পৃথিবী নামক এই গ্রহে আমাদের বাস। মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্রহ হতে আলাদা শুধু মাত্র এখানেই ঘটেছে প্রাণের বিকাশ। এই গ্রহে রয়েছে তরল জলের বিশাল সম্ভার যা জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু পৃথিবীর যখন জন্ম হচ্ছিল তখন পৃথিবীর অবস্থা এত সুন্দর ছিলনা। ছিলনা বিশাল জলের সম্ভার। পৃথিবী ছিল একটি সদ্য জন্মানো এক জলন্ত অগ্নি গোলক যেখানে তরল জলের অস্তিত্বই অসম্ভব। যদি তা হয় তাহলে এই গ্রহে এত জল এলো কোথা হতে?
এখনো কেউ সঠিক ভাবে বলতে পারেনা এই গ্রহে জলের উৎপত্তি হলো কিভাবে। তবে কিছু তত্ত্ব আছে।

১. পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ উৎস:
এই তত্ত্বানুযায়ী হাইড্রোজেন পৃথিবীর ভূত্বকের শীলার মধ্যে আটকা ছিল। আর অক্সিজেন ছিল আয়রন অক্সাইড আকারে। পরে উভয়ের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে এবং অগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে বাষ্প আকারে বের হয়ে আসে। সেই বাষ্প পরবর্তীতে মেঘে পরিণত হয় এবং বৃষ্টিআকারে পৃথিবীতে নেমে আসে।  কিন্তু তখনকার পৃথিবী এত গরম ছিল যে বৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে পানি পুনরায় বাষ্প হয়ে আবার মেঘে পরিণত হত। এই প্রক্রিয়া বারংবার ঘটতে থাকায় পৃথিবী ঠান্ডা হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে  সাগর তৈরি হয়।

blank

২. গ্রহাণুই কি পানির সরবরাহকারী?
এই তত্ত্ব সম্পর্কে বুঝতে হলে আগে আমাদের সাড়ে চারশো কোটি বছর পূর্বে ফিরে যেতে হবে যখন আমাদের সৌরজগতের উৎপত্তি ঘটছিল। সূর্য তখন ছিল বিশাল গ্যাসের মেঘ বা নিহারিকার মধ্যে। যখন প্রচন্ড মহাকর্ষ বলের প্রভাবে মেঘের সংকোচন ঘটতে থাকে এবং ঘূর্ণন শুরু হয় তখন সমস্ত ভর কেন্দ্রে গিয়ে জমা হয় এবং সূর্যের উৎপত্তি ঘটে। মেঘের অবশিষ্টাংশ তখনও ঘুরতে থাকে এবং এক পর্যায়ে গ্রহ, গ্রহাণু, উপগ্রহ ইত্যাদিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু যেসব গ্রহাণু সূর্যের কাছাকাছি তৈরি হচ্ছিল সেখানে জল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিলনা। কারণ সূর্যের প্রচন্ড উত্তাপ। কিন্তু সূর্য হতে যেসব গ্রহাণুর অবস্থান দূরে কেবল সেখানেই বরফ তৈরি হয়। বিজ্ঞানীরা একটি গণনা করেছেন, সাধারণত আমাদের “এস্টেরইড বেল্ট” এর দূরত্ব ২.২ হতে ৩.২ অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল ইউনিট। (১ অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল ইউনিট হচ্ছে  মূলত সূর্য হতে পৃথিবী যে দূরত্বে অবস্থান করছে)। আর যেসব গ্রহাণু ২.৫ অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল ইউনিট দূরত্বে অবস্থান করছে সেখানে জল থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু ২.৫ হতে ৩.২ দূরত্বে যেসব গ্রহাণুর অবস্থান সেখানে জলের সম্ভাবনা বেশি। এস্টেরয়ড বেল্টের গ্রহাণু গুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরার সময় একে অপরের সাথা ঠুকাঠুকি লেগে বেল্ট হতে ছুটে গিয়ে পৃথিবীতে পতিত হয়। এবং হয়তোবা এভাবেই পৃথিবীতে জল আসে।

blank

৩. ধূমকেতুও কি জল আনতে পারে?
সাধারণত জলের উৎস হিসেবে অনেকে ধূমকেতুকে ধরে থাকে এবং ধরাও যায়। কারণ ধূমকেতু হচ্ছে বরফের তৈরি এবং এক একটি ধূমকেতু সাগর পরিমাণ জলও ধারণ করতে পারে। প্রথমদিকে মানুষ ভাবতো ধূমকেতুই জল নিয়ে আসছে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখলো পৃথিবী ও ধূমকেতুর জলের মধ্যে রাসায়নিকগত ভিন্নতা রয়েছে। আমাদের সূর্য ৫০০০অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল দূরে অবস্থিত ‘অর্থ ক্লাউড’। আর এই অর্থ ক্লাউডের দুই সদস্য ‘হ্যালির ধূমকেতু’ ও ‘হায়াকুথাকি ধূমকেতু’ এর জলের পরিমাপ করে দেখা যায় সেখানে পৃথিবীর তুলনায় ‘ভারী জল বা হেভি ওয়াটার’ বেশি। এখন আবার ভারী জল কি? আমরা জানি পানির গঠন হচ্ছে H2O বা দুই পরমাণু হাইড্রোজেন আর এক পরমাণু অক্সিজেন। কিন্তু ভারী জলে সাধারণ হাইড্রোজেনের এর পরিবর্তে দুই পরমাণু ডিউটেরিয়াম আছে অর্থাৎ 2H2O. ডিউটেরিয়াম হচ্ছে হাইড্রোজেন তবে শুধু আইসোটোপে ভিন্নতা রয়েছে। সাধারণ হাইড্রোজেনে একটি প্রোটন ও একটি ইলেক্ট্রন আছে যাকে প্রোটিয়ামও বলা হয়। কিন্তু ডিউটেরিয়ামে প্রোটনের সাথে একটি অতিরিক্ত নিউট্রন আছে। ফলে সাধারণ পানি অপেক্ষা ডিউটেরিয়ামে পানি ১০ শতাংশ ভারী। আর পৃথিবীতে প্রতি ১০০০০ পানির অণুর মধ্যে ৩টি ডিউটেরিয়াম সমৃদ্ধ পানির অণু আছে। ফলে ধূমকেতু পৃথিবীর জলের উৎস বিপদে পড়ে যায়। কিন্তু কুইপার বেল্টের একটি ধূমকেতু পুরো তত্ত্বটিকে আবার স্বস্থানে ফিরে আনে। ‘হার্টলি ২’ কুইপার বেল্টের অংশ। ২০১০ সালে ‘ইপক্সি’ মিশনে একটি ক্রাফ্ট সফলভাবে এই ধূমকেতুর উপর ফ্লাইবাই সম্পন্ন করে। এবং পরবর্তীতে পরিমাপ করে জানা যায় এই ধূমকেতু পানির গঠন আমাদের পৃথিবীর মতন। ফলে ধূমকেতু তত্ত্বটি পুনরায় বলবৎ হয়ে যায়।

আর তত্ত্ব যাহোক আমাদের বেঁচে থাকার জন্য জল প্রয়োজন। এজন্য যদি আমরা জলের অপচয় না করি তবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু রাখতে পারবো।

তথ্যসূত্র:
https://www.bbc.com/news/science-environment-30414519
http://astrobiology.com/2017/11/the-origin-of-earths-water.html
http://earthsky.org/space/did-comets-bring-water-to-earth