ভালোবাসা বনাম প্রতিবন্ধীতার গল্প

পড়ন্ত বিকেল.. বিদায় নেওয়ার এক পরিবেশ.. ঝলমলে দিনটি বিদায় নিয়ে পৃথিবীর বুকে নেমে আসবে মিষ্টি একটা রাত.. প্রকৃতির এই পরিবর্তনের মাঝামাঝি সময়টা বড় অদ্ভুত.. পশ্চিম দিগন্তে নিস্তেজ সূর্য আর শীতল বাতাসের স্পর্শে দুলে ওঠে অনেকের মন। আবার এই সময়টাই মন খারাপ হবার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এমন নিস্তেজ আলো আর আধো-অন্ধকারের মাত্র আগত সন্ধ্যায় যদি কেউ মন খারাপ করে তবে তাকে দোষ দেওয়া যায় না….
.
চারতলার ব্যলকনিতে বসে আছে তানিয়া। তার পরনে নীল একটা থ্রি-পিস..প্লাষ্টিকের চেয়ারটা থেকে উঠে গিয়ে গ্রিল ধরে দাঁড়ালো সে.. সাথে সাথে একঝাক বাতাস এসে উড়িয়ে দিল তার খোলা চুল.. গলায় পেঁচিয়ে রাখা ওড়নাটাও বাতাসে দুলতে শুরু করল.. কিন্তু এসব কিছুই তানিয়াকে স্পর্শ করছে না.. সে বিষন্ন মুখে তাকিয়ে আছে অনেক দূরে.. কি এমন চেয়েছে সে? খুব বেশি প্রত্যাশা সে কখনোই করে না.. সাধারণ গোছানো একটা সংসারের স্বপ্নই তার একমাত্র স্বপ্ন.. এমন বেশি কিছু চাওয়াতো নয় !

অপু পি এইচ ডি করতে লন্ডনে গিয়েছে আজ চার মাস.. প্রতিদিনই অপু কথা বলে তানিয়ার সাথে আর এতেই মহা সন্তুষ্ট থাকে তানিয়া.. তার খুব ইচ্ছা করে অপুকে ছুয়ে দেখতে.. কিন্তু সব মেনে নিয়ে দুঃখটাকে এক কোণায় লুকিয়ে রেখে হাসিখুশিই থাকে তানিয়া.. কিন্তু আজ এক সপ্তাহ হলো অপুর কোন ফোন পাচ্ছেনা তানিয়া.. সে নিজে চেষ্টা করেও অপুর মোবাইল বন্ধ পাচ্ছে.. খুব টেনশন হচ্ছে তানিয়ার.. এখন তার টেনশন সুক্ষ এক অভিমানে রূপান্তরিত হয়ে গেছে.. কেন অপু তাকে ফোন করছে না ?

