যদি ভেবে বসেন এই বাঙালিদের পক্ষে কি আর সুপারহিরো সিনেমা বানানো সম্ভব, তবে জনাব আপনি এখনও বাংলা সিনেমার ব আর স কোনটাই দেখেন নাই। পেশ করছি এককালের আলোড়ন(!) সৃষ্টিকারী জুটি মুনমুন ও শাহীন আলম, বাংলার সুপারম্যান খ্যাত নায়ক ড্যানি সিডাক ও নূতন অভিনীত, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু পরিচালিত বাংলা সিনেমা “শক্তির লড়াই”।
এই সিনেমাটিকে আসলে সুপার ক্রিটিকাল অ্যাডভান্সড অ্যাপ্লাইড রোম্যান্টিক সাইন্স ফিকশন মুভি জনরায় ফেলা যায়। এখানে যেমন পাবেন স্বামীর সাথে সুখের সংসারের রোমান্টিকতা, মৃত থেকে জীবিত করার ফিকশন, সাথে মানুষকে মেশিনে রূপান্তরিত করার সাইন্স। যদিও তার কস্টিউমের সাথে রোবকপের মিল পাওয়া যায়, বস্তুত এ মুভিতে টারমিনেটর ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকেও কিছুটা মিল পাওয়া যায়। তাই তাকে বলা যেতে পারে সুপার ক্রিটিক্যাল। আর আপনি এই সিনেমার প্রতিটি গানের অ্যাডভান্সড রিদমিক কোরিওগ্রাফি দেখে যেমন হবেন মুগ্ধ, তেমনি অ্যাপ্লাইড ঘরানার নৃত্যে আপনি নিজেকে নতুন করে খুজে ফিরতে পারেন।
আসুন তবে পরিচিতি শুরু করা যাকঃ-
|
শুরুতেই আদর্শ বাংলা সিনেমার চিরচেনা সেই ঝাপসা দাগকাটা পর্দায় দেখতে পাবেন সিনেমাটির প্রডাকশনে আছে ‘হাই পাওয়ার’ নামে একটি কোম্পানি। শুরুতে এ নাম দেখেই বুঝতে পারবেন এ সিনেমা সহ্য করতে কি ধরনের হাই পাওয়ারের প্রয়োজন।
প্রথম দৃশ্যে ডঃ মওলা বিশাল বিশাল ফ্লাস্কের মধ্যে রঙিন পানি নিয়ে বুদবুদ উঠায়। তারপর হঠাৎ নব্বই দশকের কম্পিউটার স্ক্রিনে ‘ব্রেইন ওয়াশ’ লেখা উঠতেই ডঃ মওলা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। তারপরে সে সহকারী বিজ্ঞানী ডঃ জাহানকে ব্রেইন ওয়াশের মর্ম বুঝায়। শুনলে বুঝতে পারবেন এটা কতটা জরুরী।
ডঃ জাহান, তার বৌ রোকেয়া ও তাদের মেয়ে লিটা পরে বিচে ঘুরতে গিয়ে আনন্দে নাচানাচি করতে থাকে। এমন সময় একদল গুন্ডা এসে রোকেয়াকে তাদের সাথেও নাচানাচি করতে বলে। কিন্তু সে রাজী না হওয়ায় তারা রুষ্ট হয়ে ডঃ জাহানকে মারতে থাকে। পরে পুলিশ আসতেই তারা পালিয়ে যায়।
পরেরদিন ল্যাবে আরো এক্সাইটিং কিছু আবিষ্কার করা হয়, আর ইউরেকা ইউরেকা বলে চিৎকার শোনা যায়।
সেদিন আবার ডঃ মওলার মেয়ে শারমিন মাথায় সানফ্রান্সিস্কো থেকে আনা বিশাল হ্যাট পড়ে সময় কাটাতে বস্তির উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায়। এতে বেশ কিছু চাটাই এর তৈরী ঘর এবং সবজি ও ফলের গাড়ি আহত হয়। তৎক্ষণাৎ ইন্সপেক্টার সোহেল, যে কিনা আবার শারমিনের বয়ফ্রেন্ড, এসে হাতকড়া পরিয়ে তাকে জেলে নিয়ে যায়। এখানে ঘটনা হচ্ছে গার্লফ্রেন্ড হও আর যাই হও, আইনের আওতায় তোমাকে আসতেই হবে। যদিও পরবর্তিতে রোবকপ ইচ্ছামত খুন-খারাপি করতে থাকে, তবুও তাকে জেলে ভরা হয় না। কারন সে আইনের উর্ধে। পরবর্তিতে ডঃ মওলা এসে জামিনে শারমিনকে জেল থেকে ছুটালে সে ইন্সপেক্টারের সাথে জঙ্গলে নাচানাচি ও গান প্র্যাক্টিস করতে যায়।
রাতের বেলায় তিনজন গুন্ডা এক বুড়ো সাংবাদিকের পিছে দৌড়াতে থাকে। তাই দেখে ডঃ জাহান হাঁদারামের মত মুখ করে গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। গুন্ডারা দৌড়ানোর এক পর্যায়ে গুলি করে সাংবাদিককে মেরে ফেলে, যা ডঃ জাহান গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে(!) দেখতে থাকে। গুন্ডারা তাই তার গাড়ি করে ক্রাইম স্পট থেকে সেফ পজিশনে চলে যায়। তারপর তারা গাড়ি বদলে অন্য আরেকটা গাড়িতে উঠে পড়ে(!)। ডঃ জাহান তাদের যেতে দিয়ে শুধু গাড়ির নাম্বার মুখস্থ করে পুলিশকে বলে দেয়। পুলিশ কয়েকজন গুন্ডাকে ধরে নিয়ে এসে ডঃ জাহানের সামনে পেটাতে থাকে, যার ফলে ডঃ জাহান ভিলেন সমাজের টার্গেটে পড়ে যায়। বাংলা লজিক। প্রবলেম?
