পৃথিবীতে সর্বাধিক বিস্তৃত ভাষা হচ্ছে ইংরেজি। ইন্টারনেট জগতেও সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষা এটি। ঔপনিবেশিক যুগে ইংরেজ শাসন ব্যবস্থার দ্রুত প্রসারের সাথে সাথে ভাষাও বিস্তার লাভ করেছে।যার ফলে বর্তমানে ইংরেজি ভাষা তার উৎপত্তিস্থল ছাড়িয়ে বিভিন্ন দেশের মানুষের মাতৃভাষা, দ্বিতীয় ভাষা ও বহু দেশের দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে। এখন ইংরেজি ভাষা আর ইংরেজদের একার বলে বিবেচিত হয় না, এটি এখন সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বৈশ্বিক ভাষা হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু কিভাবে,কোথা থেকে এই ইংরেজি ভাষার সৃষ্টি হল যা সারা বিশ্বে বিরাজ করছে?
বর্তমান ইংল্যান্ডের প্রাচীনতম অধিবাসী ছিল কেল্ট জাতিরা এবং তাদের ভাষা ছিল কেল্টিক ভাষা। তারা লৌহ যুগ থেকে সেখানে বসবাস করছে। তারা সেখানকার স্থানীয় হলেও বর্তমান ইংরেজি ভাষা তাদের কাছ থেকে সৃষ্টি হয়নি। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫ অব্দে রোমান শাসক জুলিয়াস সিজার এ অঞ্চলটিতে আক্রমণ করে। পরবর্তীতে ৪৩ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস অঞ্চলটি জয় করেন। এর পর থেকে সেখানে রোমান শাসন চলতে থাকে।রোমান শাসনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে প্রথম প্রশাসনিক শাসনব্যবস্থা শুরু হয়। সেখানকার দাপ্তরিক ভাষায় রূপ নেয় ল্যাটিন ও গ্রীক। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে ল্যাটিন বা গ্রীক ভাষা থেকে ইংরেজির সৃষ্টি হয়েছে। আসলে, তখনো ইংরেজি ভাষার জন্মই হয়নি; এর জন্ম হয়েছে প্রায় ৫০০ বছর পর।
৪৪৯ সালে জার্মান উপজাতিদের তিনটি দল— অ্যাঙ্গলস, স্যাক্সন এবং জুট সমুদ্রপথে এসে ইংল্যান্ডে আক্রমণ চালায় এবং দখল করে নেয়। তখনো এর নাম ইংল্যান্ড হয়ে ওঠেনি। এংলো-স্যাক্সন-জুট উপজাতিদের ভাষাই পরবর্তীতে ইংরেজি ভাষা হিসেবে রূপ নেয় এবং তাদের কাছ থেকেই ইংল্যান্ড নামকরণ হয়েছে।এংলো-স্যাক্সন বা অ্যাংলিশ থেকে ইংলিশ বা ইংরেজি নামটি এসেছে। জার্মান উপজাতিদের দেশান্তরের ফলে পশ্চিম জার্মানীয় ভাষাগোষ্ঠী হতে সৃষ্ট ইংরেজি ভাষা প্রথম দিকে শব্দ ভান্ডারের স্বল্পতার কারণে স্থানীয় কেল্টিক, গেলিক প্রভৃতি ভাষার শব্দ এমনকি রোমানদের ল্যাটিন শব্দও তাদের ভান্ডারে যোগ করে। সময়ের পরিক্রমায় ইংরেজি ভাষাও বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। উত্তর ইউরোপের ভাইকিংদের আক্রমণের ফলেও ইংরেজি ভাষা ভাইকিংদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। ইংরেজি ভাষার বেশ কিছু শব্দ ভাইকিংদের ভাষা “ওল্ড নর্স” থেকে এসেছে। তবে ইংরেজি যেসব ভাষা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ফরাসি প্রভাব। ১০৬৬ সালে ফরাসি নরম্যান শাসক উইলিয়াম দ্যা কনকোয়োরর ইংল্যান্ড জয় করেন। এর পর থেকে ফরাসি ভাষা-ই ইংল্যান্ডের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্থান লাভ করে। ইংরেজি ভাষায় ফরাসি প্রভাব বেড়ে যায়। বর্তমানে ইংরেজি ভাষার উচ্চারণে যে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায় তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ফরাসি প্রভাব। ফরাসি শাসনের অবসান হয় ইউরোপীয় রেনেসাঁ যুগে। এরপর ইংরেজি আবার সে অঞ্চলে প্রাধান্য পায়।
ঔপনিবেশিক যুগে ইংরেজি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। আমাদের দেশ যখন ইংরেজ উপনিবেশ ছিল তখন ইংরেজি দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে রূপ নেয়। ইংরেজ শাসনের অবসান হওয়ার পর এখনো এদেশে ইংরেজির প্রভাব রয়ে যায় সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন অফিস আদালতে। ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইন অনুযায়ী দেশের সব অফিস-আদালতে (বিদেশি যোগাযোগ ব্যতীত) সকল ধরণের নথি ও চিঠিপত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহারের বিধান রয়েছে। কিন্তু এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই একে উপেক্ষা করে ব্যাপক হারে ইংরেজির ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে। এমনকি বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে ইংরেজির অধিক বিস্তৃতির ফলে বাংলাভাষী মানুষের মাঝেও ইংরেজির প্রভাব লক্ষ্যণীয় মাত্রায় বেড়ে যাচ্ছে।
