ভূতুড়ে ফ্ল্যাট এবং অমীমাংসিত কিছু রহস্য !
রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকায় বেশ বড় এবং সুন্দর একটি ফ্ল্যাটে উঠেছে আরিফ ও তার স্ত্রী রুনা। আরিফ বেসরকারী একটি কোম্পানিতে চাকরী করে। রুনা গৃহিনী। আরিফ কখনও সকালে কখনও দুপুরে বেরিয়ে যায় আর ফেরে রাত সাড়ে দশ বা কখনও প্রায় বারোটা। নতুন সংসার সন্তান নেই। আরিফ, রুনা দম্পতি যে ফ্ল্যাটে উঠেছে তার পাশের ফ্ল্যাটে কেউ থাকেনা। একটু বেশীই শান্ত আর নিরিবিলি পরিবেশ। প্রথমে বেশ ভালোই লাগতো বা জোর করে ভালো লাগাতে হতো রুনাকে। কিন্তু কিছুদিন পর থেকে বেশ অদ্ভূত এক অনুভূতি কাজ করে। মাঝে মাঝে সারা ঘর ভরে যেত খুব সুন্দর কোন ফুলের গন্ধ বা আতরের সুগন্ধে ! কিন্তু এ বিল্ডিংয়ের আশেপাশে এমন কোন ফুলের অস্তিত্ব চোখে পড়ে নি রুনার। আতরই বা কে দেবে আর বাইরের কেউ আসেও না বাসায় তবে…?
তেমন একটা পাত্তা দেয়না। তবে এখন আরেকটা বিষয় খুব অস্বস্থির কারণ হয়ে দাঁড়ায় ! অদ্ভূত এক আঁশটে গন্ধ সন্ধ্যা বা বিকেলের পরেই যেন সারা ঘর গুমোট করে দেয়। একদিন নয় দিনের পর দিন চলতে থাকে এভাবে। কিন্তু বিল্ডিংয়ের আশেপাশে কোন উন্মুক্ত নর্দমা বা উন্মুক্ত ডাস্টবিন নেই পরিষ্কার পরিপাটি এলাকা তাহলে এমন গন্ধ কত্থেকে আসে?
আরিফকে রুনা অন্য বাসা দেখতে বলে। এখানে থাকতে মন টানে না। আরিফ আচ্ছা বলেই শেষ ! ব্যস্ততায় ভুলে যায় সে। রুনা একা বাড়িতে প্রতিদিন নিত্য নতুন অস্বস্থিকর অস্বাভাবিক কিছু অনুভব করতে থাকে। সে স্পষ্ট অনুভব করে তার সাথে কেউ হাঁটে, কখনও পাঁ হেঁচড়ে বা কখনও দ্রুত বেগে হাঁটে, খালি ঘরে আরিফের উপস্থিতি টের পায় , সন্ধ্যায় ডাইনিংয়ে কোত্থেকে যেন লেজার লাইটের আলোর মত একটি আলো ছুটাছুটি করে ! কিন্তু এখানে খুবই শান্ত পরিবেশ আর উচ্চবিত্তের বসবাস কিন্তু এমন দুষ্টমি কে করতে পারে আর ভেতরের রুমেই কিকরে পৌঁছবে এ আলো?
আরিফকে আবারও বলে সে কিন্তু এবারও আরিফ দেখবে বলেই চুপ হয়ে যায় নয়তো কাজের ব্যস্ততায় আবারও ভুলে যায় !
