প্রথম পর্ব-১ পড়ুন এখানে।
চারিদিকে থমথমে পরিস্থিতি । আমি দাদির কাছে হাচিশহাকুশামার কথা শুনে এবং দাদা-দাদিকে এমন ভীত হতে দেখে এখন নিজেই একটু একটু ভয় পেতে শুরু করেছি। এর মধ্যেই আমার টয়লেটে যাবার প্রয়োজন হল। কিন্তু দাদি আমাকে কিছুতেই একা ছাড়তে চাইল না। এমনকি সে আমাকে টয়লেটে নিয়ে গেল কিন্তু দরজা আটকাতে দিল না। চারপাশে হঠাৎ করে একটা অদ্ভুত শো শো শব্দ হতে থাকল। ঘরের থমথমে ভাব আর এমন ভৌতিক শব্দ সব মিলিয়ে এবার আমি সত্যি অনেক ভয় পেয়ে গেলাম। আমার চোখে মুখে হয়ত আতংকের ছাপ বোঝা যাচ্ছিল তাই দাদি আমাকে জড়িয়ে ধরল টয়লেট থেকে বের হওয়ার পর।
ওদিকে দাদা আর কে সান উপরে কি করছিল কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এসব যখন ভাবছি তখন দাদা আর কে সান নিচে নেমে এল এবং আমাকে উপরে আমার শোওয়ার ঘরে নিয়ে গেল। দেখলাম আমার শোওয়ার ঘরের জানালাগুলো খবরের কাগজ দিয়ে মোড়া এবং সেগুলোতে অনেক প্রাচীন জাদু অক্ষর লেখা রয়েছে। সেখানে আরও ছিল লবণের ছোট্ট কিছু গামলা যেগুলো ঘরের চার কোণায় রাখা ছিল। এবং ঘরের ঠিক মাঝখানে একটি কাঠের বাক্সের উপর একটি ছোট্ট বৌদ্ধমূর্তি রাখা ছিল। সেখানে একটা উজ্জ্বল নীল রঙয়ের বালতিও রাখা ছিল।
আমি জিজ্ঞাস করলাম, “এই নীল বালতিটা কেন রাখা হয়েছে এখানে”?
আমার দাদা তখন বলল, “এখানেই তুমি আজ তোমার টয়লেট সারবে”।
কে সান আমাকে বিছানায় বসিয়ে দিল এবং বলল, খুব শীঘ্রই সূর্য ডুবে যাবে সুতরাং খুব সতর্কভাবে মন দিয়ে আমার কথা শোন, “তোমাকে কাল সকাল পর্যন্ত এই ঘরের মধ্যেই থাকতে হবে। কাল সকাল ৭টার আগে যাই ঘটুক না কেন কোনভাবেই তোমাকে এই ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না। ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার দাদা বা দাদি তোমাকে কোনভাবেই ডাকবে না বা ঘরের বাইরে আসতে বলবে না। এটা খুব ভাল করে শুনে রাখ এবং মনে রাখ যে সকাল ৭টার আগে কোনভাবেই কোন কারণেই তুমি ঘরের বাইরে বের হবে না। আমি তোমার বাবা মা কে জানিয়ে দেব যে এখানে কি হচ্ছে”।
কে সান এতই ঠাণ্ডা এবং দৃঢ় কন্ঠে কথাগুলো বলল যে, আমি মাথা নাড়িয়ে তার কথার সম্মতি জানানো ছাড়া আর কিছু করার পেলাম না।
এরপর দাদা বলল, শোন ফুকুতা তুমি কে সান এর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। তার কথার অন্যথা যেন কোনভাবেই নাহয়। সে তোমাকে যে চামড়ার কাগজ ধরে রাখতে দিয়েছে তা কোনভাবেই হাত থেকে ফেলে দেবে না। আর যদি কোনকিছু ঘটে তবে বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করবে। আর আমরা চলে যাওয়ার সাথে সাথেই তোমার ঘরের দরজা খুব ভালভাবে তালা দিয়ে আটকে দেবে”।
