পাথরের শৈল্পিক রূপকার – হামিদুজ্জামান খান

হামিদুজ্জামান খান

পাথর এ দেশের সহজলভ্য উপকরণ নয়। তাই শিল্প চর্চায় তার ব্যবহার নেই বললেই চলে। অথচ ঐতিহাসিকভাবে পাথর ভাস্কর্যের একটা প্রধান মাধ্যম। বাংলাদেশে এ মাধ্যমটির উন্মেষ সাধনে যাদের নাম আসে তাদের মধ্যে অন্যতম হামিদুজ্জামান খান। তাঁর ভাস্কর্য দেশে-বিদেশে স্থায়ীভাবে উন্মুক্ত উদ্যানে স্থাপিত হয়। পাশাপাশি হামিদুজ্জামান এদেশে জলরঙের জন্যও জনপ্রিয়। বহুমাত্রিক ধারায় সিদ্ধহস্ত একজন মানুষ।

হামিদুজ্জামান খান ধাতব বস্তুতে শৈল্পিক রূপ ফুটিয়ে তোলেন। একইভাবে পাথর কেটে-কুটে তিনি শৈল্পিক রূপ দিয়ে তৈরি করেছেন সেরা কিছু ভাস্কর্য। নিজের কাজের দক্ষতা অর্জনের জন্য সুদূর কম্বোডিয়ায় গিয়ে পাথরের বিশাল ম্যূরাল দেখে এসেছেন। নিজের সঞ্চিত সব অভিজ্ঞতা এবং বিগত বছরের শ্রম আর চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন স্টোনস শিরোনামের প্রদর্শনীতে।

blankপ্রদর্শনীতে তাঁর করা কাজ দেখছেন দর্শনার্থীরা

তাঁর শৈল্পিক জীবনের শুরুটা হয়েছিল আঁকাআঁকির মাধ্যমে। বাবা ছিলেন ধার্মিক মানুষ। যখন তিনি জানলেন ছেলে আঁকা-আঁকি করে, তিনি একদিন একটি বড় সুন্দর মসজিদের কাছে নিয়ে বললেন, ‘এটা আঁক তো’। 
তখন তিনি মসজিদের ছবি এঁকে বাবাকে চমকে দেন। তাঁর বাবা ওই ছবিটা মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আমার ছেলে এঁকেছে’। 
ইমাম সাহেব ছবিটা পছন্দ করায় বাবা ইমাম সাহেবকে ছবিটা উপহার দিয়েছিলেন। পরিবার থেকে সাপোর্ট পাওয়ায় আঁকার দিকে তাঁর ঝোঁক ধীরে ধীরে প্রবল হতে শুরু করে। ছোটবেলাতেই তিনি নিজের দাদার একটি স্কেচ এঁকেছিলেন। তখন তো ছবি-টবি ছিল না। স্কেচটা দাদার মুখাবয়বের সঙ্গে মিলে যাওয়ায়, ওই ছবিটাই ঘরে ফ্রেম করে রেখে দেওয়া হয়।

ইন্টারমিডিয়েটে পড়াকালে বাবার কাছে এসে আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য গোঁ ধরেছিলেন তিনি। বহু তর্কবিতর্ক, ভাবনাচিন্তা করে শেষপর্যন্ত তাঁর বাবা আর্ট কলেজে ভর্তি করার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসেন। ঢাকায় এসে শিল্পাচার্য জয়নাল আবেদীনের সহায়তায় চারুকলায় ভর্তি হন। সেখান থেকেই এই পথিকৃৎ এর শেখার পথচলা শুরু হয়।

blankনিজের সৃষ্টির সঙ্গে হামিদুজ্জামান

হামিদুজ্জামানের গ্যালারি কায়ায় প্রদর্শিত ভাস্কর্যগুলো হয় পাথরের চরিত্রনির্ভর, যার বেশির ভাগই ক্ষুদ্রাকৃতির। এসব কাজে তিনি কোনো না কোনো মোটিফ উপলক্ষ করেছেন। তবে পাথরের চরিত্রের বৈচিত্র্যের প্রতি তাঁর খেয়াল উল্লেখ করার মতো। নানা প্রকৃতির মার্বেল পাথর দিয়ে শিল্পকর্ম গড়েছেন তিনি। সভ্যতার ইতিহাসে বহুল ব্যবহৃত কারারা থেকে শুরু করে পিঙ্ক, ক্লাক-হোয়াইট-এসব মার্বেলের প্রাকৃতিক চেহারা ব্যবহার করেছেন ভাস্কর্যের সারফেসের বৈচিত্র্য ফুটিয়ে তুলতে।

