আজ একজন কিংবদন্তীর জন্মদিন। একজন জীবন্ত কিংবদন্তীর। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে যিনি পশ্চিম বাংলাতেও “সেরা বাঙালী”র খেতাব পেয়েছেন।
ঠিক ধরেছেন। আমি বাংলাদেশ ক্রিকেটের ওয়ানডে দলের ক্যাপ্টেন মাশরাফি বিন মর্তুজার কথাই বলছি। কোনও রাজনৈতিক নেতা ছাড়া বাংলার ইতিহাসে এতো ভালোবাসা আর কেউ পেয়েছে কি না, আমার জানা নাই। তিনি এমন একজন ক্রিকেটার, ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে যার কোনো হেটার নেই। না, ভুল বলেছি। একমাত্র তারই কোনো হেটার নেই।
অজস্র ক্রিকেটপ্রেমীর মতো বাংলাহাব পরিবারের পক্ষ থেকে মাশরাফিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই। মজার ব্যাপার হলো, আজ মাশরাফির ছেলে সাহেল মুর্তজারও জন্মদিন। বাবা এবং ছেলে, দুজনের জন্মদিন খুব ভালো কাটুক, আগামি দিনগুলো সুন্দর হোক, সেই প্রত্যাশা নিয়েই বাংলাহাবের আজকের এই বিশেষ আর্টিকেল।
পরিচয়
তাঁর সাথে আমার প্রথম পরিচয়ের ঘটনাটা ঠিক বলে বেড়াবার মতো নয়। ক্রিকেটের ক ও জানি না তখন। বিকেলে তানভী আপুদের বাসায় দৌড়ে গিয়েছি ওকে খেলতে ডাকার জন্য। গিয়ে দেখি ওরা ভাইবোন দুজনে মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছে। টিভিতে খেলা চলছে।
সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে চেঁচিয়ে বললাম, ‘তানভী আপু, খেলতে যাবি না?’
আপুর বড় ভাই তোহা চোখ গরম করে চুপ করে থাকতে ইশারা করল। তারপরই আবার টিভিতে মনোযোগ। ওদের এতো মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখে আমি নিতান্তই অনিহা নিয়ে তাকালাম টিভিতে। দেখলাম, হ্যাংলামত লম্বা একটা ছেলে কলার উঁচু করে বল করতে ছুটে আসছে। ওই বলেই সম্ভবত আউট হয়েছিল। কারণ তখন তোহা ভাইয়ার থমথমে মুখে হাসি ফুটেছে।
ওকে হাসতে দেখে খানিকটা সাহস পেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘যেই ছেলেটা বল করছে, ওর নাম কী? ছেলেটা তো দারুণ!’
সাথে সাথে তানভী আপু নাক মুখ কুঁচকে বলল, ‘দারুণ না কচু! এক নম্বরের বেয়াদব! দেখছিস না, কেমন বেয়াদবের মতো কলার উঁচু করে রাখছে!’
মুখ ফসকে বলে ফেলতে যাচ্ছিলাম, আমার তো এই উঁচানো কলারেই ওরে দেখতে ভাল লাগছে। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে ফেললাম। তানভী আপুকে ক্ষেপিয়ে দিলে একা একা স্কুলে যেতে হবে। তোয়াজ না করলে চলবে কেন?