এরপর দাদা দাদি আর কে সান আমার ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমি তাদের বিদায় জানিয়ে দরজা খুব ভালভাবে আটকে দিলাম এবং তালা লাগিয়ে দিলাম। আমি টেলিভিশন ছেড়ে দিয়ে তাতে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি এতই ভয় অনুভব করছিলাম আমার মধ্যে যে আমি টেলিভিশনে মনোযোগ দিতে পারলাম না। আমি আমার ভেতরে অস্থিরতা এবং অজানা আতংক অনুভব করতে লাগলাম। দাদিমা আমার জন্য ঘরে খাবার রেখে গিয়েছিল কিন্তু আমি খাবার খেতে পারলাম না কোনভাবেই। আমার মনে হচ্ছিল আমি একটা জেলখানায় বন্দী হয়ে আছি এবং বিষণ্ণ হয়ে পড়ছিলাম। আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম এবং কখন ঘুমিয়ে পড়লাম তা বলতে পারব না।
যখন আমার ঘুম ভাঙল তখন রাত ১টা বাজে। হঠাৎ আমি শুনতে পেলাম কি যেন জানালায় মৃদু আঘাত করছে এবং শব্দ করছে, ট্যাপ, ট্যাপ, ট্যাপ, ট্যাপ,ট্যাপ,………
আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। আমার হৃদপিণ্ড মনে হচ্ছে তার খাঁচা থেকে বের হয়ে যাবে। আমি মনে মনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। নিজেকে বোঝানোর চেস্টা করলাম এটা অন্য কোন কিছুর শব্দ নয় এটা বাতাসের শব্দ। বাতাস জানালায় লেগে এমন শব্দ হচ্ছে। এই ট্যাপ ট্যাপ শব্দ না শোনার জন্য আমি আবার টেলিভিশন চালু করলাম জোরে শব্দ দিয়ে। সাথে সাথেই ট্যাপ ট্যাপ ট্যাপ শব্দটা থেমে গেল এবং সাথে সাথেই দরজার ওপাশে আমি আমার দাদার কন্ঠ শুনতে পেলাম।
শুনতে পেলাম দাদা বলছে, “ফুকুতা তুমি কি ভেতরে ঠিক আছ? ভেতরে যদি তুমি একা একা ভয় পাও তাহলে ভেতরে আর তোমার একা থাকার কোন প্রয়োজন নেই। আমি ভেতরে এসে তোমার সাথে থাকতে পারি এবং তোমাকে সঙ্গ দিতে পারি”।
দাদার এ কথা শুনে আমার ভেতরে সাহস এল এবং আমি দৌড়ে গেলাম দরজা খুলে দাদাকে ভেতরে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু দরজার কাছে যাওয়ার আগেই আমি থেমে গেলাম। আমার শরীরে হঠাৎ একটি অদ্ভুত অনুভূতি খেলা করে গেল। আমার মনে খটকা লাগল কারণ যদিও বাইরের কন্ঠটা দাদার কন্ঠের মত লাগছিল কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছিল সেটা দাদার কন্ঠ নয়। কোথাও একটা পার্থক্য আছে দাদার কন্ঠের সাথে। আমি জানিনা ঠিক কি পার্থক্য কিন্তু মনে হচ্ছিল এটা দাদা না।
আমি থমকে দাঁড়িয়ে আছি আর বাইরে থেকে দাদা আবারও বলে উঠল, “ফুকুতা তুমি ভেতরে একা একা ভয় পাচ্ছ। এখন তোমার আর ভয়ের কিছু নেই। আমি এসে গেছি। এখন তুমি ঘরের দরজা খুলতে পার”।
আমি এক ঝটকায় দরজার সামনে থেকে সরে আসলাম এবং আমার বামে তাকালাম এবং যা দেখলাম তাতে আমার শিরদাঁড়া বেঁয়ে আবার ভয়ের এক শীতল স্রোত নেমে গেল। দেখলাম সেই গামলার লবণ ধীরে ধীরে কালো হতে শুরু করেছে।
ভয়ে আমার পুরো শরীর কাঁপতে শুরু করল। আমি দরজার কাছে থেকে আরও দূরে সরে এলাম। আমি ঘরের মধ্যেখানে রাখা বুদ্ধ মূর্তির সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসলাম আর হাতে সেই জাদুমন্ত্র লেখা চামড়ার কাগজটাকে শক্ত করে ধরে রেখে বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম।
চলবে……………