ব্রাম স্টকারের ড্রাকুলা বইটি পড়েনি বা সেই কাহিনী সমন্ধে জানেনা, এমন মানুষ খুব কমই আছে! রক্তখেকো ভ্যাম্পায়ার কাউন্ট ড্রাকুলা, মানুষের তাজা রক্ত যার একমাত্র আহার, সেই ভয়ঙ্কর উপন্যাস যার জীবনকাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত, সেই মানুষটির নামই হচ্ছে কাউন্টেস এলিজাবেথ বাথোরি।
এলিজাবেথ বাথোরিকে পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কথিত আছে যে, এলিজাবেথ বাথোরি ৬৫০ জন কুমারী মেয়েকে হত্যা করে তাদের রক্তে স্নান করেছে। গ্রামের মানুষজন এলিজাবেথের ভয়ে তাদের কন্যাসন্তানদের লুকিয়ে রাখতো। তার ভয়ঙ্কর সব কর্মকান্ডের জন্যই ইতিহাস তার নাম দিয়েছে “দ্য ব্লাড কাউন্টেস”।
হাঙ্গেরির এক ক্ষমতাশালী প্রট্যাসট্যান্ট পরিবারে ১৫৬০ সালে এলিজাবেথ জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন ব্যারন জর্জ বাথোরি এবং মা হলেন ব্যারোনেস আ্যনা বাথোরি। এলিজাবেথের বেড়ে ওঠার পরিবেশ মোটেও স্বাভাবিক ছিলো। কুসংস্কার আর গোঁড়ামিপূর্ণ ছিলো তাদের পরিবার। তুচ্ছ সব কারণে কর্মচারীদের ভয়ঙ্কর কঠিন শাস্তি দেয়া হতো সকলের সামনে। জিপসিদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালাতো ব্যারনের পরিবার। জিপসিরা ছিলো তাদের দু চোখের বিষ। তাছাড়া এলিজাবেথের ফুপু ছিলো একজন স্যাডোম্যাসোকিস্ট এবং কাকা ছিলো শয়তানের পূজারি। এই কাকার কাছ থেকেই স্যাটানিজমের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলো এলিজাবেথ। চারদিকের এই অসুস্থ পরিবেশের কারণে এলিজাবেথ ও পরিণত হতে থাকে মানসিক রোগীতে। ঘনঘন মৃগী রোগ অর্থাৎ সিজার আ্যটাক হতে থাকে, হঠাৎ হঠাৎ ঘোরের মধ্যে চলে যেত এলিজাবেথ। এভাবেই চলতে থাকে দিন এবং এলিজাবেথ পা দেয় পনেরো বছর বয়সে। আর তখনই তাকে পারিবারিকভাবে বিয়ে দেয়া হয় কাউন্ট ফেরেন্স নাদাসদি এর সঙ্গে। ফেরেন্স ছিলেন হাঙ্গেরিয়ান বীর যোদ্ধা এবং হাঙ্গেরিয়ান সেনা অধিনায়ক, যিনি অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধতে অসামান্য বীরত্ব দেখিয়েছিলেন।
কি ভাবছেন? ঠিক রূপকথার মতো বীর যোদ্ধা এসে রাজকুমারীকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলো? রূপকথা এবং বাস্তবের মধ্যে বুঝি এইটাই পার্থক্য। বাস্তবে অন্ধকারটা বড্ড বেশী কালো।
