ঘুম ভেঙে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বিষন্ন একটা হাসি ফুটল মেয়েটার ঠোঁটে। একগাদা মেসেজ জমে আছে মোবাইলে। আজকে বন্ধুদিবস কিনা! সবাইকে ফোন করবে ভেবে ছোট ভাইটাকে রিচার্জ করতে পাঠিয়ে বিছানা ছাড়ল সে। ঘড়িতে তখন দশটা বেজে সতেরো।
বাইরে চমৎকার আবহাওয়া। আকাশটা মেঘে ঢাকা থাকায় সূর্য তার তেজ দেখাতে পারছে না। সেই সাথে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। ঘোরাঘুরি করার জন্য আদর্শ আবহাওয়া। বন্ধুবৃত্তের একেকজন একেক জায়গায় থাকায় বহুবছর একসাথে ফ্রেন্ডশীপ ডে পালন করা হয়না। ভাগ্যগুনে এবার সবাই একই জায়গায় আছে। খুব সহজেই একটা হ্যাংআউটের ব্যবস্থা করা যায়। খুশিমনে মেহেরের নাম্বারটায় ডায়াল করল ও।
“হ্যাপি ফ্রেন্ডশীপ ডে!” ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে চিৎকার করে বলল মেয়ে। মন খারাপ থাকলেও উচ্ছ্বাসটায় কোন খাদ ছিল না। ফ্রেন্ডদের সত্যিই খুব ভালোবাসে ও।
কিন্তু ওপাশের কথা শুনতে শুনতে হাসিটা মুছে গেল ওর মুখ থেকে। মেহের বেরুতে পারবে না। বাসায় মেহমান। লাইন কেটে যাওয়া ফোনটা কান থেকে না নামিয়েই কল্পনায় বছর চারেক আগের অতীতে চলে গেল ও।
অগাস্টের প্রথম শনিবার রাতে মেহেরের বাসায় রংবেরঙের একগাদা রেশমী সূতা নিয়ে বসেছে মেয়েটা। দুজনেই তিনগাছি তিন রঙ্গের সূতা দিয়ে ফ্রেন্ডশীপ বেল্ট বানাতে ব্যস্ত। যে যত ধরনের পাঁক জানে, সব ধরনের পাঁক দিয়ে বিভিন্ন রকমারির ব্রেসলেটে পরিণত হচ্ছে সূতার গাছি গুলো। চাইলেই ওরা কিনে নিতে পারে ফ্রেন্ডশীপ বেল্ট। কিন্তু হাতে বানানোতে আলাদা একটা মজা। দুজনেই দারুণ উত্তেজিত… পরদিন সব বান্ধবীদের হাতে নিজে ফ্রেন্ডশীপ বেল্ট বেঁধে দেওয়া ছাড়াও আরো কি কি মজা করবে সেই ভাবনায় ঘুম আসছে না দুজনের কারোর চোখেই।
ধুর! অতশত ভেবে লাভ নেই। তখন ছোট ছিল। উত্তেজনা তো থাকবেই! এখন বড় হয়ে গেছে না! এখন কি আর ফ্রেন্ডশীপ বেল্ট বানাবার মত সময় আছে ওদের কাছে? এইগুলা সব ছেলেমানুষি কাজ! ওদের কি আর এসবে এখন মানায়? দুঃখ দুঃখ ভাবটা দূর করার জন্য মাথা ঝাঁকিয়ে নিলো। যেন এতেই সব কিছু ভুলে যাবে।
ভাবতে ভাবতেই নুসরাকে কল করল সে। বোনের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এবারের ছুটিতে ওর সাথে দেখা হয়েছে মাত্র একবার। ও কি আজ ফ্রি আছে?
ঘুমঘুম গলায় হ্যালো শুনে বুঝল, বান্ধবী এখনো ঘুমাচ্ছে। উইশ পর্ব শেষ করে জিজ্ঞেস করল, নুসরা এখনো বিছানায় কী করছে। উত্তর শুনে আবারো মন খারাপ হয়ে গেল মেয়েটার। পেট ব্যথা নুসরার। গত কয়েকদিন বোনের বিয়েতে দৌড়াদৌড়ি করে শরীরও অনেক দূর্বল। বেরুতে পারবে না।
আরেক ফ্রেন্ডশীপ ডে তে ফিরে গেল মেয়েটার মন। স্মৃতিগুলো খুব জ্বালাচ্ছে আজ!