পৃথিবীতে প্রায় ৫৪ টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা হচ্ছে ইংরেজি। এসব দেশগুলোর কোনোটিতে ঔপনিবেশিক শাসনের ধারাবাহিকতায় ইংরেজি দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্থান পেয়েছে আবার অনেক দেশের ক্ষেত্রেই ভাষাগত জটিলতার কারণে ইংরেজিকে ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা’ বা সাধারণ বিনিময়যোগ্য ভাষা হিসেবে স্থান পেয়েছে। আফ্রিকার অনেক দেশ ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের পর থেকে ইংরেজি দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রচলিত আছে।ইংরেজ আধিপত্যের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা সহ আফ্রিকার অনেক দেশের মানুষের মুখের ভাষাও ইংরেজি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ইংরেজি দাপ্তরিক ও সহযোগী ভাষা। বহু ভাষাভাষীদের এই দেশটিতে ভাষাগত জটিলতার কারণে বিভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে সাধারণ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি স্থান পেয়েছে। এছাড়াও যেসব দেশে ইংরেজির কোনো দাপ্তরিক মর্যাদা নেই সেসব দেশেও ইংরেজি বিদেশি ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সৌদি আরব, চীনসহ বিভিন্ন দেশে ইংরেজির কোনো দাপ্তরিক বা আইনগত মর্যাদা নেই। তবুও সেসব দেশে ইংরেজি ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের ব্যবসায়িক, আন্তর্জাতিক ও অন্যান্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে। আমাদের দেশেও ইংরেজির কোনো আইনগত মর্যাদা নেই ; তবুও শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরিবাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি উল্লেখযোগ্য হারে ব্যবহৃত হচ্ছে।
যুক্তরাজ্য ছাড়াও ইংরেজি ভাষাভাষীদের দেশ হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউ জিল্যান্ড এসব দেশগুলোতেও ইংরেজি ছড়িয়ে পড়েছে ঔপনিবেশিক যুগেই। অস্ট্রেলিয়া ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে ১৭৮৮ সালে। এরপর থেকে ইংরেজদের আগমন বেড়ে যায় দেশটিতে। বর্তমানে ইংরেজিভাষী মানুষের সংখ্যাই সেদেশে সর্বাধিক। তবে অস্ট্রেলিয়ার দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজি নয়। বস্তুতশে কোনো দাপ্তরিক ভাষাই নেই। কিন্তু দাপ্তরিক মর্যাদা না থাকলেও সেদেশে দাপ্তরিক কাজ ইংরেজিতেই সম্পন্ন হয়। বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে ১৬০৭ সালে ভার্জিনিয়ায় উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে। সেদেশেও ইংরেজির অধিক ব্যবহার থাকা সত্বেও দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজি নয়। হিস্পানিক (স্প্যানিশভাষী আমেরিকান) ও অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যাও কম নয় সেখানে। সেসব ভাষার প্রতি সম্মান দেখিয়ে ইংরেজিকে যুক্তরাষ্ট্রের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি, তবে দাপ্তরিক কার্যক্রম ইংরেজিতেই হয়। কানাডা ইংরেজ কলোনি( উপনিবেশ) হওয়ার আগেই ফরাসী কলোনি ছিল। সেখানে ইংরেজি এবং ফরাসী উভয়ই দাপ্তরিক ভাষা। কানাডায় বসবাসকারী মানুষের ইংরেজি অথবা ফরাসী যেকোনো একটি ভাষা জানা আবশ্যক। নিউ জিল্যান্ডে অধিকাংশ মানুষ ইংরেজিভাষী। সেখানকার দাপ্তরিক ভাষাও ইংরেজি তবে সেই সাথে স্থানীয় মাউরি ভাষাও সেখানকার দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে। তবে মজার ব্যাপার হলো যে ইংরেজি ভাষা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে সে ইংরেজি ভাষাই তার জন্মস্থানের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত নয়। ইংরেজি হচ্ছে ইংল্যান্ডের “ডি ফেক্টো” বা কার্যত দাপ্তরিক ভাষা। আলাদা এই স্বীকৃতির ব্যপারটাকে সেখানকার অন্যান্য ভাষার (স্কটিশ, কেল্টিক, ওয়েলস এসব ভাষা) সাথে ইংরেজির বিভাজন মনে করা হয়।