মায়ান সভ্যতা বা মায়া সভ্যতা। প্রায় চার হাজার বছর আগের একটি সভ্যতার নাম যে সভ্যতা প্রাচীন যুগে গড়ে উঠেছিল। যখনকার মানুষ কেবল আগুনের ব্যবহার বা আগুনে খাবার ঝলসে সিদ্ধ করে খেতে শিখেছিল, কিন্তু সেই যুগে মায়ানরা কি করে এত উন্নত সভ্যতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি তা বর্তমান বিশ্বের একটি বিস্ময় ! উন্নত আধুনিক সভ্যতার অনেক প্রাপ্তিই বা ধারণা মায়ান সভ্যতা থেকে পাওয়া যায়, অথবা চার হাজার বছর আগে তারা যা শিখেছিল, আবিষ্কার করেছিল আমরা সবে তা রপ্ত করেছি।
মধ্য আমেরিকার মেক্সিকো , গুয়াতেমালা,হন্দুরাস, বেলিজ, এবং এল সালভাদর, এই ৫ দেশে প্রায় তিন সহস্রাব্দীরও বেশী সময় জুড়ে গড়ে উঠেছিল মায়া সভ্যতা। এই এলাকায় শিকারী যাযাবর মানুষের বসবাসের সাক্ষ্য পাওয়া যায় ১১,০০০ বছর আগে থেকে। মায়া সভ্যতার প্রাচীনতম নিদর্শন পাএয়া যায় ২৬০০ খৃস্টপুর্বাব্দে মেক্সিকোর ইয়াকাটুন পউপদ্বীপে।
যখন পৃথিবীর মানুষ বাড়িঘরই ঠিকঠাক বানাতে সক্ষম ছিলনা তখন কিভাবে তারা পাথর দিয়ে তৈরি করেছিল বিশাল ঘরবাড়ি, ভাষ্কর্য, মূর্তি ! জ্যোতির্বিদ্যা, স্থাপত্যশিল্প,অঙ্ক শাস্ত্র, চিত্রলিপির ব্যবহার, ক্যালেন্ডারের ব্যাবহার প্রভৃতিতে মায়ানরা বিশেষ অবদান রেখেছিল। তারা জঙ্গল পরিস্কার করে চাষাবাস করা, রাস্তাঘাট তৈরি, জলাধার নির্মান, বুনন , মৃত্তিকা শিল্প প্রভৃতিতেও মায়ারা ছিল সমান দক্ষ। তারা চিত্য বিনোদন, সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রেও এগিয়ে ছিল। অথচ তখন ছিল প্রাচীন যুগ।
সে সময় অধিকাংশ জাতির ভাষাই পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি, তখন মায়ানরা তাদের ভাষায় একরকম ক্যালেন্ডার বানাতে সক্ষম হয়েছিল। মায়ানরা চাঁদ, তারা, গ্রহ নক্ষত্র নিয়ে অর্থাৎ জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে চর্চা বা পড়াশুনা করত। তারা গান, কবিতা লিখত অর্থাৎ সাহিত্য চর্চা করত! পুরো আমেরিকা মহাদেশজুড়ে মায়ান সভ্যতাই একমাত্র প্রাচীন সভ্যতা, যাদের নিজস্ব লেখা ভাষা ছিলো, যারা সুন্দর করে পড়তে ও লিখতেও জানত।
মায়ান সভ্যতা নিয়ে রয়েছে অনেক প্রশ্ন যেমন, কীভাবে উদ্ভব হল এই মায়ান সভ্যতার ? কীভাবে এই সভ্যতা আদিম যুগেও এত উন্নত, সমৃদ্ধ এবং বিকশিত হয়েছিল?
