অতিপ্রাকৃত গল্প : অভিশপ্ত ক্যামেরা

“সৃষ্টিকর্তা শিশুদের এতো সুন্দর করেছে যেন তারা রিমনের ক্যামেরায় বন্দী হতে পারে ” কথাটি ভেবে আপন মনেই হেসে ওঠে রিমন। শিশুরা আপনমনে খেলে বেড়াচ্ছে আর রিমন সেই খেলার কিছু অংশ জমা করছে নিজের ক্যামেরায়। এই দৃশ্য যে সে কতবার ভেবেছে তার হিসেব মেলানো মুশকিল। ছোট থেকে ছবি তোলার ওপর এক অন্যরকম আকর্ষণ বোধ করে রিমন। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের শখ থাকে অজস্র। আর শখগুলো পূরনের ব্যপ্তিকাল কাল হয় দীর্ঘ। বাবার কাছ থেকে চাওয়া মানে বাবার হতাশার নতুন একটি কারণ উন্মোচন করা। না, সেটি রিমন করেনি। কলেজ পাশের পর টিউশনের টাকা থেকে কিছুটা বাঁচিয়ে রাখতো তার এই স্বপ্ন কেনার আশায়।অবশেষে তার সাধ আজ তার সাধ্যের ডোরে ধরা দিয়েছে এক বন্ধুর হাত ধরে। বন্ধুর এক আত্মীয়ের ক্যামেরা। এতো কম মূল্যে এতো ভাল একটা ক্যামেরা বিক্রীর কারণ জানতে চাইলে বন্ধু জানাই, তার আত্মীয়ের এই মুহূর্তে টাকার প্রয়োজন তাই এতো কম দামে দিতে রাজি হয়েছে। যাক, ভাগ্য দেবতা বহুদিন বাদে রিমনের প্রতি প্রসন্ন হয়েছে। কম বাজার দরে নিজের বহু মূল্যবান স্বপ্নকে কাছ থেকে ছোঁয়ার অনুভূতিটাই ভিন্ন।

বাড়ি ফিরে এসে ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলোর দিকে চোখ ভোলানোর সময় একটি ছবিতে এসে দৃষ্টি আটকে যায় রিমনের। সাদা পাঞ্জাবী পরিহিত, চোখে চশমা লাগানো পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ছেলে আর সাথে আছে শাড়ি পড়া একটি মেয়ে। মেয়েটি চেহারা চুল দিয়ে ঢেকে রেখেছে।কিন্তু এই ছবি তার ক্যামেরায় কি করে আসলো? সে তো আজ শুধু বাচ্চাদের ছবি তুলেছিল। ঐখানটাই এমন কাউকে দেখেছে বলেতো তার মনে পড়ছেনা। আর থেকে থাকলেও রিমনের ক্যামেরার সামনেই বা এলো কবে? হয়তোবা আগে থেকেই ছবিটি এই ক্যামেরায় ছিল। পর দিন বিকেলে রিমন আবার বেরিয়েছে ক্যামেরা হাতে। তার আজকের বিষয় ‘পথের পথিক ‘।পথ আর তার ক্যামেরা যেন আজ নিজেরদের মধ্যে সন্ধি করে নিয়েছে। কিন্তু বাড়ি ফিরে সে একি দেখছে! তার ক্যামেরায় পথের বদলে দেখা যাচ্ছে অন্ধকার নদীর ধারের ছবি। বারবার ঘুরে ফিরে একই ছবি কেন আসছে? কে জানতো পরের দিন সকালে রিমনের জন্য আঁতকে ওঠার মতো কিছু অপেক্ষা করছিলো, তাও আবার খবরের কাগজে। “অন্ধকার নদীর ধার থেকে এক অজ্ঞাত দুই যুবক -যুবতীর লাশ উদ্ধার “। নদীর ধারের দৃশ্যটি রিমনের কাছে খুব চেনা ঠেকছে। সে কোথায় যেন দেখেছে। এই তো সে নদীর ধার যেটির ছবি রিমন তার ক্যামেরায় দেখেছে।ক্যামেরায় থাকা ছবি গুলো আরেকবার দেখা চাই। খবরের কাগজের ছবিটি তার ক্যামেরায়। গতকালতো এই ছবিটি ছিলনা। এইসব কি হচ্ছে তার সাথে? অচেনা ব্যক্তি, নদীর ধার এসবের সাথে এই ক্যামেরার কি সম্পর্ক?

