ভ্রমণ পিপাসুরা বিরত থাকুন সেইসব ভূতুড়ে স্টেশন থেকে যেখানে সত্যিই রয়েছে অদৃশ্য ছায়ামূর্তির আনাগোনা আর…
শুনশান নির্জন রাত। অফিসের কাজ শেষ করতে দেরী হয়ে গেল আপনার। সন্ধ্যার ট্রেনটি অল্পের জন্য মিস হয়ে গেল। কি আর করার। যে করেই হোক শেষ ট্রেনটি ধরার জন্য ছুটলেন স্টেশনের দিকে। আজকের রাতের শেষ ট্রেনটি স্টেশনে পৌঁছতে এখনও বেশ কিছুটা সময় রয়েছে। শেষ ট্রেনের অপেক্ষায় আপনি প্লাটফর্মে একা। ইতস্তত:ভাবে কিছু লোক এদিক সেদিক ঘুরোঘুরি করলেও নির্জনতা বেশ স্পষ্ট। চারদিকের যেন এক অদ্ভুত নির্জনতা। হয়তো অনুভব করছেন অদৃশ্য কিছু ছায়ামূর্তির । আপনার মনে ফিরে এল সাম্প্রতিক কিছু খবর। গত হপ্তার পত্রিকার পাতায় স্টেশনে এক মহিলার আত্মহত্যার কথা পড়েছিলেন বোধ হয়। এই স্টেশনেরই কি? না বোধহয়। এই স্টেশন নিয়ে বিপিন বাবু কি একটা কথা বলছিলেন যেন সেদিন । কোন এক সাদা শাড়ি পড়া বিধবা মহিলার কান্না জড়িত কন্ঠে ভিক্ষা চাওয়ার কথা। ভিক্ষা দিতে গেলে যে অদৃশ্য হয়ে যায়। আজকেই এই বাজে গল্প মনে পড়তে হলো আপনার। হঠাৎ মনে হতে থাকলো দূরে কোন কান্নার শব্দ। আপনার যৌক্তিক মন আর কাজ করছে না। সেখানে গ্রাস করছে ভয়। ভয়ে অস্থির হয়ে উঠলেন। কখন আসবে ট্রেন! যারা ট্রেনে ভ্রমণ করেন এবং মাঝে মধ্যে শেষ লোকালের জন্য প্লাটফর্মে অপেক্ষা করেন তারা এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেই পারেন। কিন্তু জানেন কি পৃথিবীতে এমন অনেক রেল স্টেশন আছে যেখানে যাত্রীরা প্রায় সময় নানা অদ্ভুত সব ভুতূড়ে উপদ্রবের সম্মুখীন হন। আসুন আজ বিশ্বের ১০ অদ্ভূত ভুতূড়ে স্টেশনের গল্প শুনবো, যেখানে কর্মরত নিরাপত্তারক্ষী হতে শুরু করে যাত্রীর অভিযোগ এখানে সত্যিই ভূত আছে।
১। ওয়াটারফ্রন্ট স্টেশন, কানাডা
কানাডার ভেনক্যুবেরে অবস্থিত ওয়াটারফ্রন্ট রেলস্টেশন তৈরি হয় ১৯১৫ সালে। তখন থেকেই এটি ভুতুড়ে স্টেশন নামে সকলের কাছে খুবই পরিচিত এক নাম। রাতে এই স্টেশনে নানা অদ্ভূতুড়ে কান্ড কারখানা হয় বলে স্টেশনের বহু নিরাপত্তারক্ষীর অভিযোগ। তারা দাবী করেন যেসব নিরাপত্তারক্ষীরা রাত্রে ডিউটি করেন তারা মাঝে মধ্যেই ভূত দেখতে পান। এক নিরাপত্তাকর্মীর ভাষ্যমতে, ‘ সেদিন রাতে প্রতিদিনের মতো ডিউটি দিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখতে পায় ১৯২০ সালের সময়কার ড্রেস পরিহিত এক সুন্দর নারী সেময়ের এক জনপ্রিয় গানের সুরে নাচছে। যেই কাছে গেলাম অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। এরকম নানা অদ্ভুত সব ঘটনা নাকি এই স্টেশনে প্রতিনিয়ত ঘটে, কোন না কোন নিরাপত্তাকর্মী যার সাক্ষী।
২। বি সান এমটিআর স্টেশন, সিঙ্গাপুর
