মোতিঝিল মসজিদের ছবি।
‘মতিঝিল’ শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি কৃত্রিম শাপলা ফুলকে ঘিরে ব্যস্ততম এই ঢাকা শহরের একটি কর্মব্যস্ত অঞ্চলের ছবি। কিন্তু আজ যে মতিঝিলের কথা বলবো সেই মতিঝিল ঢাকা শহরের এই মতিঝিল নয়। এই মতিঝিল ঢাকার বাইরে তথা এই দেশের সীমানা পেরিয়ে অন্য একদেশে অবস্থিত।
তবে এই মতিঝিল নিয়ে কিছু বলতে গেলে প্রথম লাইন শুরু করতে না করতেই চলে অাসে ঢাকার নাম। কারণ এই মতিঝিল ঢাকার মতিঝিল না হলেও ঢাকার সাথে তার একটি সম্পর্ক রয়েছে। কেননা আজ যে মতিঝিলের কথা বলছি সেই মতিঝিল যিনি তৈরী করেছেন তিনি ছিলেন এই ঢাকার নবাব। নবাব ছিলেন ঢাকার আর মতিঝিল নির্মাণ করেছেন দেশের বাইরে! কৌতুহল জাগাটাই স্বাভাবিক। এগুলো অনেক আগের কথা। তখনও বাংলাদেশের জন্ম হয়নি।
তখন ছিলো নবাবী আমল। বাংলা তখন ছিলো একটি প্রদেশ মাত্র। অার বাংলার রাজধানী ছিলো ঢাকা। তৎকালীন ঢাকার নবাব ছিলেন নওয়াজেশ মোহাম্মদ খান। তিনিই বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী মূর্শিদাবাদে তৈরী করেছিলেন এই মতিঝিল।’মুর্শিদাবাদ’, বাঙালীর রক্তের সাথে মিশে আছে এই নাম। বাঙালীর শিকড়ের সাথে মিশে আছে এই নাম। এই নামটি শুনলেই বাঙালী ব্যথিত হয়ে উঠে। হৃদয়ের মানসপটে ভেসে উঠে ২৩ বছরের টগবগে যুবক বাংলা বিহার উড়িষ্যার স্বাধীন শেষ নবাব, নবাব সিরাজউদ্দৌলা । এই মূর্শিদাবাদে পলাশীর প্রান্তরেই পরাজিত হয়েছিলেন বাংলা বিহার উড়িষ্যার স্বাধীন শেষ নবাব,নবাব সিরাজউদ্দৌলা। অার পরবর্তী দুশো বছরের জন্য ভগীরথি নদীর জলে অস্তমিত হয়েছিলো বাঙালী ও বাংলার স্বাধীনতার সূর্য।
সেই সাথে মনে পড়ে যায় একটি ষড়যন্ত্র ও কয়েকজন বিশ্বাসঘাতকের কথা, যাদের ষড়যন্ত্রই ডেকে এনেছিলো বাংলার ভাগ্যাকাশের এই বিপর্যয় ও নবাবের করুণ মৃত্যু। তাদের বাঙালী চিনে, তাদের বাংলা চিনে। এরা হলেন মীর জাফর, উমিচাঁদ, জগৎ শেঠ, রাজ বল্লভ প্রমুখ ও নবাবের আপন বড় খালা ঘষেটি বেগম।ইতিহাসের বুকে যিনি জায়গা পেয়েছেন বিশ্বাসঘাতীনি নারী হিসেবে। এই ঘষেটি বেগমের স্বামীই হলেন মতিঝিলের প্রতিষ্ঠাতা এবং তৎকালীন ঢাকার নবাব নওয়াজেশ মোহাম্মদ আলী খান। নবাব নওয়াজেশ ঢাকায় থাকলেও ঘষেটি বেগম থাকতেন মূর্শিদাবাদে। ঘষেটি বেগমের প্রাসাদের নাম ছিলো সিংহী দালান। প্রাণপ্রিয় সহধর্মিনীর কথা ভেবেই হয়তো সিংহী দালানকে ঘিরে এক হাজার পঞ্চাশ বিঘে জমি নিয়ে নবাব নওয়াজেশ তৈরী করেছিলেন মতিঝিল। এই হাজার পঞ্চাশ বিঘে এলাকার সাতশো বিঘে জুড়ে নবাব খনন করেন ঘোড়ার খুড়াকৃতির একটি জলাশয়। এই জলাশয়ের এক কিনার ঘেষেই অবস্থান করছিলো গৌড়ের ধ্বংসস্তুপ থেকে তৈরী ঘষেটি বেগমের প্রাসাদ সিংহী দালান।