আচ্ছা, সে কি কোন অন্যায় করেছে? কই নাতো ! ভেবেও কোন ভুল বের করা যাচ্ছে না.. কিন্তু অপু ফোন করছে না কেন?! সেতো এমন ছেলে নয় ! একদিন তানিয়ার সাথে কথা না হলে অপুর কিছুই নাকি ভাল লাগেনা.. তাহলে এখন অপুর কি হলো? এমন ভাবনা চিন্তায় ডুবে থাকা মুহূর্তেই তানিয়ার মোবাইলে কল এল.. স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে অপুর নাম..
.
-হ্যালো, তানিয়া..
-হ্যাঁ, অপু!
-কেমন আছো?
-কেমন থাকতে পারি তুমিই বলো ?
-স্যরি, তানিয়া, আমি আসলে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম..
-হুম..
-রাগ করছো?
-কই নাতো !
-প্লিজ, রাগ করো না..
-আচ্ছা তুমি এতই ব্যস্ত ছিলে আমাকে একটা ফোন দেওয়ার ও সময় পাওনি..
-(ওপাশ থেকে শুধু মাত্র একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসে)
-আচ্ছা বাদ দাও, তুমি কেমন আছো বলো?
-ভালো আছি..
-কি করছো?
-এখন বসে বসে কথা বলছি, আচ্ছা তানিয়া ঐ দিনের লেকের পাড়ের কথা তোমার মনে পড়ে?
-কোন দিনের?!
-ঐযে, প্রথম যেদিন আমরা বের হয়েছিলাম..
-ও, হ্যাঁ.. মনে পড়বেনা কেন?!
-আমার কি ইচ্ছা করছে জানো?
-কি?
-সেই দিনের মত তোমার কপালে আলতো একটা চুমু দিয়ে তোমার কাঁধে মাথা রেখে অন্ধকার সন্ধ্যায় লেকের পানি দেখি..
-এই, কি? হচ্ছেটা কি !
-এটাই আমার শেষ ইচ্ছা…
-আবার !
-আচ্ছা তানিয়া, তোমাকে একটা কথা বলি কিছু মনে করবে নাতো..
-কি বলবে?
-ভাবছি, বলবো কিনা?
-আরে বলোতো..
-আমার এক বন্ধু আছে, খুব ভালো ছেলে.. সে আমার সাথেই পিএইচডি করছে.. একটি
দুর্ঘটনায় তার বা পায়ের অর্ধেক চলে গেছে.. তার সাথে কি তোমার ছোট বোন
সোনিয়ার বিয়ের ব্যবস্থা করা যাবে..
-তুমি এটা কি বলছো অপু ! ছেলেটির পা নেই, সেতো অকেজো.. তার সাথে সোনিয়ার
বিয়ে? না, অসম্ভব !
-ছেলেটা খুব ভালো..
-ঠিক আছে তার জন্য আমরা একটা ভাল মেয়ে দেখবো, কিন্তু আমার বোনকে না..
-আচ্ছা তানিয়া, পরে কথা হবে.. কেমন?
-আচ্ছা..
.
ফোনালাপের পরে হঠাৎ করেই তানিয়ার মনটা ভালো হয়ে গেল.. এই পৃথিবী তার কাছে আশ্চর্য সুন্দর মনে হতে থাকে.. একটু আগের সূক্ষ্ম বিষাদগুলো এখন আর নেই.. এখন মনের মাঝে উঁকি দিচ্ছে রঙ্গিন স্বপ্নগুলো, মনে পড়ে যাচ্ছে। 
পুরেনো দিনের কথা.. কত সুন্দর আর হৃদয় ছোঁয়া ছিল সেইসব দিনগুলো.. প্রায়ই পাশাপাশি হেঁটে চলতো তারা, হঠাত্ অপু হাত ধরতো তার.. তারপর কানে কানে বলতো- “জীবনটা অনেক সুন্দর তাইনা.” মাঝে মাঝে লেকের পাড়ে নিয়ে যেত অপু..

লেক আর সমুদ্র ছিল তার খুব প্রিয়.. লেকের পাড়ে গেলে অপুর যেন মনের দুয়ার খুলে যেতো.. নির্দিধায় বলে যেত তার সব আশা, স্বপ্ন আর আবেগগুলো.. হৃদয় উজার করা সেসব কথা তানিয়ার মনে গভীর দাগ কেটে যেত.. তানিয়া তখন অপুর আরো কাছাকাছি ঘেঁষে বসতো.. তানিয়া মাথা রাখতো অপুর কাধে.. তার মনে হতো পৃথিবীর যেকোন জায়গায় তার পাশে অপু থাকলে সে সুখি থাকতে পারবে.. তানিয়ার খুব ইচ্ছা করছে অপুকে একটু ছুয়ে দেখতে.. কতদিন অপুকে দেখে না ! অপুর হাসিমাখা মুখটা দেখা হয়না কতদিন ! ইশ ! যদি এখনই ছুটে যাওয়া যেত অপুর কাছে, তবে তানিয়া জীবনে আর কিছুই চাইতো না.. তার সব চাওয়া মিশে গেছে অপুর কাছে এসে.. অপুই তার সব..

.লন্ডন।

দু’তলা একটা বাড়ির উঠানে সুন্দর একটা বাগান.. বাগানের মধ্যে হুইলচেয়ারে মোবাইল হাতে বসে আছে অপু.. আজকে সে হাসপাতাল থেকে এসেছে..একসপ্তাহ আগে একটা দুর্ঘটনা হয়েছিল, সেই দুর্ঘটনায় একটা পা হারায় অপু।

বাকি জীবন তাকে হুইলচেয়ারেই কাটাতে হবে.. এইকথা তানিয়াকে জানানোর সাহস অপুর নেই.. তাছাড়া যা বুঝার সে বুঝে নিয়েছে..তানিয়া কখনো পঙ্গু কাউকে বিয়ে করবে না.. অপু বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিকে থাকে তার মোবাইলের দিকে। মনের অজান্তেই চোখ থেকে বের হয় অশ্রু ধারা.. অপু একবুক অভিমান নিয়ে শূন্য আকাশের দিকে তাকায় অসীম বিশ্বের সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে.. জোৎস্নায় তার চোখের জলটা বড় অদ্ভুত লাগে…

লেখকঃ রবিউল হোসেন।