সিঙ্গাপুরের বেশ কয়েকটি এমটিআর (মাস র্যাপিড ট্রান্সপোর্ট) স্টেশনে ভুতের অস্তিত্ব রয়েছে বলে অনেকের অভিমত। এর মধ্যে বি সান এমটিআর স্টেশন অধিক পরিচিত। তেঙ্গ সিমেট্রির উপর তেরি করা হয় এই স্টেশনটি। চালু হয় ১৯৮৭ সালে। এরপর শুরু হয় একের পর এক ভুতের ট্রেলার। কখনো যাত্রীর দিকে এগিয়ে আসে অদৃশ্য হাত। আবার কখনো মুন্ডহীন যাত্রীকে দেখতে পাওয়া যায় মেট্রোর ভিতর। যাত্রীরা প্রায় অনভব করেন কোন আবছায়া মুর্তির সারা প্লাটফর্ম জুড়ে ছুটে বেড়ানো। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভুতুড়ে ঘটনা দেখতে পান রেললাইন রক্ষনাবেক্ষণের এক কর্মী। তিনি দেখেন কবরখানা থেকেউঠে আসা এক শবদেহ চলন্ত ট্রেনের পাশ দিয়ে দৌড়ে ছুটে যাচ্ছে।
৩। কাওবাও রোড সাবওয়ে স্টেশন, চিন
চিনের সাঙঘায়ে অবস্থিত কাওবাও মেট্রো স্টেশনের নাম কি শুনেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে ভূতুড়ে স্টেশন হিসেবে এর বেশ নামডাক রয়েছে। এই স্টেশনের ১ নম্বর লাইনটিতে ঘটে অদৃশ্য সব ভয়ার্ত ঘটনা। হঠাৎই ট্রেনের কোন ব্রেকে সমস্যা দেখা দেয়। এই মেট্রো স্টেশনেই নাকি বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ার্ত মেট্রো স্টেশন৷ এই মেট্রো স্টেশনে এলেই ট্রেনের ব্রেকে সমস্যা দেখা যায়৷ রাতের দিতে যাত্রীরা অদৃশ্য কোনও ব্যক্তির উপস্থিতি অনুভব করতে থাকেন। এই যেমন কোন লাল পোশাক পরিহিত বালিকাকে স্টেশনের প্লাটফর্মে বসে থাকতে দেখা যায়। শোনা যায় বালিকাটি ঐ জায়গায় আত্মহত্যা করে। এছাড়া অন্ধকার প্লাটফর্মে মহিলার তীব্র চিৎকার শোনা যায়। কয়েকদিন আগে বালকাটিপারেন৷ এমনকী প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের ধাক্কা মেরে রেললাইনে ফেলে দেয়ার মত ভূতুড়ে ঘটনাও ঘটেছে এই স্টেশনে যার ফলে মৃত্যু হয়েছে অনেকের৷
৪। বেগুনকোদোর স্টেশন, পুরুলিয়া
পুরুলিয়ায় শহরে অবস্থিত বেগুনকোদোর একটি ছোট গ্রাম। কোলকাতা থেকে যার দূরত্ব ১৬১ মাইল। আজ থেকে ৫০ বছর আগের একটি ঘটনার কারনে এই স্টেশনটি পরিত্যক্ত হয়েছিল। কি ঘটেছিল সেসময়? ১৯৬৭ সালে এই স্টেশনেরই এক কর্মী সাদা শাড়ি পরিহিত এক মহিলার ভুত স্টেশনের প্লাটফরমে হেঁটে যেতে দেখেন এবং এর কিছু সময় পর মৃত্যু হয় ঐ কর্মীর। তারপর থেকেই এই স্টেশনে রেল থামতে দেখা যায় না এবং স্টেশনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ২০০৯ সালে এই স্টেশনটি পুনরায় চালু করা হয়। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ জানায় রেল লাইনটি সরু যার কারনে বর্তমান দ্রুত রেল চলাচল করতে পারবে না। এছাড়াও রেলকর্মীদের এই স্টেশনে কাজ করার অনীহা । মানুষজন এখনও পারতপক্ষে ওই স্টেশনের দিকে যায় না।