তোহা ভাইয়া বলল, ‘বোলারের নাম মাশরাফি বিন মর্তুজা। আমি ডাকি মাঠে আইয়া মুইত্তা যা! নামটা শুনলেই এই কথাই মাথায় আসে।’
বলেই সে দাঁত কেলিয়ে হিরোইনখোরদের মতো খিক খিক করে হাসতে শুরু করলো। কথাটা শুনেই কেন যেন গা টা জ্বলে গেল। বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে এলাম।
ধুর! আজকের বিকেলের খেলাটাই মাটি! কী যে ক্রিকেট দেখে! ক্রিকেট কি বাচ্চাদের দেখার জিনিস? – আনমনে বিড়বিড় করতে করতে ঘরে ফিরে গেলাম।
কিন্তু কলার উঁচানো, তানভী আপুর ভাষায় ‘বেয়াদব’ ছেলেটাকে ভুলতে পারলাম না। কত কিছু বদলালো। বাংলাদেশের ক্রিকেটের পাগলা ভক্ত হলাম। কত প্লেয়ার এল, কত প্লেয়ার গেল। কিন্তু ওই ‘বেয়াদব’টার জায়গা কেউ নিতে পারলো না।
ঘোর
ধবধবে সাদা পর্দায় ঢাকা দৃশ্যপট। দুই আঙ্গুল মোটা, ফাঁপা সিলিন্ডারের মত একটা জিনিস। জিনিসটা কী, জানিনা। মোটা আঙ্গুলের মত লাগছে। কিন্তু ওটা নিরেট না, ফাঁপা। জিনিসটাকে অনবরত স্লাইস করে কাটা হচ্ছে। আর ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। ফাঁপা অংশ থেকে নয়, কেবল গোলাকার নিরেট অংশ থেকে রক্ত পড়ছে।
অতিপ্রাকৃত ব্যাপারটা কিছুতেই আমি সহ্য করতে পারছি না। ভয়ে থরথর করে কাঁপছি। কিন্তু কিছুতেই ওটা দেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারছি না।
হঠাৎ সব স্বাভাবিক হয়ে এল।
আমি স্পষ্ট দেখছি ধবধবে সাদা পরিবেশটা কেমন যেন শ্যাওলা সবুজ হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর পর তৈরি হওয়া গোল রক্তের বৃত্তটা কেন্দ্রও গাঢ় লাল হয়ে যাচ্ছে। চারপাশের রক্ত কেন্দ্রে জমা হয়ে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। বিস্তৃত দৃশ্যপট এখন চোখের সীমানায় চলে এসেছে। ওটা এখন আর কেবল কোন আভা নয়, কোন একটা বস্তুতে পরিণত হয়েছে। জিনিসটা ধরে রেখেছে একজন মানুষ। খুব প্রিয় আর আকাঙ্ক্ষিত একজন মানুষ। তাঁর শরীর থেকে মেহেদি ফুলের গন্ধ আসছে। হালকা অথচ স্পষ্ট। কিছু কিছু ভালো লাগা তীব্র ঘোর সৃষ্টি করে। আমি মোহাচ্ছন্ন হয়ে ভালো লাগাটা উপভোগ করছি।
মোবাইলের রিংটোনের তীব্র শব্দে আমার ঘোর কেটে গেল। মনে হচ্ছিল, মেহেদি ফুলের সেই মিষ্টি ঘ্রাণটা তখনো আমার নাকে লেগে আছে।
রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর একটা ফ্রেন্ড ফোন দিয়েছিল। আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ফোন রিসিভ করেছি। চোখ বন্ধ। এই তন্দ্রাবিষ্ট থেকেই এই দৃশ্যটা দেখেছি। এটা স্বপ্ন কিনা জানিনা। স্বপ্ন হলে, বলতে হবে এই ধরনের স্বপ্ন আমি আর কখনো দেখিনি। আবার দেখব কিনা তাও জানি না। খুব করে বুঝতে পারছি, আমি ভীষণভাবে ওই মানুষটার মোহে ডুবে আছি। যতদিন পর্যন্ত তাকে সরাসরি না দেখতে পাব, ঘোর কাটবে না।
অধরা স্বপ্ন
পরনে সাদা একটা পাঞ্জাবী। বন্ধুর সাথে বসে খুব আড্ডা দিচ্ছেন। আমি তার কাছে যাই যাবো করে এক পা এগোই, তো দুই পা পিছাই। তবুও বহু সাহস করে এগিয়ে বললাম, আপনার বায়োগ্রাফী বইটায় আমাকে একটা অটোগ্রাফ দেবেন? উনি মুখের উপর বলে দিলেন, “আমি তো বইটা লিখিনি, আমি কেন অটোগ্রাফ দেব? অটোগ্রাফ পেতে হলে লেখকের সাথে যোগাযোগ করুন।”
আমার মুখ থেকে রা সরে না। চিরকাল জেনে এসেছি তিনি খুব মিশুক। কখনো বিরক্ত হন না। তাহলে কেন আমার উপর এতো বিরক্ত?