এবার আসি মতিঝিলের নামকরনে। নবাব নওয়াজেশ মতিঝিল তৈরী করলেও তখন কিন্তু জায়গাটা মতিঝিল নামে পরিচিত ছিলোনা। জায়গাটির মতিঝিল নামকরন করেন বাঙলা বিহার উড়িষ্যার তৎকালীন নবাব আলীবর্দী খা।নবাব আলীবর্দী খা’র জামাতা ঢাকার নবাব নওজেশ ছিলেন মুক্তো ব্যাবসায়ী। তিনি সাগর থেকে সংগৃহীত বড় বড় ঝিনুক এনে ছাড়তেন সাতশো বিঘের ঐ জলাশয়ে। ঐ জলাশয়ে ঝিনুকগুলো একসময় মুক্তোবতী হলে ঐ মুক্তো, মোতি নবাব নওজেশ উপহার দেন নবাব আলীবর্দি খাঁ’কে। নবাব আলীবর্দি খা মুক্তোগুলো উপহার পেয়ে খুবই খুশী হন এবং জলাশয়টির নাম দেন মতিঝিল। যা পরবর্তীতে পুরো জায়গাটির নামে রুপান্তরিত হয়।
সিংহী দালানের কোল ঘেঁষে এই ইউ আকৃতির মোতিঝিল খননের পূর্বে জায়গাটিতে সাধারন একটি খাল ছিলো। এই খালটিকে হঠাৎ সাতশো বিঘে জায়গাসহ ঘোড়ার খুড়াকৃতির জলাশয়ে পরিনত করলেন কেনো নবাব নওয়াজেশ? শুধুই কি মুক্তোচাষের জন্য?নাকি শুধুই ঘষেটি বেগমের সিংহী দালানের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য? নারে ভাই, উনারা নবাব মানুষ।মাথায় নবাবী বুদ্ধি। পান থেকে চুন খসালেও বহুত হিসেব নিকেষ করে খসান, ভূত ভবিষ্যত চিন্তা করে খসান, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের চিন্তা ভাবনা করেও খসান। নবাব নওয়াজেশের তেমনই একটি চিন্তার ফসল এই ইউ আকৃতির সাতশো বিঘের মতিঝিল। মতিঝিল খননের মূল কারণ হচ্ছে সিংহী দালানের নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরী করা। শত্রুরা যেনো তিন দিক থেকে সিংহী দালানকে আক্রমন করতে না পারে সেদিক বিবেচনা করেই সৃষ্টি এই মতিঝিলের। এছাড়া এই সাতশো বিঘের নিগূড় রহস্য হচ্ছে এই দূরত্বটা তৎকালীন কামানের রেন্জের বাইরে। অর্থাৎ শত্রুর ছোড়া কামানের গোলার আচড় যেনো সিংহী দালানকে স্পর্শ করতে না পারে সেকথা ভেবেও সৃষ্টি এই মতিঝিলের। কি ভাই? এবার বুঝেছেন কত মাপঝোক, জ্যামিতিক ক্যালকুলেশন, বৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনা ঘাপটি মেরে আছে এই মতিঝিলে!
মতিঝিল শুধুই যে সিংহী দালান ও জলাশয় নিয়ে তা কিন্তু না। তিনশো বিঘে জুড়ে রয়েছে অসংখ্য গাছ গাছালী।এছাড়া আরও কিছু স্থাপনাও রয়েছে এই মতিঝিলে। এই মতিঝিলে ঘুমিয়ে আছে কিছু নবাবী আমলের মানুষ। অর্থাৎ সমাধিস্থলের কথা বলছিলাম। মতিঝিলে রয়েছে ছোট্ট একটি কবরস্থান। যেখানে নবাব নওয়াজেশসহ ঘুমিয়ে রয়েছে আরও তিনজন। সমাধিস্থলের প্রথম সমাধিটিতে চির ঘুমে ঘুমিয়ে রয়েছেন নবাব নওয়াজেশ মোহাম্মদ খান। তার পাশের সমাধিটা ঘষেটি বেগমের পোষ্য পুত্র একরামউদ্দৌলার।এই একরামউদ্দৌলা মূলত নবাব সিরাজউদ্দৌলার আপন ভাই। খালা ঘষেটি বেগম তাকে দত্তক নিয়েছিলেন। ইনি নবাব সিরাজের নবাবী লাভের এক বছর আগে বসন্ত রোগে মারা যান। ভাই চির ঘুমে ঘুমিয়ে আছেন ভাইয়ের হত্যাকারীর স্বামীর পাশে! বাস্তব কি অপ্রিয়! বাস্তব কি অদ্ভুত!
