ফ্ল্যাট এর কাজ শেষ হতে এখন দুমাস বাকি । এর মধ্যে পুরনো বাসাটাও ছাড়তে হচ্ছে । এত কম সময়ের মধ্যে নতুন একটি বাসা খুঁজে নেওয়া সত্যি কঠিনতম কাজগুলোর মধ্যে একটি । কিন্তু বাদল সাহেবের ভাগ্যটা বেশ ভালই । অফিসের এক বন্ধু। খুব সুন্দর একটি বাসার খোঁজ দিয়েছেন । দোতলা বাড়ি । নীচতলাটা পুরনো হলেও ওপর তলাটা বেশ ঝকঝকে । কিন্তু এত সুন্দর একটি বাড়ি কেনই বা খালি পড়ে থাকবে । এই প্রশ্নটি বাদল সাহেবের মনে আসলেও অতটা গুরত্ব আর দেননি । কলেজ পড়ুয়া একটি মেয়ে , স্কুল পড়ুয়া ছেলে আর গিন্নীকে নিয়ে তার ছোট্ট সংসার । সপ্তাহ খানেক লাগলো তাদের নতুন বাসা গোছাতে । শীতকালীন ছুটি থাকাতে নীলা আর আবীর দুজনেই বাড়িতেই ছিল । নতুন বাসাটা তাদের খুব পছন্দ হয়েছে , সাথে এলাকাও । এলাকার লোকজন গুলো খুবই আন্তরিক । তাদের বেশ সাহায্য করে । বাসার বেলখনি থেকে নদীটা ভারী সুন্দর দেখয়। বিশেষ করে ভোরবেলা যখন কুয়াশার চাদর নদীটাকে ঘিরে থাকে তখন মনে হয় আঁকা কোন ছবি ।
পাশের বাড়ির সবার সাথে বেশ ভালই ভাব হয়েছে তাদের । অনেকেই তাদের জিজ্ঞেস করে এত বাড়ি খালি থাকতে তারা এই বাড়িটাতে কেন উঠতে গেল । এই প্রশ্নটাতে নীলা বেশ অবাক হলেও প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার কারণটা সে খুঁজে পেতনা আর প্রশ্নকারীও থেমে যেত । কিন্তু তাদের চোখ দেখে মনে হতো এই বাড়ির সাথে কিছু গল্প জড়িয়ে আছে। নেহা পাশের বাড়িতেই থাকে । ইতোমধ্যে নীলা আর নেহার বেশ ভালই বন্ধুত্ব হয়েছে । তাদের দেখে মনেই হয়না তাদের পরিচয়টা অল্প সময়ের । নেহা একদিন কথায় কথায় বলছিল , “ আচ্ছা তোদের কি এই বাড়ি সম্পর্কে কেউ কিছু বলেনি ? এর আগেও তো এখানে চারটে পরিবার এসেছিলো কিন্তু পনেরো দিনের মাথায় সবাই হাওয়া । জানিস তো এই বাড়ি আর নদীটার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু আছে । প্রত্যেক বছর এই নদিতে কিছু না কিছু ঘটবেই । এই বাড়ি নিয়েও তো অনেক কথা শোনা যায় । “ নীলা চুপচাপ নেহার কথা গুলো শুনে যাচ্ছিল। কথা শেষ হতেই সে বললো, “ নেহা তুই তো বেশ ভালই গল্প শোনাতে পারিস । বলে যা আমার কিন্তু গল্প শুনতে বেশ ভাল লাগে । “ গল্প নয়রে নীলা আমি সত্যি বলছি । নীচতলায় যারা এসেছিলেন তারা বলতে পারিস এই বাড়িটারই শিকার । তাদের সদ্য নবজাত তিনটি বাচ্চা নাকি এই আনবার পরপরই দোলনায় কাঁপতে কাঁপতে মারা গেল । হাসপাতাল যখন ছিল তখন তো নাকি ভালই ছিল । এইবাড়িটির যখন কাজ চলছিল তখন ও নাকি অনেকে অস্বাভাবিক অনেক কিছু শুনতে পেত । এখানে কর্মরত এক স্রমিক কে তো একদিন ভোরে বেহুঁশ অবস্থায় পাওয়া যায় । তার ভাষায় সে নাকি অদ্ভুত কিছু দেখেছিল রাতে যেটি অনেকটি মস্তকহীন ।