ধীরে ধীরে রুনা স্পষ্টভাবে অস্বাভাবিক ভূতুড়ে কোন অস্তিত্ব টের পায় ! সে জানালার ঐ পাশে বাদুড় সদৃশ্য কোন কিছুর ছায়ামূর্তি দেখতে পায় ! যেন ডানামেলে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের আলো জ্বালালে বাদুড় যেন মিলিয়ে যায়। কিন্তু জানালার পাশে কোন গাছের অস্তিত্ব নেই যে তার ছায়া পড়বে ! কারণ ওরা পাঁচতলায় থাকে। প্রথমে মনের ভুল বলে স্বান্তনা দেয় নিজেকে কিন্তু রোজই হচ্ছে এমন ! নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে টিভি দেখে রুনা। আরিফ না আসা অবধি কিচেনেও যায় না। কিন্তু কিচেনে বাসনের শব্দ হয়, যেন কেউ কিচেনে কাজ করছে ! ডাইনিংয়ে যেন কেউ বসে কিছু খাচ্ছে, যেন হাড্ডি চিবাচ্ছে কেউ ! ড্রইংয়ের টিভি যেন কেউ ছেড়ে দিয়েছে, নিজের রুমের দরজায় কখনও টোকার আস্তে আওয়াজও টের পায়। সাহস করে দরজা খুলে দেখে সব ঠিকই আছে তবে এগুলো সব কি শুধুই মনে সংশয়?
তবে একা তো এর আগেও ছিলো সে। পুরোনো বাসায়। গ্যাস পানির সমস্যার জন্যই এখানে এসেছে ওরা। আজ ডিনার শেষে আরিফকে সব বিস্তারিত বলে রুনা, এও বলে যে, ” অবসরে শুয়ে যদি ঘুমিয়ে পড়ি তখন অনুভব করি কেউ আমার শরীর নিয়ে খেলছে, আমাকে শূণ্যে তুলছে ! ঘুম ভাঙলে খুব অসুস্থ অবসাদ অনুভব করি !” কিন্তু আরিফ হেসে উড়িয়ে দেয়। বলে, নতুন যায়গা , সারাদিন একা থাকো তাই এমন লাগছে। মাঝে মাঝে পাশের বা নিচের ফ্ল্যাটের মানুষের সাথে সময় কাটাও বা একটু ছাদে হাঁটা হাঁটি করেও সময় কাটাতে পারো ! এইতো ক’দিন পরে কাজের চাপ কিছুটা কমবে তখন তোমায় সঙ্গ দিতে পারবো ! এই ক’দিন একটু ম্যানেজ করো আর অফিসের কাছে এত ভালো বাসা পাওয়া মুশকিল ( আরিফ বলল রুনাকে )।
রুনা দিনরাত ভীত সন্ত্রস্ত থাকে ! কেমন এক অশুভ শক্তির হাতে দিনদিন অসহায় হয়ে পড়ছে সে ! কোন এক অদৃশ্য শেকল আস্তে আস্তে রুনাকে বেঁধে ফেলছে ! সবই রুনা অনুভব করতে পারছে কিন্তু কিছু করার শক্তি নেই ! কাউকে কিছু বলারও নেই ! কাকে বলবে ? রুনার বাবা ছোটবেলায় মারা যায়, মা কিছুদিন আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ভাই বোন কেউ নেই যে মাঝে মাঝে এসে থাকবে তার কাছে !
ধীরে ধীরে রুনা ভয় পেতে পেতে কেমন ঝিমিয়ে গুটিশুটি হয়ে যাচ্ছে ! খাওয়া নেই ঘুম নেই। আরিফ ফিরলে অল্প দুটি কথা বলে। আরিফ ভাবলো অভিমান করেছে , মানানোর চেষ্টা করে মেনেও যায় রুনা কখনও…।
তারপর হঠাৎ একদিন রাতে আরিফের ঘুম ভেঙে যায় ! সে রুনাকে বিছানা , রুমে কোথায় দেখতে পায় না! ব্যালকনি, ওয়াশরুম কোথাও নেই তবে রাত 2.30 মিনিটে কই রুনা ! নিজেদের শোবার ঘরের দরজা ঠিক সেভাবেই ভেতর থেকে লক করা যেভাবে সে লক করে শুয়েছিলো। তবে রুনা দরজার লক না খুলেই কিকরে বাইরে গেলো? ভেতরে তো কোথাও নেই সে !