৫। প্যান্টেওনেস মেট্রো স্টেশন, মেক্সিকো
প্যান্টেওনেস মেক্সিকোর সবচেয়ে কুখ্যাত মেট্রো স্টেশনের একটি। এই স্টেশন ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা ভুতূড়ে গল্প। স্টেশনের পুরনো নথি হতে জানা যায়, মেট্রো স্টেশন হওয়ার আগে ওই এলাকায় দুটি সমাধিক্ষেত্র ছিল৷ এই মেট্রো স্টেশনের ২ নম্বর ট্র্যাক নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। প্রতি রাতে স্টেশন চত্বরে শোনা যায় চিৎকার ৷ মাঝ মধ্যে টানেলে ছায়ামূর্তিও দেখতে পাওয়া যায় বলে কথিত রয়েছে ৷ দেয়ালে কান পাতলে শানা যায় অশরীরির পায়ে হেঁটে চলার শব্দ। আর ওই টানেলের অন্ধকার কোনায় বেশিক্ষণ না তাকানোই ভাল।
চোঁখ না রাখায় কোনটার দিকে বেশিক্ষণ না তাকানোই ভাল।
এছাড়াও স্টেশনেও কোনও অন্ধকার কোনায় ভূত দাঁড়িয়ে থাকতেই পারে৷
মেক্সিকোর এই মেট্রো স্টেশনের ২ নম্বর ট্র্যাক নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। স্টেশনের টানেলে প্রায়ই শোনা যায় আর্তনাদ। আর ছায়ামূর্তির ঘোরাফেরা তো আছেই। দেওয়াল থেকে শোনা যায় পায়ে হেঁটে চলার শব্দ। আর ওই টানেলের অন্ধকার কোনটার দিকে বেশিক্ষণ না তাকানোই ভাল। ২০০৯ সালে স্টেশনটিকে নিয়ে একটি ভিডিও তৈরি করা হয়। যেখানে রেল প্রকৌশলীরা ভিন্ন ভিন্ন গলার ভয়ার্ত আর্তনাদ শুনতে পান।
৬। গ্লেন ইডেন রেলওয়ে স্টেশন, নিউজিল্যান্ড
নিউজিল্যান্ডের পশ্চিম অকল্যান্ডের গ্লেন ইডেন রেল স্টেশনটির সাথেও একটি কবরখানার সম্পর্ক রয়েছে। ওয়েকুমিতি নামক কবরখানায় মৃতদেহ এবং তাদের পরিবারের লোকজনকে আনা নেওয়ার করার কাজে স্টেশনটি তৈরি করা হয়। ২০০১ স্টেশনটির পুনর্নির্মান করা হয়। সেখানেই তৈরি করা হয় একটি ক্যাফেটেরিয়া । এই ক্যাফেটেরিয়াতে একজনের ভুত প্রায় সময় ঘুড়ে বেড়ায় । শোনা যায় অ্যালেক ম্যাকফারলেন নামক ঐ ব্যক্তি ছিলেন এখানকার রেল কর্মী। ১৯২৪ সালের এক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। এছাড়াও ঐ স্টেশনে যাতায়াতকারী অনেক যাত্রীই নাকি ভূত দেখেছেন বলে দাবি করেন৷
৭। ইউনিয়ন স্টেশন, ফোনেক্স, আমেরিকা
ফোনেক্স ইউনিয়ন স্টেশনটি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা রাজ্যে অবস্থিত। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশন ছিল। কাছাকাছি একটি বিমান বন্দর তৈরি হওয়ার পর থেকেই এর গুরত্ব কমতে থাকে এবং ১৯৯৫ সালে স্টেশনটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমানে এটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অফিসের কর্মীরাই এই স্টেশনে ভুতের উপস্থিতি অনুভব করে। তাদের দাবী এই