মারিয়ানা ট্রেঞ্চ: রহস্যের আরেক নাম

যদি বলি পৃথিবীর উচ্চতম স্থান কোনটি, সবাই একবাক্যে বলবেন মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া।কিন্তু যদি বলি সবচেয়ে গভীরতম স্থান কোনটি? চিন্তায় পড়ে গেলেন তো! পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম স্থান হল মারিয়ানা ট্রেঞ্চ বা মারিয়ানাস ট্রেঞ্চ।আজ কথা বলব এই রহস্যঘেরা মারিয়ানা ট্রেঞ্চ নিয়ে।

বলা হয়ে থাকে চাঁদে যত জন মানুষ গিয়েছে তার চেয়ে কম মানুষ গিয়েছে মারিয়ানা ট্রেঞ্চে। এতটাই গভীর আর দূর্গম সেই স্থান। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ প্যাসিফিক মহাসাগরে অবস্থিত।এটি সুচালো খাড়া একটি খাদ যার সর্বোচ্চ গভীরতা ১০,৯৯৪ মিটার।যদিও এই গভীরতা আরও বেশি হতে পারে বলে অনেকের ধারণা।এটি ২৫৫০ কিলমিটার লম্বা এবং ৬৯ কিলোমিটার চওড়া। এসব তো গেল কেতাবি পরিচয়।চলুন জেনে নেয়া যাক কিছু অসাধারণ তথ্য:

• অচিন্তনীয় গভীরতা
মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতা এতই সুবিশাল যে যদি মাউন্ট এভারেস্টকে মারিয়ানা ট্রেঞ্চে নামিয়ে দেয়া যায় তারপরও তা সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ১.৬ কিলোমিটার নিচে থাকবে। ভাবা যায়!!!!
• প্রাচীণতম সীবেড
গবেষণায় প্রমানিত যে এই মারিয়ানা ট্রেঞ্চ পৃথিবীর প্রাচীনতম সীবেড যা ১৮০ মিলিয়ন বছর পুরাতন!!
• দুর্বিষহ চাপ
মারিয়ানা ট্রেঞ্চের সবচেয়ে গভীর স্থান হল চ্যালেঞ্জার ডিপ। এর নামকরণ করা হয় মারিয়ানা ট্রেঞ্চে অভিযানে যাওয়া এইচএমএস চ্যালেঞ্জার নামক নেভির জাহাজের নামানুসারে। এখানে পানির চাপ সমুদ্রের উপরি ভাগের চাপের একহাজার গুন বেশি। এই কারনে সাধারন কোন যন্ত্রপাতি নিয়ে সেখানে নামা অসম্ভব।বলা যায় আপনার মাথার উপর মোটামুটি ১০০ টা হাতির ওজন অথবা ৫০ টি জাম্বো জেটের ওজন পড়ে মারিয়ানা ট্রেঞ্চে।
• আরেক মৃত্যুপুরী
জানেন কি মারিয়ানা ট্রেঞ্চ কে সত্যি সত্যি মৃত্যুপুরী বলা হয়। ইংরেজিততে একে বলা হয় হ্যাডাল জোন (Hadal zone)। এই নামকরণ করা হয়েছে গ্রীক উপকথা অনুসারে। গ্রীক মাইথোলজিতে দেবতারাজ জিউস এবং সমুদ্রের দেবতা পোসাইডনের আরেক ভাই মৃত্যুদেবতা হেডিস নাকি থাকতেন সমুদ্রের সবচেয়ে দূর্গম এবং গভীরস্থানে মানে মারিয়ানা ট্রেঞ্চে। তার নামানুসারে একে হ্যাডাল জোন বলে। তাহলে একে মৃত্যুপুরী বলাটা বোধহয় খুব একটা ভুল হবেনা, তাইনা?