ফেরেন্স ছিলেন অসাধারণ বীর, এ নিয়ে কোন সন্দেহ ছিলোনা। তবে তার মধ্যে বীরত্বের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠেছিলো নিষ্ঠুরতা। স্বামীর এস্টেটে এসে এলিজাবেথ দেখতে পেলো অত্যাচারের আরো নতুন নতুন পন্থা! তবে এলিজাবেথ তখন ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছেন। বিয়ের পর এখন তিনি বিশাল নাদাসদি এস্টেটের মালকিন, তিনি এখন কাউন্টেস এলিজাবেথ বাথোরি! তার কি দুর্বলতা সাজে? এভাবেই নিজেকে ক্ষমতাশালী কাউন্টেসে পরিণত করে তুললেন এলিজাবেথ। ১৬০৪ সালে এক যুদ্ধে আহত হয়ে সেই ক্ষত নিয়েই কাউন্ট ফেরেন্স নাদাসদি ৪৮ বছর বয়সে মারা যান। এস্টেটের সমস্ত দায়িত্ব এসে পরে এলিজাবেথের উপর। এলিজাবেথের তিন কন্যা ও এক পুত্র তখনও প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠেনি। স্বামীর মৃত্যুর পর কিভাবে কাউন্টেস বাথোরি পরিণত হলেন দ্য ব্লাড কাউন্টেস এ, সে কাহিনীর দিকেই এখন এগুবো আমরা।
কেমন করে কাউন্টেস কুমারী মেয়েদের রক্তের প্রতি আকৃষ্ট হলেন, তা নিয়ে এক কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। এক সকালে কাউন্টেসের চুল আঁচড়ে দিচ্ছিলো এক সেবিকা। অসাবধানতাবশত হঠাৎ চুলের গোছায় একটু জোরে টান পরে যায়। কাউন্টেস এতে প্রচন্ড রেগে যান এবং বসে থাকা অবস্থায় হাতের পেছনের অংশ দিয়ে সেবিকার মুখে আঘাত করেন। আঘাত এতটাই জোরে করেছিলেন যে সেবিকার নাক ফেটে রক্ত কাউন্টেসের হাতে লেগে যায়। আর তখনই এস্টেটের কিছু জরুরি কাজ এসে পরাতে হাতের রক্ত মুছতে ভুলে যান কাউন্টেস, ব্যস্ত হয়ে পরেন কাজে। পরে যখন তিনি হাতে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত ধুয়ে ফেললেন, দেখলেন, তার চামড়া হয়ে গেছে মসৃণ আর প্রাণবন্ত! ঠিক যেমনটি ছিলো যৌবনকালে। তিনি ভাবলেন, যদি রক্তে স্নান করা যায়, তিনি নিশ্চয়ই লাভ করবেন চিরযৌবন! আর এভাবেই সূচনা হলো এক ভয়ংকর ইতিহাসের।
স্বামীর মৃত্যুর পর নর্থওয়েস্ট হাঙ্গেরির (বর্তমানে স্লোভাকিয়া) ক্যাশতেকি দূর্গে বসবাস করতে চলে আসেন কাউন্টেস। এই দূর্গটি তিনি তার স্বামীর কাছ থেকে বিয়ের উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। কাউন্টেস দূর্গে আসার পরেই আশেপাশের গ্রামের মেয়েরা নিঁখোজ হতে শুরু করে। প্রথমদিকে অনেক কুমারী মেয়েরাই দূর্গে দাসী হিসেবে নিযুক্ত হয়। প্রথমে তারা ভালোই বেতন পেতো, পোশাক পেতো। তাই সকলেই খুশি ছিলো। কিন্তু আস্তে আস্তে তারা নিঁখোজ হতে শুরু করে। যেসব মেয়েরা কাজ করতে দূর্গে যেত তারা আর কখনো ফিরে আসতো না। তাদের বাবামায়েরা খোঁজ নিতে গেলে তাদের ভাগ্যে জুটতো অত্যাচার। গ্রামের লোকেরা দূর্গের এক বয়স্কা সেবিকার কাছ থেকে জানতে পারে যে কাউন্টেস কুমারী মেয়েদের রক্তে স্নান করেন! এতে আতঙ্কিত হয়ে সাধারণ মানুষেরা তাদের কুমারী মেয়েদের দূর আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিত বা গোপনে তাদের বিয়ে দিয়ে দিত। নাহলে যে তারা ব্লাড কাউন্টেসের হাতে প্রাণ হারাবে!