মায়ানরা মৃতদেহের সৎকার করত এবং মৃতদেহের সমাধিও নির্মাণ করত। ফলে এভাবেই হয়ত মায়ানরা পিরামিড ও মমি তৈরির ধারণা পেয়েছিল। তাদের তৈরি মমি, পিরামিডগুলো মিসরের সুউচ্চ পিরামিড ও মমির মত বিশাল না হলেও তা ছাঁচের তৈরি করত। মায়ান সভ্যতা এত খ্যাতি পেয়েছে মূলত তাদের স্থাপত্যশিল্পের জন্য। তাদের তৈরি বিশাল ঘরবাড়ি, পিরামিড আর মূর্তিগুলোর জন্য।
মায়ান সভ্যতায় যেমন ছিল হিংস্রতা, নিষ্ঠুর ও আদিমতা, তেমনি ছিলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি।
মায়ানরা অন্যান্য সভ্যতার মত লোহা বা ব্রোঞ্জের অস্ত্র ব্যবহার করত না। তারা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত আগ্নেয় শিলা অথবা অবিসিয়ান অর্থাৎ কাঁচের মত দেখতে এক প্রকার পাথর। মায়ানরা চ্যাপ্টা কপালের অধিকারী ছিলো। তাদের জাতির গুনী মানী ব্যক্তিদের নাক কোণ বিশিষ্ট করার জন্য তারা পুডিং ব্যবহার করত বা বলা যেতে পারে এ যুগের প্লাস্টিক সার্জারির ধারণা হয়ত সেখান থেকেই এসেছে। সমাজের অভিজাত নারীরা দাঁতে বিন্দু এঁকে নকশা করতে। মায়ান শিশুরা জন্মের কয়েকমাস পর থেকে কয়েকবছর পর্যন্ত কপালে ভারী কোন ধাতব বস্তু বা পাথর চেপে রাখত কপাল চেপ্টা করার জন্য। আবার জন্মের পর একটি শিশুর চোখের সামনে কোন স্থির বস্তু নিয়মিত ধরে রাখা হত যতক্ষণ না শিশুটি ট্যারা হয়ে যায়। এসব সাধারণত সম্ভ্রান্ত রাজবংশীয়দের জন্য প্রচলিত ছিল। মায়ানদের চিকিৎসাবিদ্যা অনেক আধুনিক ছিলো। তারা শরীরের ক্ষত মানুষের চুল দিয়েই সেলাই করত, দাঁতের গর্ত পূরণ করা, এমনকি নকল পাঁ লাগাতেও পারদর্শী ছিলো। তারা প্রকৃতি থেকে ব্যথানাশক সংগ্রহ করত এবং সেই গাছগাছড়া তারা পূজায় ব্যবহার করত। ধর্মীয় রীতি অনুসারে আবার ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করতো। রোগীকে অজ্ঞান করার জন্যও তারা ওষুধের ব্যবহার জানত।
মায়ানরা শারিরীক সুস্থতা এবং আত্মশুদ্ধির জন্য স্টিম বাথ নিত। পাথরের টালি দিয়ে তৈরি ছোট্ট একটি ঘরে পানি ঢেলে ভিজিয়ে ভিজিয়ে তারা এই বিশেষ স্টিম বাথের ব্যবস্থা করত। ব্যাবিলনীয়দের পাশাপাশি মায়ানরা ইতিহাসে সর্বপ্রথম জমি পরিমাপের ক্ষেত্রে শূন্যের ব্যবহার করতে শিখেছিল। মায়ানদের লেখার পদ্ধতি সমসাময়িক যেকোনো সভ্যতার তুলনায় এগিয়ে ছিল। তারা যেকোন কিছুর উপরে এমনকি দেয়ালের গায়েও লিখত।
তারা সূর্য দেবতার সন্তুষ্টির জন্য নিয়মিত নরবলীর ব্যবস্থা করত। প্রচলিত অন্যতম রীতি ছিল এটি। তারা যুদ্ধ এবং রত্নের বিনিময়ে বন্দীদের জোগাড় করত। বন্দী বা দাসদের মেরে ফেলার আগে তারা নির্মম অত্যাচার চালাত।
ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা পরিচালিত মায়ারা গনিত এবং জ্যোতির্বিদ্যায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল। বিশেষ করে শূন্যের ব্যবহার এবং ৩৬৫ দিনের উপর ভিত্তি করে একটি জটিল ক্যালেন্ডার পদ্ধতির উন্নয়ন।
মায়ানরা জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী ছিল যার বেশ কিছু উদাহরণের মধ্যে অন্যতম হল তাদের তৈরি ক্যালেন্ডার। তাদের ৩ টি ক্যালেন্ডার ছিল। তার মধ্যে একটি ছিলো `হাব` যেখানে বছরকে আধুনিক ক্যালেন্ডারের মতোই ৩৬৫ দিনে ভাগ করা হয়েছিল।
আরো বিভিন্ন বিষয়ে তারা পারদর্শি এবং উন্নত ছিল, মোট কথা তারা বিশেষ কিছু অবদান রেখেছিল যা শুধু আদিম যুগেই না বরং আধুনিক যুগেরও বিস্ময় ! কিন্তু মায়ান সভ্যতার বিলুপ্ত সম্পর্কে সুস্পষ্ট কারণ জানা যায়নি। বিজ্ঞানী গবেষকরা ধারণ করেন, মায়ানরা প্রায়ই যুদ্ধে লিপ্ত থাকত হয়ত যুদ্ধ, অধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা কোন মহামারীতে এই সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে এখনও পৃথিবীর কিছু অঞ্চলে মায়ানদের অস্তিত্ব রয়েছে।
তথ্যসুত্র: ইন্টারনেট