রেলওয়ে স্টেশনে এক রেল কর্মীর অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায় ৷ সকলে তাকে ফ্রেড নামে ডাকতো। স্টেশনের অফিসে তাকে মাঝে মধ্যে দেখা যায়৷ স্টেশনে তার জন্য নির্দিষ্ট একটি ঘরও রয়েছে বলে কথিত আছে। সে নাকি ঐ ঘরে এখনও থাকে এবং সেই ঘরে অন্য কর্মীরা ঢোকার সাহস করেন না। তাকে মাঝেমধ্যে স্টেশনও দৌঁড়ে বেড়াতে দেখা যায়৷
৮। রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন, কলকাতা
কলকাতার স্টেশনে ভুতূড়ে উপদ্রব, ভাবা যায়! কলকাতার রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশনটিতে ভুতের অস্তিত্ব আছে বলে অনেকের মত। তবে ভুত সবসময় দেখা দেয় না। সে অপেক্ষা করতে থাকে রাতেরশেষ ট্রেনটির জন্য। রাতের শেষ মেট্রোতে মেট্রোর চালক ও যাত্রীরা প্রায়ই স্টেশনে কোন এক অদৃশ্য ছায়ামূর্তিকে রেল লাইনের উপর দিয়ে চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে পান।
৯। কনোলি স্টেশন, আয়ারল্যান্ড
আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরে অবস্থিত দেশের অন্যতম এবং দীর্ঘতম রেল স্টেশনের নাম কনোলি স্টেশন । ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এই এলাকায় বেশ বোমা বিস্ফোরন হয়। এই বিস্ফোরনে প্রচুর মানুষ মারা যান। তখন থেকেই এই এলাকাটি ভুতূড়ে স্টেশন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যদ্ধে মারা যাওয়া মৃত মানুষের আত্মাদের নাকি এই স্টেশনে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন বলে নিরাপত্তারক্ষীসহ অনেক যাত্রীরই অভিমত।
১০। ম্যাককোয়ারি ফিল্ডস ট্রেন স্টেশন, অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়ার সিডনীর দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত নিউ সাউথ ওয়েলস শহরের এই স্টেশনটি বেশ শান্ত ও নিরিবিলি। কোনো উটকো ঝুট ঝামেলা নেই বললেই চলে। তবে মাঝ রাত্রিরে শুরু হয় অদ্ভূত সব ভুতূড়ে ঘটনা। এই সময় এক নাবালিকার ভুতকে স্টেশনে হেঁটে বেড়াতে দেখা যায় ৷ ওই নাবালিকার শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে৷ রক্তমাখা কাটা হাত নিয়ে প্লাটফর্মে তাকে ঘুরতে দেখা যায় । সে ক্রমাগত কাঁদতে থাকে এবং সেই কান্নার চিৎকার ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ৷ মাঝে মাঝে তাকে রেল লাইনের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায়।
লেখকঃ প্রকাশ কুমার নাথ। পেশায় কম্পিউটার প্রোগ্রামার । ভালো লাগে বই পড়তে আর নানান দেশের খবর সংগ্রহ করতে। এছাড়া গান শুনার নেশা তো রয়েছেই । ইচ্ছে আছে বই লেখার । কালি, কলম আর মগজাস্ত্র এক সুরে বাঁধার অপেক্ষায় আছি ।