ক্লাস সেভেন থেকেই নুসরার ফালতু এই রোগ। ভয়াবহ পেট ব্যথা! কয়েক দিন পরপরই হয়। কত ডাক্তার দেখালো, কত ঔষধ খেল। কিছুতেই কিছু হয়না। সেবার ফ্রেন্ডশীপডের আগের দিন ওর এই ভয়াবহ পেট ব্যথা উঠল। বমিটমি করে একাকার অবস্থা! কিছুই খেতে পারে না। স্যালাইন দিয়ে রাখতে হচ্ছে। বন্ধুবৃত্তের সবাই মিলে ওর বাসায় গেল ওকে দেখতে। গিয়ে দেখল স্যালাইনের পাইপ হাতের শিরায় নিয়ে বিছানায় নেতিয়ে পড়ে আছে নুসরা। বন্ধুদের দেখে মলিন একটা হাসি দিল ও।
ঘন্টা দুয়েক আড্ডা দিল ওরা সবাই নুসরার বিছানায় বসে। নুসরার আম্মু বিশাল এক ট্রে ভর্তি করে নানারকমের মজাদার খাবার দিয়ে গেছেন। কিছুক্ষণ পর হুড়াহুড়ির শব্দ শুনে উকি দিয়ে তিনি দেখেন, নুসরা তার বান্ধবীদের সাথে খাবার কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে! স্যালাইন এর সুঁই হাত থেকে খুলে ফেলেছে বহু আগেই। হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। যেই মেয়ে গত দুদিন ধরে কিছুই খাচ্ছে না, তাকে আজ মারামারি করে খাবার খেতে দেখলে অবাক তো হবারই কথা। খাওয়া-দাওয়া আর আড্ডাবাজি শেষ করে ফেরার সময় মেয়েটা ওর কানেকানে বলে গেল; “কাল যেন সময়মতো কলেজে পাই তোকে!”
কলেজে ওদের আড্ডার জায়গা ছিল, হোস্টেলের সামনের জায়গাটা। কলেজ ক্যাম্পাসের ভিতরে হলেও, স্যারেরা হোস্টেলের সামনে তেমন একটা আসতেন না। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডা মারলেও, দেখার মত কেউ ছিল না।
পরদিন নুসরা ঠিক গিয়েছিল কলেজে। সাথে ৫-৬ ধরনের জরি মিশ্রিত রং নিয়ে। ওরা সবাই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কলেজের হোস্টেলের সামনে রং মাখিয়ে দিয়েছিল সবার মুখে। তবে ওর নিজের মুখেই সবচেয়ে বেশি রং দেওয়া হয়েছিল। সবাই মিলে ওকে রং লাগিয়ে দিয়েছিল, ইচ্ছেমত।
তারপর রং মেখে সং সেজে, হোস্টেলের গেইট দিয়ে চুরি করে বের হয়ে, এক রিকশায় চারজন উঠে পুরো শহর ঘুরেছিল ওরা। আর আজ সেই মেয়ে বিছানায় পড়ে ঘুমাচ্ছে। টিনএজ এর সেই এনার্জি কি আর এখন আছে?
বিষণ্ণ মন আরো বিষণ্ণতর করে আদ্রিতাকে কল করল মেয়েটা। জানে ওকে পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে শূন্যের কৌটায়। একে তো বাসা দূরে, তার উপর বাপ অসুস্থ। তবুও জিজ্ঞেস করে তো দেখা যাক।
নাহ! দুইটা নাম্বারে কল করেও পেল না ওকে। একটা মেসেজ দিয়ে রেখে রুম থেকে বের হল মেয়েটা। ওর রুমের পিছনেই একটা শানবাঁধানো পুকুরঘাট আছে। ওখানে গিয়ে বসবে।
পুকুরের ইট সিমেন্টের চেয়ারে বসল সে। পুকুরের চারপাশে গাছপালা থাকায় এখানে অনেক বাতাস । ভালোই লাগছে ওর।
এই পুকুরের একটা বিশেষত্ব হলো, এটা একটা পুকুর হলেও এর পানি স্থির নয়। নদীর সাথে সংযুক্ত পুকুরটা। যারফলে জোয়ার ভাটায় পানি উঠানামা করে। ঘাটের সিঁড়িতে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করছে। এখন জোয়ার না ভাটা , বুঝতে পারছেনা মেয়েটা। সিঁড়ির সাথে পানির সংঘর্ষে তৈরি হওয়া ছোট ছোট ঢেউগুলির তাকিয়ে ওর বিশেষ একজন বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল।
অনেক আগের কথা। কতই বা বয়স তখন? ৪-৫ হবে। আম্মুর সাথে পুকুরপাড়ে এসেছিল মেয়েটা। আম্মু গোসল করবে। আর ও বসে থাকবে পুকুরপাড়ে। আম্মু কোমর পানিতে নেমে হাসি হাসি মুখে বলল, “আম্মু, আমি হারায় যাই?”
