“ইসলাম” অর্থাৎ মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন করা। “মুসলিম” অর্থাৎ যারা আত্মসমর্পন করে। মহান সৃষ্টি কর্তার কাছে নিজের সব কিছু সপে দেওয়ার তেমনি একটি ঘটনার হাত ধরে আসে ঈদুল আযহা তথা কোরবানি। এটি বলতে শুধুমাত্র পশু জবাই করা বুঝায় না। এর জন্য রয়েছে কিছু বিধি বিধান। প্রতিবছর একটি নিদিষ্ট সময়ে ,নিদিষ্ট মাসে , নিয়ম মেনে এটি পালন করতে হয়। এটি ছিল হযরত ইব্রাহিম (আঃ)এর জন্য বিশ্বাসের একটি পরীক্ষা। তিনি স্বপ্নে প্রিয় সন্তানকে কোরবানি দেওয়ার জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ প্রাপ্ত হওয়ার কোন কিছু না ভেবে নির্দেশ অনুসারে যখন সন্তানকে কোরবানি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, পিতার কষ্ট হবে জেনে প্রিয় পুত্র ইসমাইল পিতার চোখ বেঁধে দিয়ে ছিলেন এবং কোরবানির পর চোখ খুলে তিনি দেখতে পেলেন পুত্রের জায়গায় একটি মেষ কোরবানি হয়ে গিয়েছে। অর্থৎ তিনি বিশ্বাসের পরীক্ষায় পাশ করেছেন।
“কোরবানি” এবং “হজ্ব” একই সময় পালিত হয়। “হজ্ব” ইসলামের পাঁচটি স্তম্বের একটি। যার শক্তি ও সামর্থ্য আছে তার জন্য জীবনে একবার হজ্ব ফরজ। আরবি পঞ্জিকার দ্বাদশ ও শেষ মাসের(জিলহজ্ব) আট তারিখে শুরু হয়ে বার তারিখে হজ্ব পালন শেষ হয়। এই পাঁচ দিনের বিধিমালার তৃতীয় দিনে বিধি মোতাবেক হযরত ইব্রাহিম(আঃ)এর ঘটনাকে স্মরণ করে শয়তানকে পাথর ছুড়ে মারার পর হালাল পশু কোরবানি দেওয়া হয়(চতুর্থ ও পঞ্চম দিনেও করা যায়)। সমর্পনের এই উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের প্রেক্ষাপটে এভাবে সারা বিশ্বের মুসলিমরা ঈদুল আযহা উদযাপান করে থাকে। পশুর গোস্ত কিংবা রক্ত কোন কিছুই মহান আল্লাহ’র কাছে যায় না। এখানে বিশ্বাসটাই হল আসল।
বিশ্বে মুসলিম দেশগুলোতে এই উপলক্ষে ছুটি প্রদান করা হয় এবং পুরুষ, মহিলা শিশু-কিশোর সকলে নতুন কিংবা ভালো পরিষ্কার কাপড় পরিধান করে । সকলে সমবেত হয়ে সালাত আদায় করে। তারপর হালাল পশু কোরবানি দিয়ে, তার গোস্ত তিনভাগে ভাগ করা হয়। নিজের জন্য , আত্মীয়-স্বজনের জন্য, গরীবদের জন্য। এভাবে এক অপরের মাঝে গোস্ত বন্টন করে দিয়ে থাকে। এতে করে সামাজিক সম্পর্কগুলো যেমন শক্ত হয়, তেমনি সৌহার্দ্য -সম্প্রীতিও বাড়ে। ঈদুল আযহা -মুসলমানদের দুটি ঈদের একটি। এভাবে প্রতিটি ঈদ খুশি আর আনন্দের ভিতর দিয়ে আমাদেরকে অনেক কিছু শিক্ষা দিয়ে যায়।
এই পর্যায়ে আমরা জানবো পৃথিবীর অনান্য দেশে কিভাবে এই বিশেষ দিনটি পালিত হয়। জানবো পৃথিবীর কোন প্রান্তে কে কিভাবে পালন করছে তাদের ঐতিহ্য, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছেদ, রীতি -নীতি ইত্যাদি । সে সাথে প্রধানত অমুসলিম দেশ সমূহে মুসলিমরা কিভাবে পালন করে সেটাও তুলে ধরা হচ্ছে।।
কানাডা
অনান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের মত কানাডার মুসলিম সম্প্রদায় ঈদুল আযহা পালন করে। বন্ধু -পরিবার পরিজনের সাথে সাক্ষাৎ করে, উপহার বিনিময় করে এবং সেই সাথে গরীবদের জন্য ডোনেশানও করে থাকে। “ম্যাক” মুসলিম এসোসিয়েশন অফ কানাডা ,এই উপলক্ষে ঈদ উৎসবের আয়োজন করে থাকে । যেখানে থাকে খেলাধুলা, বিভিন্ন শো, মজার রাইড,খাওয়া -দাওয়া ইত্যাদির ব্যবস্থা। এই ধরণের ইভেন্টে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়, অনেক নেতা, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা উপ্সস্থিত থেকে মুসলিম কমিউনিটিকে শুভেচ্ছা জানান।