বন্ধুকে নিয়ে বেরিয়েই যাচ্ছেন। আমি মরিয়া গলায় বললাম, “আপনাকে আমার একটা বই দেওয়ার আছে।”
উনি নিরুত্তাপ গলায় না বুঝেই বললেন, “বইয়ের জন্য প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করুন।”
বেরিয়ে গেলেন উনি। বরাবরের মতো আমার নাগালের বাইরে থেকে গেলেন। কিছুতেই তাকে ছুঁতে পারলাম না। লজ্জা, অপমান আর নিজের প্রতি বিতৃষ্ণায় আমি হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করলাম। ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে আমি নই। কিন্তু কিছুতেই নিজের কান্না দমাতে পারলাম না। কিছুতেই পারছি না।
কেন যেন তার বন্ধুটি ফিরে এসেছেন। এসে দেখলেন আমি কেঁদে কেটে একাকার। উনি আমাকে কিছু একটা বলতে চাইলেন। আমি শুনলাম না। বন্ধুটি গিয়ে তাকে নিয়ে এলেন। ততোক্ষণে নিজে সামলে নিয়েছি। কঠিন মুখ করে এমন ভাবে রইলাম, যেন কিছুই হয়নি। স্বভাবসুলভ কাঠখোট্টা ভঙ্গীতে এমনভাবে অন্যদিকে তাকালাম, যেন তার ফিরে আসাতে আমার কিছুই যায় আসে না। নিশ্ছিদ্র এক অভিমানে মন ভরে রইলো।
অভিমান হবে না কেন? আমি কি তার সাথে সেল্ফি তুলতে চেয়েছি? তার বাসায় গিয়ে তাকে বিরক্ত করেছি? নাকি তার প্রাইভেসি নষ্ট করেছি?
তিনি নিজে এসেছেন এখানে। তবে কেন আমার সাথে এমন ব্যবহার করলেন? আমি কি দোষ করেছি?
তিনি এলেন। আমার কাঁধ ছুঁয়ে বললেন, “বইটা নিয়ে এসো।”
তার স্পর্শ পেয়ে লজ্জা লজ্জা হাসি ফুটলো ঠোঁটে। বইদুটো এনে একটায় অটোগ্রাফ নিলাম। অন্যটা তার হাতে তুলে দিয়ে বললাম, “এই বইটা একজন বিখ্যাত আমেরিকান লেখকের। অনুবাদকের নামের জায়গায় আমার নামটা দেওয়া আছে। আমার প্রথম বইটা আপনাকে উৎসর্গ করেছি।”
তিনি মৃদু হাসি ঠোঁটে নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টালেন। আমি বললাম, “এই পাতায় নয়, অন্য পাতায়।”
উনি উলটে গেলেন। পেলেন না।
আমিও খুঁজলাম। আমার বইয়ের কোথাও “মাশরাফি” নাম খুঁজে পেলাম না। তাকে উৎসর্গ করা অনুচ্ছেদটা কিছুতেই খুঁজে পেলাম না। আমি পাগলের মতো পাতা উল্টেই গেলাম। উল্টেই গেলাম …
একসময় ঘুম ভেঙে গেল। অসম্ভব সুন্দর ওই স্বপ্নটাও ছুটে গেল। সারাটাদিন একটা মোহময় আচ্ছন্নতায় ডুবে রইলাম।
সারাদিন।
তিনি আমার অধরা স্বপ্ন হয়েই রইলেন।
পাগলামি
রোজা রেখে চট্টগ্রামে ছুটে গেলাম জীবনের প্রথম লাইভ খেলা দেখতে। আসলে যে আমি তাকেই দেখতে গিয়েছি, সেটা আমার চেয়ে ভাল কে জানে? কাছ থেকে না দেখি, দূর থেকে তো দেখতে পারব!
কিন্তু ভাগ্য সহায় হল না। অনেক অনেক দূর থেকে শুধু ২ নাম্বার জার্সির মানুষটাকে এদিক থেকে ওদিকে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখলাম। আমার গ্যালারির কাছাকাছি সে একবারও এল না। খেলা শেষ হবার পর বাঁধনহারা উল্লাসের সাথে সাথে আরেক ধরণের অনুভূতি হলো। তীব্র হতাশা। আমার মতো সাধারণ একজন মানুষের পক্ষে কি ওঁর মতো একজন বিখ্যাত মানুষের দেখা পাওয়া আদৌ সম্ভব?