ছোট্ট মেয়েটা তখন বুঝতে পারছিল না, আম্মু কীভাবে হারাবে। ডাগর ডাগর চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল। আম্মু ফিক করে হেসে ঝাপ দিয়েছিল পানিতে। অবাক চোখে ছোট্ট মেয়েটা দেখল , আম্মু একটু আগে যে জায়গায় ছিল, সেখানে গোল গোল ঢেউ ছোট থেকে বড় হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আম্মুকে দেখল না কোথাও। ভয় পেয়ে কেঁদে ফেলবে, তার আগেই দেখে আম্মু ভুশ করে পানির উপরে ভেসে উঠেছে! পুকুরের অপর পাড়ে। আম্মুকে ওপারে দেখে খুশিতে হাততালি দিয়ে ফেলল সে। বলল, “আবার হারাও! আবার হারাও!”
আম্মু আবার ডুব দিয়ে এপাড়ে চলে এল। তা দেখে আরো মজা পেয়ে গেল ও। আম্মু কি জাদু জানে? কীভাবে এপারে চলে এল আম্মু? কী করেই বা ওপারে গেল? ভাবতে ভাবতেই দেখল, আম্মু সিঁড়ির উপরে নাই। ডুব দিয়েছে আবার! সে ওপারে তাকিয়ে রইল, এক্ষুনি নিশ্চয়ই আম্মু ওপারে ভেসে উঠবে? তাকিয়ে রয়েছে তো রয়েছেই। আম্মুর ভেসে উঠার কোন খবরই নেই!
এইবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেল ছোট্ট মেয়েটা।
“আম্মু!” বলে কেঁদে ফেলল ও। পুকুরের পাড়ে বাঁধা পেয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এল ওর ডাক।
তার অল্পকিছুক্ষন পর আম্মু ভেসে উঠল। না; ওপারে নয়। এপারেই!
আম্মুকে দেখে কেঁদে ফেলে আম্মুর কোলে ঝাপিয়ে পড়তে পানিতে নামতে যাচ্ছিল ও। আম্মু জলদি পানি থেকে উঠে এসে ওকে কোলে নিয়েছিল।
“তুমি আর হারাবা না! তুমি আর হারাবা না! আমি আর জাদু দেখতে চাইনা!” কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল ও।
টপ করে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে হাতের উপর পড়ল মেয়েটার। ছোটবেলার অই ঘটনাটা একদম স্পষ্ট মনে আছে ওর। সিঁড়িতে এখনো ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হচ্ছে। পানি একসিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। এখন তাহলে জোয়ার।
মেসেজ টোন শুনে মোবাইল টা হাতে নিলো ও। আদ্রিতার মেসেজ। যা ভেবেছিল, তাইই। ক্লাস শুরু হওয়ায় ঢাকায় ব্যাক করেছে ও। আসবে না।
আহা! শেষ যেবার একসাথে ওরা সবাই ফ্রেন্ডশীপ ডে পালন করেছিল, কী মজাই না হয়েছে সেদিন। অবশ্য এখন শুধু একটা ঘটনাই মনে আছে মেয়েটার।
রেললাইনে (রেললাইন ছিল ওদের প্রধান আড্ডাস্থল) দাঁড়িয়ে আদ্রিতার হাতে ফ্রেন্ডশীপ বেল্ট বেঁধে দিচ্ছিল নুসরা। একটা ছেলে খুব ভাব নিয়ে মোবাইল দিয়ে ছবি তুলতে গেল। নুসরা মুখ তুলে বলল; “ছবি তুলবেন? আগে বলবেন না! দাঁড়ান পোজ দিয়ে নেই!”
ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করলো। বুঝতে পারেনি, মেয়েটা এইভাবে কথা বলবে। আহা! কি দিনই না কেটেছিল সেই সময়।
ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। দৌড়ে ছাদে চলে গেল মেয়েটা। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বান্ধবীদের নিয়ে আরো কত স্মৃতি যে মনে পড়ছে। টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো যেন চোখের সামনেই ভাসছে। আজকের দিনটা না হয় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করবে। খারাপ তো লাগছে না!
বৃষ্টি থেমে গেছে। শরতের বৃষ্টি , এই আছে এই নেই! মেঘের কোল ঘেষে সূর্য উকি দিয়েছে। পুবাকাশে হালকা রঙ্গের একটা রংধনু জেগে উঠছে। পেজা পেজা তুলার মত সাদা মেঘ ছুটোছুটি করছে নীল আকাশে। অসম্ভব সুন্দর একটা দৃশ্য।
রেলিং বিহীন ছাদের কার্নিশে একটা মেয়ে বসে আছে পা ঝুলিয়ে। শেওলাসবুজ পুকুরের পানিতে তার ছায়া পড়েছে। হালকা ঢেউয়ে ছায়াটা কেঁপে উঠছে কিছুক্ষণ পরপর।
মেয়েটা উদাস দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে রংধনুটার দিকে।
ভেজা কাপড়ে কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে। ঘরে গিয়ে, কাপড় বদলে, ড্রয়ারবন্দী করে রাখা বিশেষ ব্যাগটা আলতো হাতে বের করে, বিছানায় বসলো মেয়েটা। পেটমোটা হ্যান্ডব্যাগ। ব্যাগভর্তি চিঠি। এই একুশ শতকে এসেও মেয়েটার ছিল চিঠির প্রতি প্রবল আকর্ষণ। কতশত চিঠি চালাচালি করেছে একসময়।
হ্যান্ডব্যাগের চেইন খোলার সাথে সাথে একগাদা স্মৃতি ছড়িয়ে পড়লো মেয়েটার চারপাশে। জায়গায় জায়গায় ভাসতে থাকলো দলবেঁধে। একেকটা চিঠিতে কত কত গল্প … !
এইসব চিঠি-লেখিয়ে বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই আর নেই। অনেক দূরে সরে গেছে। সবচেয়ে বেশি চিঠি যে বন্ধুটার, তাকে সে “বন্ধু” বলেই ডাকতো। তার সবগুলি চিঠি আলাদা করে একজায়গায় রাখতে গিয়ে একটা লাইন বিশেষভাবে নজর কাড়লো। “আজীবন বন্ধু হয়ে থাকতে চাই!”
হাহ! একটা বিষণ্ণ হাসি ঠোঁটে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।
বড় বড় চিঠির সাথে বেশ কিছু চিরকুট ও আছে। ক্লাসে বসে যেসব ফাজলামো করে লিখে একে অপরকে ছুঁড়ে মারা চিরকুটগুলি; কিংবা মান অভিমান পর্বের আবেগী হাস্যকর কিছু বাক্য …ছোট ছোট সেই দুষ্টুমিগুলিকে কী আপন-ই না লাগছে!
নিজের লেখা কয়েকটা চিঠির খসড়া পেল মেয়েটা। সাথে বেশ কিছু খামও রয়েছে। কিছু কিছু খামে লেখা সৌজন্য বাক্য, কিছু কিছুতে ফাইজলামি। প্রাপক প্রেরকের নামের জায়গায় এমন সব নাম লেখা, যা পড়তে গিয়ে আপনমনেই খিলখিল করে হেসে ফেলল মেয়েটা।
সবচেয়ে বেশি মজা পেলো নীলুর চিঠিগুলি পড়ে। এত মজা করে ফাজিলটা চিঠি লিখে… রং বেরং এর কালি দিয়ে বিশাল বিশাল সব চিঠি! মেয়েটা একমাত্র ওর চিঠিগুলিই আগাগোড়া সবখানি পড়লো। অবশেষে স্থায়ী হাসি ফুটলো তার ঠোঁটে। অনাবিল আনন্দের হাসি। সবগুলি পড়ে শেষ করতে করতে একা একাই হেসে গড়িয়ে পড়লো। বন্ধুদিবসের শেষটা অন্তত হাসিমুখে শেষ হলো মেয়েটার …
কী যে লিখেছি, নিজেই জানিনা। আবোলতাবোল হিজিবিজি কিছু বাক্য ছাড়া আর কিছুই নয়। সবাইকে বন্ধুদিবসের শুভেচ্ছা।