় দলটিকে। এছাড়া সাথে করে নিয়ে আসে বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন,বেলুন,পতাকা। গড়ে প্রায় ৫০হাজার মানুষ উপস্থিত থাকে একেকটা স্টেডিয়ামে। খেলা শেষে বিজেতা দলের সমর্থকরা গান গেতে গেতে স্টেডিয়াম ত্যাগ করে আর পরাজিত দলের দর্শকরা একরাশ দুঃখ নিয়ে। বিশ্বকাপের যে কোন ম্যাচ শেষ হওয়ার পর গ্যালারির আসন-গুলোসহ পুরো স্টেডিয়াম ভর্তি হয়ে পরে মানুষের সাধারণত ফেলে যাওয়া খাবার, গ্লাস, কাপ, বোতল, ব্যানার,ফেস্টুন ও কাগজের জিনিসপত্রে। খেলা পরবর্তী এসব আবর্জনা খুব দ্রুত পরিষ্কারের জন্যে রয়েছে শত-শত পরিচ্ছন্নতা কর্মী। কিন্তু জাপানিরা এসবের ধার ধারে না। খেলা দেখতে আসার সময়ই তারা সাথে করে নিয়ে আসে পলিথিনের বিশাল ব্যাগ। খেলার ফলাফল যাই হোক, দল হারুক কিংবা জিতুক। স্টেডিয়ামের সকল ময়লা আবর্জনা তারা বস্তাবন্দী করে রাখে। তাদের বক্তব্য হল, স্টেডিয়ামে প্রবেশ করে যে অবস্থায় এটাকে পেয়েছি, ঠিক সেই অবস্থায় এটিকে আমরা রেখে যেতে চাই।

বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচে জাপান হারিয়েছে লাতিন আমেরিকার দেশ কলম্বিয়াকে। কাগজে কলমের শক্তিমত্তায় গত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালিস্ট কলম্বিয়া অনেক এগিয়ে থাকলেও মাঠের খেলায় জয় হয়েছে জাপানের। জয়ের এই রাতে জাপান সমর্থকদের আনন্দ উল্লাস করার কারণ ছিল যেহেতু দক্ষিণ আমেরিকার কোন দলের বিরুদ্ধে এটাই জাপানের প্রথম জয়। কিন্তু খেলার মাঠে কলম্বিয়াকে ধরাশায়ী করার পর জাপানের সমর্থকরা গ্যালারিতে শুধু আনন্দ উল্লাসেই মেতে থাকেনি, বরং তারা গ্যালারি পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে যান। স্টেডিয়ামের ভেতরে দর্শকদের সারিতে ও আসনে যেসব আবর্জনা ছিল সেগুলো তারা নিজেরাই পরিষ্কার করতে শুরু করে। জাপানিদের এই মহৎ কর্ম প্রথম চোখে পড়ে ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সে বিশ্বকাপ। সে সময় ভালো খেলেও জাপানি দল হেরে গিয়ে রেফারিকে দোষ দিলনা। বরং জাপানি দর্শকরা ঠিকই গ্যালারি পরিষ্কার করে বাড়ি ফিরলেন। গ্যালারিখানা যেমন ছিল, তার চেয়েও পরিষ্কার হয়ে গেল। গত ব্রাজিল বিশ্বকাপেও স্টেডিয়াম পরিচ্ছন্নতার কাজে নেমেছিল “ব্লু সামুরাই”এর সমর্থকরা। খেলা দেখতে আসা অনেক বিদেশি সমর্থকদের কাছে বিস্ময় সৃষ্টি করে জাপানিজদের এই অভ্যাস । শুধু নিজেরা পরিষ্কার করেই তাদের এই অভিযান সীমাবদ্ধ রাখে না তারা। বিদেশি কেউ হয়তো মাঠে একটি পানির বোতল বা উচ্ছিষ্ট খাবার ফেললো। সাথে সাথেই সে ব্যাক্তি নিজের কাঁধে আলতো টোকা অনুভব করবে। কোন না কোন জাপানিজ তাঁকে বলবেন, বর্জ্য নির্ধারিত স্থানে ফেলে দিন কিংবা সঙ্গে করে বাসায় নিয়ে যান, কিন্তু মাঠে বর্জ্য ফেলা যাবে না। এর কারণে এখন অন্য দেশের নাগরিকরাও এগিয়ে এসেছে পরিচ্ছন্নতা অভিযানে। এবারের বিশ্বকাপে সেনেগালকেও দেখা যায় স্টেডিয়াম পরিষ্কারের কাজে।