ধীরে ধীরে গরীব কুমারী মেয়েদের সংখ্যা কমে যেতে লাগলো। এবার কাউন্টেস বড় ঘরের মেয়েদের দিকে নজর দিলেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে এনে হত্যাও করলেন। কিন্তু বড় ঘরের মেয়েদের নিঁখোজ হওয়ার ঘটনায় টনক নড়লো প্রশাসনের। হাঙ্গেরির রাজা দ্বিতীয় মাথায়াসের কানে এই সংবাদ গেলো! তিনি জানতে পারলেন, বহু কুমারী নারী কাউন্টেসের দূর্গে গিয়ে আর ফেরত আসেনি! কিন্তু কাউন্টেসের বিরুদ্ধে সরাসরি এমন অভিযোগ তোলা সম্ভব নয়। কাউন্টেসের আত্মীয়েরাই হাঙ্গেরির সকল প্রশাসনিক কাজের হর্তাকর্তা। কিন্তু রাজার পক্ষেও এই গুরুতর অভিযোগ শোনার পর চুপ করে বসে থাকা সম্ভব না। রাজা নিযুক্ত করলেন কাউন্ট জুরাজ তুরযোকে। তুরযোকে বলা হলো কাউন্টেসের বিরুদ্ধে সাক্ষীসাবুদ জোগাড় করতে।
জুরাজ প্রথমে গ্রামের মানুষজনের কাছ থেকে ঘটনা জানতে চান। তারা সকলেই জুরাজকে ত্রাণকর্তা ভেবে সকল অভিযোগ তুলে ধরেন। এমনকি দূর্গের কিছু কর্মচারি আদালতে সাক্ষী দেবে বলা জানায়। সাক্ষীসাবুদ জোগাড় করে জুরাজ ক্যাশতেকি দূর্গে যান কাউন্টেসকে গ্রেফতার করতে। তিনি যখন দূর্গে প্রবেশ করেন, পরিচারিকাদের কাছ থেকে জানতে পারেন কাউন্টেস তার টর্চার রুমে রয়েছেন। জুরাজ তুরযো কাউন্টেসকে হাতেনাতে গ্রেফতার করেন এবং বের হয়ে আসে এক নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ঘটনা।
সাক্ষীদের কাছ থেকে জানা যায়, কাউন্টেস তপ্ত লোহার শিক দিয়ে ভিক্টিমদের ছ্যাঁকা দিতেন, লোহার শিক দিয়ে পেটাতেন। তাদের নখের তলায় সূঁচ ঢুকিয়ে দেয়া হতো। ভিক্টিমরা যখন প্রায় মৃত তখন তাদের গলা কেটে তাদের সমস্ত রক্ত বের করে বাথটাব পরিপূর্ণ করা হতো। তারপর সে রক্তে স্নান করতেন কাউন্টেস। শুধু তাই না, অনেক ভিক্টিমের ঘাড়ের রগ তিনি কামড়ে ছিঁড়ে রক্ত পান করতেন। ঠিক ভ্যাম্পায়ারদের মতো! সাক্ষীদের মতে, তিনি নিজেকে শয়তানের কাছে উৎসর্গ করেছিলেন এবং পরিণত হয়েছিলেন অভিশপ্ত ভ্যাম্পায়ারে।
জুরাজ তুরজো কাউন্টেসের বিরুদ্ধে ৮০ জন কুমারী মেয়ে হত্যার অভিযোগ আনেন যা আদালতে প্রমাণিত হয়। কাউন্টেসকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়নি, তবে তাকে ক্যাশতেকি দূর্গের একটি কক্ষে গৃহবন্দি করে রাখার আদেশ দেয়া হয়। সেই ঘরে বাইরে থেকে আলোবাতাস ঢোকার কোন ব্যবস্থা ছিলোনা। শুধুমাত্র একটি ছিদ্র দিয়ে বাইরে থেকে একবেলা খাবার পাঠানো হতো। এই ঘরেই তিনি চার বছর বন্দী ছিলেন এবং ১৬১৪ সালে তিনি বন্দীবস্থায় মারা যান।
কাউন্টেস একজন বিশ্বস্ত প্রিয় পরিচারিকা ছিলো। সে কাউন্টেসকে সব কাজে একনিষ্ঠভাবে সহায়তা করতো। তাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়। একজন সাক্ষী এও বলেছিলো যে, কাউন্টেস তার একটি ডায়রিতে তার সমস্ত ভিক্টিমদের নাম এবং হত্যার দিনতারিখ লিখে রাখতেন। সেই ডায়রিতে রয়েছে ৬৫০ জন ভিক্টিমের নাম! কিন্তু বহু অনুসন্ধানের পরেও এই ডায়রী পাওয়া যায়নি।
তথ্যসূত্রঃ
১ঃ https://www.thevintagenews.com/2017/10/12/17th-century-hungarian-serial-killer-countess-elizabeth-bathory-was-as-horrifying-as-mythical-count-dracula/
২ঃ http://all-that-is-interesting.com/elizabeth-bathory-true-story
৩ঃ http://www.medicalbag.com/grey-matter/the-legend-of-elizabeth-bathory-the-blood-countess/article/472831/
ছবিঃ
১ঃ http://tripfreakz.com/offthebeatenpath/cachtice-the-castle-of-the-blood-countess
২ঃ https://www.patrika.com/tags/elizabeth-bathory-movie/
৩ঃ http://www.roguesgalleryonline.com/you-just-cant-get-the-staff/