বিসিএসএ টাইগার্সের সৈনিক তামিম ভাই ক্ষুদেবার্তা দিয়ে জানালেন, আমার ১৮২ মাইল দূরে গিয়ে খেলা দেখার অভিজ্ঞতাটি তার কাছে খুবই ভাল লেগেছে। ওই লেখার মাধ্যমেই তিনি জানতে পেরেছেন মাশরাফিকে একনজর দেখার জন্য, তাঁর সাথে দুদন্ড কথা বলার জন্য আমি কী পরিমাণ উতলা হয়ে আছি! তিনি আশা জাগালেন, তিনি হয়তো আমাকে ক্যাপ্টেনের সাথে একবার আলাপ করিয়ে দিতে পারবেন। আমিও আশায় আশায় বুক বাঁধলাম।
সুযোগ এলো না। দেখা করার আশা ছেড়ে দিয়ে কেবলমাত্র তাঁকে নিয়ে আমার লেখা বইটা তাঁর হাতে পৌঁছাতে চাইলাম। মুনাপু বললেন যে বইমেলায় আসবেন তিনি। আমি আপুর কাছে বইটা দিলে তিনি ওটা ঠিক মাশরাফির হাতে পৌঁছে দিবেন।
মেলায় গিয়ে আলতো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আপুর জন্য অপেক্ষা করলাম। “মাশরাফি” বইটা কিনলাম। আপু এল না। আমি অপেক্ষা করেই যাচ্ছি। আমার সঙ্গীরা জিজ্ঞেস করলো আমার মন খারাপ কিনা। আমি বললাম, না।
মেলার পিছনে ঘাসে বসে আপুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে “মাশরাফি” পড়তে শুরু করলাম। কোন নির্দিষ্ট জায়গা থেকে পড়ছি না। একেকবার একেক জায়গা থেকে পড়ছি। সময় যে দৌড়ে যাচ্ছে, টেরই পেলাম না। একটা পাতায় দেবুদা আর ওর কথোপকথন পড়ে আমি বই বন্ধ করে উঠে পড়লাম। আর কারোর জন্য অপেক্ষা করার দরকার নাই। বাচ্চাদের মতো অভিমান নিয়ে বেরিয়ে এলাম মেলা থেকে।
আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কী এমন দেখলাম যা দেখে আমার আগ্রহ উবে গেল? দেবুদা ম্যাশকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি কি বই পড়েন?”
মাশরাফি উত্তর করেছেন, “না।”
স্বপ্নলোক
তামিম ভাই বললেন, ‘ক্যাপ্টেনকে তোমার কথা বলেছি। উনি সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বললেন, তোমার বই পড়তে চায়।’
লোকে অধিক শোকে পাথর হয়, আমি অধিক খুশিতে পাথর হয়ে গেলাম। তবে তামিম ভাইয়ের পরের কথাটা আমাকে পাথর থেকে জীবিত মানুষে পরিণত করলো।
‘আগামিকাল তোমাকে স্টেডিয়ামে নিয়ে যাব। চেষ্টা করে দেখব, মাশরাফির সাথে দেখা করানো যায় কিনা।’
এটুকু শুনে আমি খুশিতে ধেই ধেই করে নাচতে বাকি রাখলাম। কত শত কল্পনা জল্পনা যে শুরু হয়ে গেল আমার উর্বর মস্তিষ্কে …
কীভাবে কথা বলবেন তিনি আমার সাথে? তিনি কি আদৌ আমাকে সময় করে দিতে পারবেন? কত কত ফ্যান আছে তাঁর, আমার মতো নগণ্য একজনের সাথে কি তিনি দেখা করবেন? দেখা হলেও কথা কি হবে?
“আমার অনুভূতি” নাম দিয়ে একটা আর্টিক্যালে ভূমিকার মতো করে খানিকটা লিখে রাখলাম। আগামিকাল মাশরাফির সাথে দেখা করে এসে পুরো অভিজ্ঞতাটুকু লিখে রাখব। সত্যিই দেখা হবে কিনা- এখনো কোন নিশ্চয়তা নেই। তবুও আমার উচ্ছ্বাসের কোন কমতি নেই। মন বলছে, এবার দেখা হবেই।
জেগে দেখা স্বপ্নগুলো ঘুমেও এসে ধরা দেয়। প্রচন্ড উত্তেজনা নিয়ে ঘুমাতে গেলেও গাঢ় ঘুম হল। এমন একটা স্বপ্নে দেখলাম, যেটা তৃপ্তি আর অতৃপ্তি – দুইই এনে দেয়। দেখলাম, পিনির সাথে নাসির-তাসকিনদের সাথে দেখা করতে গিয়েছি। পিনি নাসির-তাসকিনের সাথে দেখা করবে, আর আমি তো তাঁকেই দেখতে চাই। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে বাকিদের দেখা হলে খারাপ কী?