একরামউদ্দৌলার পাশের সমাধিটি তার গৃহ শিক্ষকের। আর সমাধিস্থলে বাইরেই রয়েছে আর একটি সমাধি। সমাধিটি একরামউদ্দৌলার সেবিকার। আজ কত শত মানুষের আসা যাওয়া এই মতিঝিলে।কত শত চোখ ছুয়ে যায় এই চারটি সমাধি। চির ঘুমে ঘুমিয়ে থাকা এই চারজন কি তাদের কোলাহল শুনতে পান? তারা কি এই মতিঝিলের জৌৎস্নারাতে বয়ে যাওয়া শনশন বাতাসের শব্দ আজও উপভোগ করেন? এর উত্তর সকল সৃষ্টির রহস্য যার হাতে তার জানার কথা।আমাদের না।
আজ নবাব নওয়াজেশ নেই, নেই ঘষেটি বেগম, নেই তাদের গোলাম বাদী শুভাকাংখী, নেই সিংহী দালান, নেই সেই নবাবী আমল ও তার নিয়ম নীতি।তবে সব ঘুমিয়ে গেলেও মতিঝিলের পঞ্চাশ বিঘের ওপর নির্মিত মসজিদ কমপ্লেক্সের মসজিদটি কিন্তু আজো জেগে আছে। বদলায়নি তার নিয়ম কানুন। আগেও যেমন পাচবার আযান পড়তো, পাচ ওয়াক্ত নামায হতো, এখনও তেমনই হয়। শুধু মানুষগুলো পাল্টে গেছে।অার পাল্টে গেছে মসজিদের ইট সুরকির চেহারা।
মতিঝিলে কি শুধু সৌন্দর্য্যই অছে? রহস্য নেই? নবাবী আমলের কথা হচ্ছে, ষড়যন্ত্রকারীর বাসভবনকে ঘিরে তৈরী জায়গার কথা হচ্ছে রহস্য ছাড়াই তা শেষ হবে, তা কি হয়? মতিঝিলেও রয়েছে রহস্য। রহস্যটির নাম দিলাম মতিঝিল রহস্য তথা গুপ্তঘর রহস্য। দরজা জানালা বিহীন একটি ঘর এই গুপ্তঘর। এই ঘরের নাম যে শুরু থেকেই গুপ্তঘর, তা কিন্তু না। কিংবা গুপ্তঘর নামটি যে তৎকালীন নবাবদের কারো দেয়া তাও না। আগে থেকেই যে এই ঘর রহস্যঘর তেমন কিছুও না। প্রশ্ন জাগতে পারে দরজা জানালাবিহীন এই গুপ্ত ঘরটি কেই বা বানিয়েছিলেন? কে আাবার? ইতিহাসের পৃষ্ঠায় বিশ্বাসঘাতক নারী হিসেবে যিনি নাম লিখিয়েছেন সেই ঘষেটি বেগম।
ইংরেজরা যখন এই বাংলা বিহার উড়িষ্যার পুরোদস্তর দখল নিলো তখন নবাব পরিবারের সবার সম্পত্তি, মালামাল ক্রোক করার সময় ঘষেটি বেগমের সিংহী দালানে যখন কানকড়িও খুজে পাওয়া গেলোনা তখন তাদের যেনো ভীমড়ি খাওয়ার মত অবস্থা! নবাবের বড় মেয়ে, ঢাকার নবাবের স্ত্রী, তেজস্বিনী ঘষেটির বেগমেরতো অবশ্যই ধন সম্পদের প্রাচুর্য থাকার কথা। তবে তার দালানে কানাকড়িও নেই কেনো? কোথায় পালালো তার প্রাচুর্য! তখন ইংরেজদের চোখ পড়ে এই দরজা জানালাবিহীন ঘরটির ওপর।নিশ্চয়ই ঘষেটি তার দালান থেকে সুড়ঙ্গ করে এই ঘরটিতে তার সমস্ত সোনা দানা মনি মুক্তো হিরে জহরত লুকিয়ে রেখেছেন।অতএব কি করতে হবে? দরজা জানালাহীন ঘরটি ভেঙে দেখতে হবে কি অাছে ওতে। যেই ভাবা সেই কাজ। ঘরটির সামনে কামান ফিট করা হলো, গোলা নিক্ষেপ করা হলো। কামানের প্রথম গোলায় ঘরটি ধ্বংস না হলেও ধ্বংস হয়ে গেলো কামান চালক। গোলা ছোড়র পর পরই রক্তবমি করে মরে গেলো কামান চালক। তারপর থেকে অাজ অবধি ঘরটিকে অার কেউ ঘাটাতে যায়নি। ঘরটি অাজ অবধি রহস্যই রয়ে গেলা। কারও জানা হলো না ঘরটিতে কি এমন রাখতেন ঘষেটি বেগম!
অাজ তারা কেউ নেই তবে এই মতিঝিল রয়ে গেছে, রয়ে গেছে গুপ্ত ঘরটি, সাথে রয়ে গেছে রহস্য। প্রতিদিন কতশত পর্যটক এই মতিঝিলে অাসেন।ফিরে যাওয়ার সময় তারাও হয়তো এই গুপ্তঘরে রহস্য মাথায় করে বয়ে নিয়ে য়ান। কি এমন ছিলো এই গুপ্তঘরে? কি কাজেই বা এই ঘর ব্যাবহার করতেন ইতিহাসের কালনাগিনী ঘষেটি বেগম? প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে অামিও শেষ করলাম মতিঝিল কথন।