কানাডাতে এই উপলক্ষে পাবলিক ছুটির কোন ব্যবস্থা নেই। তবে কিছু ইসলামি সংগঠন নিদিষ্ট দিনে বন্ধ থাকে কিংবা কাজের সময় কমিয়ে দেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে
যুক্তরাষ্ট্রে খোলাখুলি ভাবে(যেভাবে বাংলাদেশ সহ মুসলিম দেশে হয়)কোরবানি দেওয়ার সুযোগ-ব্যবস্থা নেই। এখানে কয়েকজন একত্র হয়ে কসাইখানা থেকে একটি সম্পূর্ণ গরু ক্রয় করে, পরে তা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। সেই ভাগ থেকে আবার অল্প অল্প করে পরিচিত পরিবার যারা কাজের ছুটির অভাবে বা অন্য কোন কারণে কোরবানি দিচ্ছে না তাদের বন্টন করে থাকে। তবে কয়েকটি স্টেটে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা কসাইখানার তথা পশু বিক্রির ব্যবসার সাথে যুক্ত হওয়ায় নিদিষ্ট ফার্মে গিয়ে সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব হচ্ছে। এর জন্য অনেক সময় গোসত পেতে অনেক দূরে কোথাও যেতে হয় কিংবা এক-দুই দিন অপেক্ষা করতে হয় । এক্ষেত্রে কোরাবানি পশুর গোশত তৈরী হলে ব্যবসায়ীরা ফোন করে নির্ধারিত স্থান থেকে তা নিয়ে যেতে বলে। অনেক সময় কোরবানি দাতা, নিজের কোরবানি পশুকে এক নজর দেখতেও পারেন না। নিউইয়র্কে এ উপলক্ষে এই ব্যবসায়ের সাথে জড়িতরা দোকানের বাইরে লিখে রাখেন “এখানে কোরাবানির অর্ডার নেওয়া হয়”।
অনেক মুসলিম শুধু সালাত আদায়ের মাধ্যমে এবং সামাজিক সমাবেশের ভেতর দিয়ে ঈদুল আযহা উদযাপন করে থাকে। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসলিমরা নিজ নিজ ঐতিহ্যগত পোশাক পরিধান করে এবং খাবার পরিবেশনের মাধ্যমে এই দিনটি পালন করে। এক্ষেত্রে খাবারে গরু,ছাগল,ভেড়ার ক্রয়কৃত গোশতের নানা রকম পদ রান্না হয়। আষ্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, নিউজল্যান্ড সহ যেসব দেশে পশুর কোরবানির বৈধতা নেই , সেখানে এভাবেই দিনটি পালন করতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রেও ফেডারেল বা সরকারী কোন ছুটি নাই। তবে নিউইয়র্কে পাবলিক স্কুল গুলো একদিন বন্ধ দেওয়া হয়।
তুরষ্ক
তুরষ্কে ঈদুল আযহা উপলক্ষে চার দিনের সরকারী ছুটি বরাদ্দ । এই সময় অফিস, স্কুল, ব্যাংক, পোষ্ট অফিস সব কিছু বন্ধ থাকে। তাছাড়া আগের দিনও “অফিশিয়াল হাফ ডে “ছুটি দেওয়া হয়। এই সময় প্রশাসনিক অফিস এবং স্কুলও বন্ধ থাকে। এই উপলক্ষে তারা নতুন কাপড় ক্রয় করে থাকে এবং ঘরে বিভিন্ন পদের খাবার ব্যবস্থা করে থাকে। অনেকে ঘরকে পরিপাটি করে সাজায় এবং ঈদের প্রস্তুতি স্বরূপ কোন অতিথি যদি রাত্রী যাপনের প্রয়োজন পড়ে সেই ব্যবস্থাও করা হয়। শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে আত্মীয়-স্বজনরা বেড়াতে আসে। অনেকে কবরস্থান পরিদর্শন করে থাকে। অনেকে পরিবারের মরহুম সদ্স্যদের স্মরণ করে আগের দিন একটি পশু কোরবানি করে নিজেদের জন্য না রেখে তা সম্পূর্ণ গরিব-দুখীদের মাঝে দিয়ে দেয়।
তুরষ্কে যথা নিয়মে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে দিনটি শুরু হয়। পশু জবাইয়ের আগেও প্রার্থনা করা হয়। অনেকে কোরবানি পশুকে মেহেদি, ফিতা দিয়ে সাজিয়ে থাকেন। অনেকে কোরবানির প্রথম দিন আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাৎ এর জন্য বরাদ্দ রাখে। এই সময় ছোটরা বড়দের হাতে চুমু খেয়ে সম্মান ও অভিবাদন প্রদর্শন করে থাকে।
সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করা শুরু করেছেন। অনেকে দরিদ্রদের বিশেষ সাহায্য করে থাকেন। এই দিন সমূহে যাতায়াত ভাড়া কম করে দেওয়া হয়।
ইউরোপ
যারা ইউরোপে বসবাস করে কোন সন্দেহ নেই তাদের দেশের ঈদের উৎসব ও পারিবারিক আমেজকে অনেক মনে পড়ে। তবে তার মানে এই নয় ঈদের আনন্দটা একেবারে নীরস হয়ে যায়। এই সব দেশে বসবাসরতরা যারা খামার বাড়িতে গিয়ে কোরবানি করার অর্ডার দেয়। দেখা যায় ঈদের দিন সকালের নাস্তা সেরে, না সেরে নামাজ পড়ে টোকেনের সময় অনুয়ায়ী জবাইয়ের জন্য নির্ধারিত জায়গায় চলে যায় আর যারা করে না তারা নামাজ ও ধর্মীয় বক্তৃতা শুনা শেষ করে সেখানে পরিচিত-পরিজন নিয়ে বড় পরিসরে ভোজের আয়োজন করে ঈদের আনন্দের সামিল হয়। যেহেতু অমুসলিম অঞ্চল সেহেতু বিশেষ সুবিধাও নেই । তাছাড়া সেখানে কাজকে আগে প্রাধান্য দিতে হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে অনেককে আবার নামাজ শেষ করে সরাসরি কাজে বা স্কুলে চলে যেতে দেখা যায়। সাপ্তাহিক ছুটিতে তারা একত্র হয়ে ঈদের আমেজে মেতে উঠেন।
উদাহরণ, জার্মানিতে কয়েকজন কোরবানি দাতা একত্র হয়ে নিদিষ্ট সময়ে, নিদিষ্ট খামার বাড়ীতে গিয়ে নিয়ম অনুসারে নিদিষ্ট পোশাক পড়ে পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে তারা নিজের পছন্দ ও সাইজ মত পশু পছন্দ করতে পারেন, খামার কতৃঅইক্ষা গ্রাহককে গরুর গায়ে ঝুলানো নাম্বারের একটি টোকেন দিয়ে সময় জানিয়ে দেন এবং মুসলিম কসাই দ্বারা জবাইয়ের কাজটি করাতে পারেন। বাকী কাটাকুটির কাজ মেশিনে হয়ে থাকে। এই পেশায় মরক্কো ও তুর্কীরা এগিয়ে থাকে।
যেমনঃ একটি গরুর জন্য দাম আসে জনপ্রতি ৩০০-৩৬৫ ইউরো। অর্থৎ সাত জনে মিলে করলে ২১০০-২৫৫৫ ইউরো হচ্ছে সেই গরুর দাম। প্রতি ভাগে গোসত আসে ৬০-৬৫ কে।জি।
চীন
“The world Factbook” এর তথ্য অনুসারে চীনে মুসলিমের সংখ্যা ২০মিলিয়ন। আর বড় মুসলিম সম্প্রদায়ের নাম “হুই” .২০১১ সালের শুমারী অনুসারে এদের সংখ্যা ১০.৫ মিলিয়ন। চীন সরকার এদেরকে ethnic group হিসেবে না দেখে ইসলাম অনুসারী হিসেবেই দেখে থাকে। এছাড়া রয়েছে “উইঘুর” সম্প্রদায় যারা জিনজিয়াং স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের। এরা ছাড়াও চীনে আরো কিছু সম্প্রদায় আছে যারা মুসলিম।
চীনের সবচেয়ে পুরানো মসজিদের নাম’ Huaisheng Mosque” মহানবী (সাঃ)এর চাচা নির্মান করে ছিলেন। অনান্যদের মত চীনের মুসলিমরা যথারীতি ঈদুল আযহা উদযাপন করে। মুসলিমরা প্রধান প্রধান ধর্মীয় উৎসবে ছুটি পেয়ে থাকেন। প্রতিটি ঘরে ঈদের এক দিন আগে কুকিজ, স্ন্যাক ইত্যাদি বানিয়ে রাখে অতিথি আপ্যায়নের জন্য। বেইজিংযের “Niujie Mosque” হাজার হাজার স্থানীয় মুসলিম নামাজ আদায়ের জন্য প্রতি বছর সমবেত হয়।
পৃথিবীর সকল মুসলমানরা একই বিধি -বিধান অনুসরণ করে যে যার সামর্থ্য অনুসারে গরূ, ছাগল, ভেড়া, ঊট কোরবানি দিয়ে থাকে। তারতম্য যা হয় তা শুধু খাবার তৈরী ও পরিবশনে। আর সরকারী ছুটির পার্থক্য যেমনঃ সৌদি আরবে ১২ দিন,কুয়েত/কাতার/ ওমানে ০৯ দিন, ফিলিপাইনে ৩ দিন। তাছাড়া অমুসলিম দেশের মুসলিম প্রবাসীরা, অভিবাসীরা দেশের মত বাড়ির উঠানে কিংবা পাশের রাস্তায় পশু জবাইয়ের বৈধতা না পেলেও তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির চর্চা করানোর জন্য বিভিন্ন হালাল স্টোর থেকে গোসত ক্রয় করে প্রতিবেশি,বন্ধু পরিচিতদের নিয়ে ভোজের আয়োজন করে থাকে।