ব্যস্ততম নাগরিক জীবন যাপনে মানুষ একসময় হাপিয়ে উঠে। দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন সংস্থান করতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করা মানুষগুলো যখন হাঁপিয়ে উঠে তখন প্রকৃতিই পারে সেই ক্লান্তি ভু্লিয়ে দিতে। কিন্তু অনেক সময় শহর পিছনে ফেলে বহুদূরে যাওয়া সম্ভবপর হয়ে উঠে না। তাই শহরের পাথুরে পরিবেশকে প্রাণের ছোয়া দিতে মানুষ শহরেই গড়ে তোলে বাগান, প্রমোদ-উদ্যান।
মানুষের এধরনের বাগান এবং প্রমোদ-উদ্যান গড়ে তোলার ইতিহাস কিন্তু নতুন নয়। প্রাচীনকালে মিশরীয় ও মেসোপোটামিয়ান সভ্যতায় লোকেরা বাগান করলেও মূলত মধ্যযুগে ইউরোপেই আধুনিক ধারায় বাগান গড়ে তোলার সূচনা হয়। ইতালীয় রেনেসাঁর সময়ে বিভিন্ন ঔষুধি গাছ-গাছড়ার জন্য লোকেরা বাগান করত। রোমানরা কিন্তু আরও আগে থেকেই বাগান প্রিয় ছিল। তারা বিভিন্ন উদ্ভিদের ঔষুধি গুন সম্পর্কেও সম্যক অবগত ছিল।
১৮ শতকে বৃটিশরা কলকাতায় “কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেন” তৈরি করে। বোটানিক্যাল গার্ডেন বলা হলেও এখানে মূলত চা, কফি, পাম গাছ এবং চকলেটের চাষাবাদ করা হত। ফরাসীদেরও ততকালীন যুগে মরিশাস ও স্পেনে এধরনের বাগান ছিল। কাজেই নামে বোটানিক্যাল গার্ডেন হলেও এগুলো ছিল মূলত চাষাবাদের জমি।
উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে গোটা ইউরোপজুড়ে ব্যক্তিগত ও পৌর মালিকানাধীন বাগান ও উদ্যান করার চল শুরু হয়। অবসর সময় কাটানোর জন্য এই উদ্যানগুলো ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। কোথাও হত জম্পেশ আড্ডা। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে চা তো আছেই। হাটাহাটি এবং পিকনিক করতে মানুষজন এসব বাগান ও উদ্যানে আসত।
যুক্তরাজ্যের কর্ণওয়াল প্রদেশের একটি ছিমছাম গ্রাম মেভাজিসি। এখানে পাহাড়ের উপর অট্টালিকার মত একটি বাড়িতে থাকে ট্রিমাইন পরিবার। বাড়িটির নাম Heligan House.এই ট্রিমাইন পরিবারে তত্ত্বাবধানে এই বাড়িটির আশে-পাশের প্রায় ২০০ একর জমিতে গড়ে উঠে বিশাল এক উদ্যান। প্রায় ৩৫০ বছর আগে এই বাড়িটি স্যাম্পসন ট্রিমাইন কিনে নেন। পরবর্তীতে কয়েকবার এই বাড়িটি সংস্কার করে নতুন নতুন রুম এবং সুযোগ-সুবিধা যুক্ত করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে এই বাড়ি সংলগ্ন উদ্যানের দেখা-শোনা করার জন্য ২২ জন মালি ছিল। এদের মধ্যে ১৪ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়। বলাইবাহুল্য তারা আর কেউ ফিরে আসে নি। উত্তরাধিকার সূত্রে বাড়িটির তৎকালীন মালিক ছিলেন জ্যাক ট্রিমাইন। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে তিনি যুক্তরাজ্য ছেড়ে ইতালিতে পাড়ি জমান। দেশ ত্যাগ করার আগে তিনি তার সম্পত্তি ইজারা দিয়ে যান। এরপর থেকে বিভিন্ন জন বিভিন্ন কাজে বাড়িটি ব্যবহার করতে থাকে। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেখানে মার্কিন সেনাদের ক্যাম্প ছিল।
উদ্যানের ভিতর মনোরম দৃশ্য