রিমন সবটি খুলে বললো তার বন্ধুর কছে। এক ছবি গুলো কি বিশেষ কিছু ইঙ্গিত করছে? বন্ধুর আত্মীয়ের সাথে কথা বলে জানা গেল, তিনি ক্যামেরাটি খুঁজে পেয়েছেন কোন এক নদীর ধারে। টাকার দরকার ছিলো তাই খদ্দের হারানোর ভয়ে আর তা খুলে বলেনি। পুরোটা শোনার পর তিনি জানান, তার পরিচিত একজন রয়েছেন যে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী। তিনি পারবেন তাদের এই ব্যাপারে সহায়তা করতে।

রিমন কখনোই এসব অলৌকিক বিষয়ে বিশ্বাসী নয়। কথায় আছে, একবার রহস্যের গন্ধ যার নাকে প্রবেশ করেছে; সে রহস্যের উন্মোচন না হওয়া অব্দি সকল পুরনো অবিশ্বাস গুলোও নতুন করে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। রিমন আর তার বন্ধু বসে আছে ছোট একটি কামরায়। সাথে আছে বন্ধুর সে আত্মীয়টি যার হাত ধরে এই অভিশপ্ত ক্যামেরা আজ রিমনের হাতে। তাদের ঠিক সামনে বসে আছেন মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক। গাল ভর্তি দাড়ি আর চোখে জ্ঞানের ছাপ। তার সামনে ক্যামেরাটি রাখা হলে তিনি কিছুক্ষণ সেটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তারপর চোখ বুজে বিড়বিড় করে কি বললেন তা ঠিক বোঝ গেলনা। হঠাৎ তিনি গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, “অতৃপ্ত আত্মা “। তিনজনেরই চোখে -মুখে ভয়ের স্পষ্ট রেখা ফুটে ওঠে তা শুনে।

তিনি বললেন, প্রথম যে যুবকের ছবি দেখা গেছে এই ক্যামেরাটি ছিলো তার। সে তার এই ক্যামেরায় কিছু লোকের অপকর্ম ধারণ করেছিলো। সেই প্রমাণ লোপাটের জন্য তারা ছেলেটি আর তার স্ত্রীকে হত্যা করে। তাদের বিরুদ্ধে থাকা সবকিছু মুছে দিয়ে ক্যামেরাটি ফেলে দেয়। আর সেই ছেলেটির অতৃপ্ত আত্মা বন্দী হয়ে পড়ে এই ক্যামেরার। এই আত্মাটি এখন মেতেছে রক্তের নেশায়। নদীর ধারে যে লাশটি পাওয়া গেছে সেটি এই আত্মার শিকার। এই ক্যামেরার সব ছবি উঠবে আঁধার আর নদীর ধারকে কেন্দ্র করে। আর কিছু সময় পর সেখানে পাওয়া যাবে লাশ।

এটি বন্ধ করার উপায় জানতে চাইলে তিনি জানান, রাতেরবেলা কোন এক নদীর ধারের ছবি তোলে তারপর ক্যামেরাটিকে ভাসিয়ে দিতে হবে নদীর জলে।তার কথামতো ভাসিয়ে দেওয়া হলো এই অভিশাপটিকে। রিমনের কাছে সবটাই যেন দুঃস্বপ্ন। কিন্তু বাড়ি ফিরে সে একি দেখছে? ক্যামেরাটি পড়ে আছে তার টেবিলের উপর।এই অভিশাপ থেকে কি মুক্তি মিলবে কখনো?