blankফার্মগেইট মোড়ে স্থাপিত ইলিশের ভাস্কর্য

হামিদুজ্জামান খান ভাস্কর্যের গতানুগতিক ধারাকে ভেঙেচুরে এনেছেন আধুনিকতায়। ভাস্কর্য মানে যে শুধু মূর্তি নির্মাণ করা নয়-এটা তিনি বঙ্গভবনের ‘পাখি পরিবার’ থেকে বারিধারার ‘পাখি’ ভাস্কর্যের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের সামনে যে ইলিশ মাছ সবার দৃষ্টি কাড়ছে সেটিও তিনি করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে ধাতব নির্মিত ‘শান্তির পাখি’ এটিও তিনি গড়েছেন। আর এগুলো প্রতিটিই তিনি গড়েছেন অত্যন্ত আধুনিক ধারায়।

blankসংশপ্তক

ভাস্কর হামিদুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ। তাই তাঁর কাজের প্রিয় ক্ষেত্র মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের ওপর তিনি অনেক কাজ করেছেন। ১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত প্রথম জাতীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনীতে তাঁর ভাস্কর্য প্রথম পুরস্কার পায়। ভাস্কর্যটি ছিল ’৭১ স্মরণে ব্রোঞ্জের ‘দরজা’। এরপর তিনি একে একে করেছেন- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য ‘সংশপ্তক’, সিলেট জালালাবাদ সেনানিবাসে ব্রোঞ্জের ‘হামলা’, ময়মনসিংহ সেনানিবাসে ব্রোঞ্জের ‘মুক্তিযোদ্ধা’, টাঙ্গাইল ঘাটাইল সেনানিবাসে ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য’, বাংলা একাডেমিতে ‘মুক্তিযোদ্ধা’, আশুগঞ্জ জিয়া সারকারখানায় ‘জাগ্রত বাংলা’ উল্লেখযোগ্য। সিউল অলিম্পিক কোরিয়ায় হামিদুজ্জামানের ভাস্কর্য স্টেপস (সিঁড়ি) স্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয়েছে।

blank

কোরিয়ান অলিম্পিকে ব্যবহৃত হওয়া দ্য স্টেপস

হামিদুজ্জামানের কাজের ক্ষেত্রে যে বৈচিত্র্য রয়েছে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ উড়িরচরের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে মানুষের মৃত্যু, ধ্বংসলীলা, অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টকে তিনি স্থাপনা শিল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। যে কাজ স্থান পেয়েছে জাতীয় জাদুঘরে। তাঁর কাজের মাধ্যম ভাস্কর্য হলেও তিনি সব সময় জলরঙে ছবি আঁকেন। জলরঙ তাঁর জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

ভাস্কর্যশিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক, ঢাকা সিটির সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশন প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী পদক, বৃহত্তর ময়মনসিংহ সমিতি প্রদত্ত স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত ভাস্কর্য প্রদর্শনীতে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

blankতাঁর আরো কিছু দৃষ্টিনন্দন সৃষ্টি

বর্তমানে তিনি ধাতব এবং পাথরের সঙ্গে সঙ্গে অ্যাক্রিলিক মাধ্যমের বৈশিষ্ট্য ও সম্ভাবনাসমূহকে খতিয়ে দেখছেন একাগ্র অনুশীলনে। ধ্যানীর মগ্নতায় তিনি আকৃতি ও পরিসরের আন্তঃসম্পর্ককে অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন। তাঁর এ সাধনা যেন ফুরাবার নয়। আরোও ভালো স্থপতি তৈরি করে তিনি আরো নন্দিত হবেন, এমনটাই প্রত্যাশা।