যাওয়ার আগে ক্রিকপ্লাটুনের এক প্রতিবেদনে দেখেছি ঠিক কোথায় থাকেন তারা! সেই ঠিকানা অনুযায়ী চলে এলাম। এসে দেখি বিশাল এরিয়া নিয়ে থাকেন তারা। সবার ঘর আলাদা আলাদা। ঘরগুলি খুবই অদ্ভুত, ইট সিমেন্টের নয়, ছনের! সবগুলি ঘরের সামনে নাম আছে। প্লেয়ারদের নাম নয়, ঘরের নিজের নাম! সবকিছু কত অদ্ভুত, কিন্তু স্বপ্নে সবকিছু স্বাভাবিকই মনে হল। প্রতিবেদনের লেখানুযায়ী নাসিরকে খুঁজতে একদিকে গেলাম। পেয়েও গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী খবর ভাই?’ মন খারাপ করে মাথা নাড়ল সে। আমি বললাম, ‘আরে ধুর! এখনো খেলার শেষ ওভার নিয়ে মন খারাপ করে পড়ে আছেন? এটা কোন ব্যাপার না। খারাপ দিন তো আসেই।’
বলতে না বলতেই পিনি চলে এল। বলল, ‘আপনি দাঁড়ি কেটে ফেলছেন? দাঁড়িতে আপনাকে সুন্দর দেখাচ্ছিল তো!’
বলেই ছবি তোলার তোড়জোড় শুরু করলো। ছবি তোলার পর নরম সুরে নাসিরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই! ক্যাপ্টেনের সাথে দেখা করা যাবে?’
সে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘যাবে না।’
বিষণ্ণ মন নিয়ে পিনিকে কিছু না বলে চলে এলাম তাসকিনের ঘর খুঁজতে। ঘর খুঁজে পেয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি তাসকিন কোত্থেকে যেন দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকে গেল। এসেই বই নিয়ে পড়তে বসলো। সুর করে টেনে টেনে পড়ছে। ঠিক যেন একটা বোর্ডিং স্কুলে আছে! টিচার পড়তে না দেখলে পিট্টি লাগাবে।
আমিও ঢুকে গেলাম খোলা দরজা দিয়ে। পিনিকেও ডেকে নিলাম। তাসকিনের সাথে কথা বলতে শুরু করতেই সে বলল, ‘আস্তে কথা বলেন! শুনে ফেললে রক্ষা নাই!’
তক্ষুনি কে যেন তাসকিনের জানালায় উঁকি দিল। আমরা সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেললাম। ভেবেছিলাম অন্ধকারে লোকটা দেখতে পাবে না আমাদের। কিন্তু সে বাঁজখাই গলায় বলে উঠল, ‘দরজা খোল!’
তারমানে দেখে ফেলেছে!
পিছনে তাকিয়ে দেখলাম আরেকটা দরজা আছে। খিড়কি খুলে পিছন দিয়ে চম্পট মারলাম। কেন এত লুকোচুরি, কে জানে!
তাসকিনের ঘর থেকে বেরিয়ে কিছুদূর হেঁটে দেখি, রাজকীয় কাপড় পরা এক লোক পুকুরে অজু করছে। চিনতে পারলাম না। নিজেকেই ধিক্কার দিচ্ছিলাম এই বলে যে, বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডের সবাইকে আমি চিনি না!
যাকগে, তিনি উপরে উঠে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘আংকেল, ক্যাপ্টেনের সাথে দেখা করা যাবে? প্লিজ?’
তিনি বললেন, ‘তুমি কিসে পড়ো?’
কেন কে জানে, বললাম, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং!’
তিনি উত্তর করলেন, ‘বাসায় গিয়ে পড়াশোনা করো।’
বলেই হাঁটা ধরলেন। কয়েক পা এগিয়ে আবার ফিরে এলেন। আমি তখন ছলছল চোখ নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি। বললেন, ‘ওর অসুখ নিয়ে কথা বলবে না তো?’
আমি জানিইনা প্রিয় ম্যাশ অসুস্থ। তবুও বললাম, ‘না, বলব না।’
বললেন, ‘চলো।’
আমি তখন ভাবছি, কল্পনাই করিনি ম্যাশের সাথে কথা বলার সুযোগ পাব! স্বপ্নের মধ্যেই মনে হল স্বপ্ন দেখছি না তো? আংকেল একটা রিকশা নিয়ে এলেন। আংকেলের সাথে আমি একা রিকশায় চড়ে বসেছি। পিনি নাই। কই আছে জানি না। ওকে ডাক দেওয়ার কথা মাথাতেও এল না। আমি তখন পুরাই ঘোরের মধ্যে।
সংকীর্ণ মেঠো পথ দিয়ে রিকশা চলছে তো চলছেই। কত খানাখন্দ রাস্তার দুই পাশে। ভাবছি, মাশরাফি থাকে কই?