১৯৭০ সালের দিকে বাড়িটিকে ফ্ল্যাট বাড়িতে রূপান্তর করা হয়। অযত্ন, অবহেলায় সংলগ্ন বাগানটি ধীরে ধীরে কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে থাকে। জ্যাক ট্রিমাইনের মৃত্যুর পর বাড়িটির মালিকানা একটি তত্তাবধায়ক দলের হস্তগত হয়। এই দলে অন্যান্যদের সাথে ট্রিমাইন পরিবারে বংশধররাও ছিলেন। তাদের মধ্যে জন উইলিস আশেপাশেই বাস করতেন। তিনি টিম স্মিথকে বাড়িটি দেখান। এরপরই মূলত বাড়িটির ভাগ্য বদলাতে শুরু করে। টিম স্মিথ ইডেন প্রজেক্টের জন্য বিখ্যাত হলেও তিনি হ্যালিগেনের উদ্যানকে প্রায় পূর্বরূপ দিতে পারাকে জীবনের সেরা কাজ বলে মনে করেন। বাড়ি এবং বাগানটি ঘুড়ে দেখার পর স্মিথ তার কিছু বন্ধু-বান্ধব এবং উৎসাহি ব্যাক্তিদের নিয়ে কাজে লেগে পড়েন। ধীরে ধীরে বাগানটি তার আদি রূপ ফিরে পায়। মানুষের পদধ্বনি নিতে প্রস্তুত হয়ে উঠে। অবশেষে ১৯৯২ সালে বাগানটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। দ্রুতই বাগানটি সমগ্র বৃটেনে এক বিশেষ স্থানের মর্যাদা পায়।
বাগানকে ঘিরে থাকা সাপের মত আঁকাবাঁকা পথগুলো প্রায় ২০০ বছরের পুরনো। ২০০ একরের অধিক জায়গা নিয়ে থাকা এই বাগানটি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। এতে রয়েছে একাধিক গ্রিনহাউজ। চমৎকার ও অদ্ভূত প্রজাতির কিছু গাছও এখানে রয়েছে। টলটলে পানির সুদৃশ কয়েকটি হৃদ আছে এই উদ্যানের ভিতরেই। ১০০ বছরের পুরনো পাম্প দিয়ে এই হৃদগুলোতে পানি সরবরাহ করা হয়। জ্যাক ট্রিমাইন ইতালিতে চলে গেলেও এই উদ্যানের কথা ভুলে যান নি। উদ্যানের ভিতরে ইতালিয়ান গাছ-গাছড়ার বাগানটি তারই কৃতিত্ব।
বাগানে রয়েছে একবর্ষজীবী এবং বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ, চমৎকার কিছু চিরসবুজ গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। এছাড়া কয়েকটি গোলকধাঁধাঁর মত স্থান এবং ক্যামিলিয়া ফুলের ঝোপগুলো বাগানের আকর্ষনকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। যারা একেবারেই প্রাকৃতিক কিছু চান তাদেরও হতাশ হতে হবে না এখানে বেড়াতে এসে। দৈত্যাকৃতি লতা আর বাঁশঝাড়ের জীবন্ত টানেল, কলাগাছের সারিগুলো যেন ওৎপেতে রয়েছে বাগান সংলগ্ন জঙ্গলে। যা মনে আনন্দে ঘুড়ে বেড়াবার জন্য দর্শনার্থীদের জন্য যথেষ্ঠ। হয়ে যাবে ছোট-খাট একটি এডভ্যাঞ্চার।
গৃহপালিত কিছু পশু-পাখিও এখানে ছাড়া হয়েছে। এদের মধ্যে হাস-মুরগী, টার্কি, গরু-ছাগল এবং শুয়োর উল্লেখ্য যোগ্য। পাশের জঙ্গলে রয়েছে নানান জাতের পাখি, পেঁচা, মৌচাক, বিভিন্ন রকমের ব্যাঙ, কাঠবিড়ালী ইত্যাদি।
Woodland Walk হল এই বাগানের আরেকটি চমৎকার অংশ। এই অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানান মূর্তি রয়েছে। বিশেষত কাদামাটির তৈরি নারীমূর্তিগুলো ( Mud Maid) বাগানটিতে এক রহস্যময় আমেজ এনে দিয়েছে। মূর্তিগুলো দেখলে মনে হবে অনিন্দ্যসুন্দর কোন তরুনী বাগানে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে ক্লান্ত হয়ে যেন মাটিতে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। শৈবাল ও মসে আচ্ছাদিত মূর্তিগুলো দেখতে আসলেই অনেক সুন্দর।
ভাস্কর সুসান হিল এই বাগানে কয়েকটি দৈত্যাকৃতি মাথার প্রতিকৃতি নির্মান করেন। যেন কোন বিশাল দৈত্যকে কান পর্যন্ত মাটিচাপা দেয়া হয়েছে। শুধু মাথাটাই তার বাইরে বেড়িয়ে আছে। চোখগুলো যেন জ্যান্ত আর গাল কপালের চামড়া মস আচ্ছাদিত। চুলগুলো তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের লম্বা পাতা বিশিষ্ট উদ্ভিদ দিয়ে। আরও যেসব বাগান রয়েছে সেগুলো হল Lost Valley, Melon Yard এবং Stewart’s meadow.
প্রথমবিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী মালীদের স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার্থে এই উদ্যানে The Thunderbox Room নামে একটি রুম রয়েছে। এখানে একটি ফলকে তাদের নাম খোদাই করা আছে।