হাসি মুখেই পরিচ্ছন্নতার কাজ করছে তারা

পরিবেশ সচেতনতা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা জাপানি সংস্কৃতিরই অংশ। ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক স্কট নর্থ এর মতে,

“ তাদের পরিচ্ছন্ন চেতনা আদিকাল থেকেই। পরিষ্কার ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার পাশাপাশি বিশ্বকে এরা একধরণের বার্তাও প্রদান করে। এসকল ঘটনাগুলি জাপানী অনুরাগীদের তাদের জীবনযাত্রার গৌরব প্রদর্শন করে। ধরিত্রীকে রক্ষা করার এই মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে বিশ্বকাপের থেকে বড় প্ল্যাটফর্ম আর আরকি হতে পারে।”

blank
দল্বদ্ধভাবে স্টেডিয়াম পরিষ্কার করা, জাপানিদের কাছে উৎসবের মতনই

জাপানিদের এই অভ্যাস গড়ে উঠার পিছনে আছে এক লম্বা ইতিহাস। ১৯৬০ সালের দিকে টোকিওর অবস্থা ছিল অনেকটা বর্তমান ঢাকা শহরের মতনই। সবাই যত্র তত্র ঘরের আবর্জনা ফেলত। সারা শহর নোংরা আবর্জনায় বোঝাই এক দূষিত শহর। ১৯৬৪তে জাপানের টোকিও তে বসবে “অলিম্পিক”এর মতন বড় আসর। সারা বিশ্বের কাছে নিজেদের ইমেজ রক্ষায় এবার পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নামল সরকার।জাপান সরকার পাড়ায় পাড়ায় ময়লা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ও সময় নির্ধারণ করে দিলেন। পাড়ায় পাড়ায় একজনকে প্রধান বানানো হল। প্রতিযোগিতা শুরু হল কার পাড়া কত সুন্দর থাকে। কোন পাড়া বেশি পরিচ্ছন্ন। এসবের জন্যে লিডারদের কাজ হলও এলাকার লোকদের উৎসাহ দেয়া। কোন রকম শাস্তির ভয় দেখানো হলো না, কোন রকম পুরস্কারের ঘোষণাও করলো না, শুধু উৎসাহতে কাজ হলো। অলিম্পিকের আগে সারা শহরই বদলে গেল। সেবারের অলিম্পিকে সবার মুখে মুখে ছিল জাপানীদের পরিচ্ছন্নতার কথা। অলিম্পিক পরবর্তী আরও সিদ্ধান্তের কারণে, সমগ্র জাপান আজ পরিবেশ বান্ধব দেশ হিসেবে পরিচিত। একটা সময়, জাপানে ড্রিঙ্কস ক্যান আর প্লাস্টিক বোতলের এর ব্যবহার বেড়ে গেল। বিশেষ করে ড্রিঙ্কস কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের চাহিদা মতন পাড়ায় পাড়ায় ভেন্ডিং মেশিন বসিয়ে দিল। এতে করে বোতলজাত বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে গেল। এজন্যে সরকার নিয়ম করে দিল, ভোক্তা যেখানে ক্রয় করবে, সেখানেই ক্যান ফেলার জায়গা তৈরি করে দেবে বিক্রয়কারী কোম্পানি। অলিম্পিক দিয়ে শুরু হয়েছিল জাপানের শহর ক্লিন কর্মসূচি, সেই কর্মসূচি আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার ব্রত নিয়েছে জাপানের মানুষরা।blank
আমাদের দেশের দিকে যদি তাকাই তাহলে এর বিপরিত চিত্র চোখে পড়বে। শহর জুড়ে ময়লার স্তুপ জায়গায় জায়গায়। শহরের সবাই যেন প্রতিযোগিতায়, কে কার থেকে বেশি নোংরা করবে এই শহর। জাপানে যেভাবে ঠিক এভাবে যদি আমাদের দেশের সকল মানুষ যদি নিজ উদ্যমে আমাদের শহরটাকে পরিষ্কার রাখি তাহলে আমরা এভাবে সকলের কাছে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারব। কারণ দেশকে নোংরা করি এই আমরা এই দেশের জনগণই। তাই আমাদেরই প্রথম পদক্ষেপ ফেলতে হবে নিজ শহরকে রক্ষা করায়।

blank