রুনার সব কথা এখন পরিষ্কার আরিফের কাছে !
তাড়াতাড়ি আরিফ লক খুলে লাইট জ্বালিয়ে সব ঘরে রুনাকে খুঁজলো কিন্তু রুনা নেই কোথাও ! সাহস করে সে বাড়ির ছাদে গিয়ে দেখে রুনা ছাদের বাহিরে পা ঝুলিয়ে বসে বসে কাঁদছে ! এলোমেলো খোলা চুল। যেন প্রচন্ড কোন ঝড় বয়ে গেছে ওর উপর দিয়ে !
দারোয়ানের সহায়তায় খুব সাবধানে রুনাকে ছাদ থেকে নামিয়ে শুইয়ে দিলো আরিফ। আজ নিজেই হতভম্ব সে ! ভীত সে। কিছু একটা অশুভ শক্তি তো আছেই কিন্তু কি সেটা ?
সারারাত রুনাকে জড়িয়ে ধরে পার করে দেয় আরিফ। সকালে বয়ষ্ক দারোয়ানকে অনেক অনুরোধের পরে সে বলে..,
বহু বছর আগে যখন এখানে কোন জনবসতি ছিলোনা। এখানে মাইলের পর মাইল শুধু পরিত্যক্ত জলাশয় ছিলো আর ছিলো ঘন জঙ্গল। কোন মানুষের আনাগোনাও ছিলো না ! একসময় এই এলাকা দখল করে মাটি ভরাট করে আবাস ভূমিতে রুপান্তরিত করা হয়। কিন্তু এখানের বেশ কিছু উঁচু বিল্ডিং বা ভবন আছে যেখানে কোন মানুষ থাকে না বা থাকতে পারেনা। যদি থাকার জোর প্রচেষ্টা করে তবে সেই পরিবারের কেউ হয় পাগল হয়ে যায় নয়তো রাতে ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে।
আরিফদের পাশের যে ফ্ল্যাটটি খালি ঐ ফ্ল্যাটেও কোন মানুষ থাকতে পারেনা। শেষ যে ভারাটিয়া ছিলো তাদের ছোট্ট একটি ছেলে ছিলো। ছেলেটি একমাসেই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায়। তাকে বেঁধে রাখতে হয় নয়তো সে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। সেই পরিবার চলে যাওয়ার পরে ওখানে আর ভাড়া দেয়ার চেষ্টা করা হয়নি।আরিফের মনে পড়ে ক’দিন আগে রুনা বলেছিলো, ” আমি মরতে চাইনা তবু আমাকে মরতেই হবে ! ” আরিফ শুনতে পেয়ে জিজ্ঞাস করলে রুনা বলে, ” কে সারাজীবন বাঁচে? তাই বললাম ! “
রুনা আরিফ সে ফ্ল্যাট ছেড়ে আসে তবে রুনা আজ বদ্ধ উন্মাদ ! তাকে বহু ডাক্তার দেখানো হয়েছে কিন্তু কাজ হয়নি !
কিছুদিন আগে আরিফ গ্রামের বাড়ি যশোরে নিয়ে আসে রুনাকে। হয়তো খোলা পরিবেশে সুস্থ হবে সে। হুম, বেশ কিছুদিন রুনা খুব স্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু একদিন রুনা সবার অগোচরে নিরুদ্দেশ হয়। অনেক খোঁজার পরে তাকে বাড়ি থেকে অনেক দূরে এক জলাশয়ে মৃত খুঁজে পাওয়া যায় ! মৃত্যুর অন্য কোন কারণ পাওয়া যায়নি কিন্তু রুনার ঘাড়ের হাড় ভাঙা ছিলো !
কিছু কিছু অদ্ভূতুড়ে অস্বাভাবিক এসব রহস্যের কখনই কোন সমাধান হয়না, কিন্তু কেন?
এমন প্রশ্ন এবং সংশয় রয়ে যায় বহুকাল অবধি, বহু ভুক্তভোগী মানুষের মনে !!!