• টিএনটি ব্যবহার করে পরিমাপ
শুনতে আজব শোনালেও সত্যিই কিন্তু মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতা মাপা হয়েছিল “বম্বসাউন্ডিং” করে। যেখানে সাধারন ছোটখাট শব্দ উৎপন্ন করে পানির গভীরতা মাপা হয়, সেখানে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতা মাপা হয় আধা পাউন্ডের একট টিএনটি ব্লক (TNT Block) ব্যবহার করে প্রতিধ্বনির মাধ্যমে।যদিও বিজ্ঞানীরা জোর গলায় বলতে পারছেন না যে এটিই আসল গভীরতা।

• দূর্গমপথ
আগেই বলেছি মারিয়ানা ট্রেঞ্চের চেয়ে চাঁদের অভিযাত্রীই বরং বেশি। কারন এর দূর্গম পথ, অস্বাভাবিক চাপ এবং আলোর অভাব। মাত্র তিনজন অভিযাত্রী এখন পর্যন্ত শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যেতে পেরেছেন। যাদের একজনকে আমারা সবাই কমবেশি চিনি। তিনি হলেন হলিউডের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জেমস ক্যামেরন। ২০১২ সালে তিনি এই অভিজানে যান।

• সময় বদলানো ভূমিকম্প
২০১১ সালে সংঘটিত সুনামির কথা তো মনে আছে যা ৩৫ টির বেশি উপকূলীয় এলাকায় ২০,০০০ এর বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটায় এবং যার প্রভাবে ৬৬৬ টি আফটারশক দেখা যায়। গবেষনায় দেখা যায় এর উৎপত্তি হয় এই ট্রেঞ্চের ভূমিকম্প্রের প্রভাবে। এটি এতটাই প্রকট ছিল যেএই ভূমিকম্প পৃথিবীকে তার অক্ষ থেকে ১০-২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত সরিয়ে দেয় যার ফলে দিনের দৈর্ঘ্য ১.৮ মাইক্রোসেকেন্ড কমে যায়!!!

• তবুও নয় পৃথিবীর কেন্দ্র
এত গভীর হওয়ায় স্বভাবতই প্রশ্ন জাগপ্তে পারে যে তাহলে কি মারিয়ানা ট্রেঞ্চের শেষ বিন্দু পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু!!! না, তা নয়। কারন পৃথিবী চারদিকে সমান ভাবে গোল না হওয়ায় একটী নির্দিষ্ট বিন্দু কেন্দ্র হতে পারে না।

• জীবনের বিকাশ
তাই বলে কি এখানে জীবনের বিকাশ ঘটেনি! ঘটেছে। যদিও এর পানি এসিডিক এবং বিষাক্ত তবুও অদ্ভুতুড়ে, ভিন্নরকম প্রাণের বিকাশ ঘটেছে এখানে। যদিও আগে ভাবা হত হয়ত কিছু ব্যাক্টেরিইয়া বা অনুজীব এই ট্রেঞ্চে থাকতে পারে কিন্তু সম্প্রতি জাপানি গবেষকরা জীবিত  প্রানীর ছবি তুলতে পেরেছেন যা প্রমাণ করে এই মৃত্যুপুরীতেও প্রাণের বিকাশ সম্ভব।

• দৈত্যাকার প্রাণী
সবচেয়ে উত্তেজনাকর বিষয় হল সম্প্রতি এখানে দৈত্যাকার প্রানীর উপস্থিতি টের পাওয়া গিয়েছে বিজ্ঞানীরা যাকে এলিসেলা জাইগেনশিয়া (Alicella gigantea) বলে নামকরণ করেছেন যা সাধারন এম্ফিপোডের ২০ গুণ বড়।

• গবেষণার নতুন দিক
এই দূর্গম স্থানে প্রাণের বিকাশ গবেষকদের নতুন চিন্তার ধারা উন্মোচন করেছে। প্রবল চাপের মাঝেও জীবনের এই বিকাশ হয়তো ভবিষ্যতে মহাকাশে প্রানের বিকাশ নিয়ে গবেষণা করতে সাহায্য করবে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।

শত বছর ধরে মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্র বিন্দু এই মারিয়ানা ট্রেঞ্চ। কত রহস্য, কত অজানা এই ট্রেঞ্চকে ঘিরে। রহস্যের নেই কোন শেষ, আছে মৃত্যুর হাতছানি- তবুও রহস্য প্রিয় মানুষের কাছে চির আপন।