ক্যাপ্টেন বুঝি এমন দুর্গম জায়গায় থাকে? হঠাৎ মেহেদি ফুলের সেই মোহময় মিষ্টি গন্ধটা পেলাম। কেউ বলে দিল না, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারলাম কাছাকাছি চলে এসেছি। রিকশা থেকে নামতে পারছি না। হাত-পা থরথর কাঁপছে …
কিন্তু, ঘুম ভেঙ্গে গেল ………
পরিশিষ্ট
তামিম ভাইয়ের সাথে স্টেডিয়ামে এসেছি।
ঝকঝকে একটা দিন। ক্রিকেটাররা নাকি মাত্র মিনিট বিশেক আগে নেটে প্র্যাক্টিস করছিল। ঘন্টা দুয়েক প্র্যাক্টিস করে রেস্ট নিতে ড্রেসিংরুমে গেছে। তামিম ভাই বলল, ‘তোমার সাথেই কেন এমন মিস টাইমিং হয়, কে জানে!’
একটু থেমে বললেন, ‘তুমি স্টেডিয়ামটা ঘুরে দেখ, আমি ভিতরের অবস্থাটা দেখে আসি।’
আমি একটা একটা করে সবগুলি গ্যালারি ঘুরে ঘুরে দেখছি। প্রত্যেকটা গ্যালারিতে ঢোকার জন্য প্রত্যেকবার স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে আলাদা আলাদা গেট দিয়ে ঢুকতে হয়। আমি ঢুকছি, দেখছি, বেরোচ্ছি।
ঢুকছি, দেখছি, বেরোচ্ছি।
ঢুকছি, দেখছি, বেরোচ্ছি।
ঠিক কত সময় পর জানি না, আমার মনে হল অনেকক্ষণ ধরেই একজায়গায় ঘুরে মরছি। মেইন গেইট খুঁজে পাচ্ছি না কিছুতেই। তামিম ভাই তো মনে হয় আমাকে খুঁজছে। মরিয়া হয়ে মেইন গেইট খুঁজতে লাগলাম। যখন মনে হল আর খুঁজে পাবোই না, তখনই দেখলাম তামিম ভাই জান প্রাণ দিয়ে দুই হাত নাড়াচ্ছে। এক হাতে মোবাইল। নিশ্চয়ই কল করেছে অনেকবার? ফোনের কথা তো মাথাতেই ছিল না।
তামিম ভাইয়ের হাসিমুখ দেখে বুঝলাম, তাঁর সাথে দেখা করার অনুমতি মিলে গেছে। আমার উচিৎ উড়ে চলে যাওয়া। অথচ আমি যেন পা-ই নাড়াতে পারছি না। সিসার মতো ভারি লাগছে পা দুটোকে।
হঠাৎই মনে হল, যাব না আমি। তাঁর সাথে দেখা হবার পর আমি হয়ত আমার নিজের কল্পনার মানুষটার সাথে মিল পাব না। তখন আমার মোহমুক্তি হবে। সেই সাথে আমার মন ভেঙ্গে যাবে।
আমি আমার মনকে ভাঙতে চাই না। সব অধরা স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেলে জীবনের কোন মানে থাকে না।
কত হাজার হাজার পাগল ভক্ত আছে তাঁর। কত কতজনের উচ্ছ্বাস দেখেছেন তিনি। আমি তো সাধারণ একজন। তাঁর সাথে আমার দেখা হওয়াটা তো তাঁর কাছে সাধারণ একটা ঘটনাই হবে।
আমি সেটা চাই না। আমি চাই ব্যাপারটা অসাধারণ থাকুক। হোক না কেবল আমার কাছেই।
মোবাইল বের করে কালার নোট থেকে “আমার অনুভূতি” লেখা নোটটা ডিলিট করে দিলাম।
তামিম ভাই চিৎকার করে নাম ধরে ডাকছে।
মাদিহা!
মাদিহা!!
মাদিহা!!!
নিজের নামটা কতশত বার প্রতিধ্বনিত হয়ে কানে আসছে।
‘করছো টা কী! জলদি এসো! তিনি অপেক্ষা করছেন।’ আবার চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।
তার ডাক সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আমি পিছনে ঘুরে ছুটে বেরিয়ে গেলাম।
স্টেডিয়াম থেকে দূরে।
আমার বহুদিনের অধরা স্বপ্ন থেকে দূরে।
রক্ত-মাংসের “সে” থেকে দূরে।
অনেক দূরে।