এই কথা শুনে নীলা আর তার হাসি চেপে রাখতে পারেনি । সে নেহাকে বলেই দিল , “ তোর শরীল টা নিশ্চয় খারাপ রে , তুই বাড়ি গিয়ে বিস্রাম কর । “ বিশ্বাস করলিনা তো , একদিন ঠিক বুঝবি “ এই কথা বলে নেহা চলে গেল । বিকেল বসতে নীলার বেশ ভাল লাগতো মা আর ভাইয়ের সাথে বসে গল্প করতো আর সাথে কফি তো থাকাই চায় । সেদিন সে একাই বসে ছিল । নদীর ধারে বাচ্চাদের খেলার দৃশ্যটি যেন তার ছেলেবেলার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল । বাচ্চা গুলোর মধ্যে দুটো বাচ্চা তাদের নীচতলায় উঠেছে তাদের বাবা-মায়ের সাথে । নিচতলাটি বাড়ির মালিক তার গুদাম ঘর হিসেবে ব্যাবহার করে । আবার মাঝে মাঝে দু একজনকে থাকতে দেখা যায় কিন্তু শুধু একরাতের জন্য । এই পরিবারের যে কর্তা তিনিও ব্যবসার কাজেই এসেছেন । কিন্তু বাচ্চা দুটোর বায়না ছিল তারা মামাবাড়ি যাবে । আর মামাবাড়ি এই পথদিয়েই যেতে হয়। কাজ শেষ করেই বাচ্চাদের নিয়ে যাবেন তাই পুরো পরিবার নিয়ে এখানে উঠেছেন । পরেরদিন তারা রওনা দিবে । বাচ্চা দুটো খেলছে । কিন্তু হঠা ৎ বাচ্চা ছেলেটি নদীর জলে পড়ে গেছে । লোকজন আসার আগেই ছেলেটি তলিয়ে গেল নদীর জলে । সেদিন হাজার চেষ্টার পরও দেহটি পাওয়া যায়নি । পরেরদিন সকালে যখন পাওয়া গেল তখন দেখা গেল ছেলেটির গলায় কালো দাগ বসে গেছে । গলা চেপে ধরলে যেমনটি হয় ঠিক তেমনটি । তখন অনেকেই বলছিল এই বাড়িটি সত্যি অভিশপ্ত । চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি কিছুতেই ভুলতে পারছেনা নীলা ।
সে বাচ্চার মায়ের কান্নার আওয়াজ বারবার তার কানে ভেসে আসছে । এক মুহূর্তের জন্য তার নেহার কথা গুলো সত্যি বলে মানতে ইচ্ছে হল । সেদিন রাতে তারকিছুতেই ঘুম আসছিলনা । চোখটা লেগে আসতে যাবে ঠিক তখনি তার মনে হল তার ঘরে কে যেন নূপুর পরে হাঁটছে । আলোটা জালানোর পর সে আর কিছু শুনতে পেলনা । হয়তো তার মনের ভুল হবে তা ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ল । কিন্তু পরের দিন রাতেও ঠিক সে পায়ের শব্দ আর নূপুরের আওয়াজ সে আবার শুনতে পেল । সে তার পরিবারের সবাইকে ব্যাপারটি বললো । কিন্তু সবার এককথা ,এটা তার মনের ভুল । সেদিন রাতে মা তার সাথেই ঘুমলো । এইবার তিনি বুঝতে পারলেন মেয়ে যা বলেছে সবটাই ঠিক ছিল । এর মধ্যেই তাদের ফ্ল্যাট এর কাজ ও শেষ হয়ে গেছে । যত তাড়াতাড়ি সম্ভভ তারা এই বাড়ি থেকে সব গুছিয়ে নিল । বাড়ি ছাড়লেও সে বাচ্চাটি আর নূপুরের শব্দ নীলার মনে দাগকেটে থাকবে ।