যদিও ভিলেন গ্যাঙের কোন নাম নেই, তবুও মুভিটি দেখলেই বোঝা যায় তারা এলাকার ত্রাস। শরিফ মাহমুদ নামে এক ব্যাবসায়ি তাদের নেতা। তার ডান হাত হচ্ছে জুলি নামের এক বিধ্বংসী যুবতী, তবে আসল কিলিং করে পুরুষ বাহিনী। সেক্সিস্ট…! তারা ডঃ জাহানের বৌকে ফোনে হুমকি দিয়ে বলে জাহান যেন আসল অপরাধী সনাক্ত না করে, কিন্তু তারা তা শোনে না। তাই পুলিশ তাদের ফ্যামিলিকে সেফ হাউজে নিয়ে যায়।
এরপরে ইন্সপেক্টর সোহেল ডঃ জাহানের বিবি ও কন্যাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের গাড়িতে করে নিয়ে যায়। তখন ইন্সপেক্টারকে বেশ কনফিউজড দেখাচ্ছিল। অথচ রোকেয়া ও লিটা খুনের সময় উপস্থিত ছিল না। তবে কেন এই জিজ্ঞাসাবাদ? (সাসপেন্স। টান টা না…) পরবর্তিতে জানা যায়, ভিলেন নেতা শরিফ মুখোশ পড়ে রোকেয়া ও লিটাকে কিডন্যাপ করে। তবে অজানা কারনে তার কন্ঠও চেঞ্জ হয়ে যায় কেন তা প্রশ্নাতীত ব্যাপার। এই কিডন্যাপিং এর জের ধরে আসল ইন্সপেক্টার সোহেলকে পুলিসজি হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয় ও প্রায় চাকুরিচুত্য করা হয়। এই সময় প্রথম শারমিনকে কাঁদতে দেখা যায়।
শরিফ মাহামুদ পরে জাহানকে ফোন দিয়ে পাশেই অবস্থিত এক আগ্নেওগিরির কাছে এসে তার মেয়ে আর বৌকে নিয়ে যেতে বলে। পরে অবশ্য তারা তার মেয়েকে মেরে ফেলে ও জাহানকে রক্তাক্ত অবস্থায় রেখে পালিয়ে যায়। স্বামী সন্তানকে আশংকাজনক অবস্থায় গাড়িতে তুলে রোকেয়া কোন এক অজানা কারনে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে ডঃ মওলার ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যায়। সেখানে ডঃ মওলা জাহানের উপরে তার আবিষ্কৃত বিজ্ঞানের(!) প্রয়োগ করতে শুরু করে। তা শুরু হয় একটা টেবিলে জাহানকে শুইয়ে মাথায় স্টিলের কিছু দিয়ে আটকিয়ে কিছু একটা ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে ঢুকিয়ে তার উপরে লাল রঙের আলো ফেলে। কম্পিউটারে তার স্ট্যাটাস ও পালস রেকর্ড হতে থাকে। এর পরে ডঃ মওলা তার গায়ে যেন আলো না লাগে তাই এক প্রকার স্টিলের স্যুট বানিয়ে তাকে পড়িয়ে দেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলার রোবকপের জন্ম হয়।
এই প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে অবশ্য রোকেয়া তার মেয়ের মাটি দেয় ও থানায় গিয়ে পুলিশ কমিশনারকে বলে ইন্সপেক্টার সোহেলকে থানা থেকে ছাড়ায়। স্যুটেড বুটেড রোবকপ এই সময়ে ল্যাব থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠে সেই আগ্নেয়গিরির কাছে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে। ডঃ মওলা ও রোকেয়া রোবকপের পিছু নিতে থাকে। চিৎকার শেষে গাড়িতে উঠে রোবকপ সেই সাংবাদিক খুনের জায়গায় এসে হাজির হয়। সেখানে এবার তিনজন গুন্ডা একটি মেয়েকে ইভটিজিং করতেছিল। তাই দেখে রোবকপ পায়ের ভেতর থেকে একটি বন্দুক বের করে ও মেয়েটির স্কার্ট ভেদ করে একজন ইভটিজারের গোপনাংগে গুলি করে। সেখানে সে নিজেকে লৌহ মানব বলে পরিচয় দেয়। ইন্টারেস্টিং!
এরপরে আরেক হাইজ্যাকার গ্রুপকে ধরে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে থানায় দিয়ে আসে। সেখানে সে নিজেকে ‘লৌহ্মানব-পুলিশের বন্ধু’ বলে চালিয়ে দেয়। এভাবে সে মাঝেমাঝেই মন্দলোক ধরে থানায় দিয়ে আসতে শুরু করে। এমন এক দিনে রোবকপ আর তার বৌ রোকেয়া এক জায়গায় দুজন গুন্ডাকে ধরে, যারা তাদের মেয়েকে মেরে ফেলেছিল। সেখান থেকে আসল ভিলেন শরিফের সন্ধান পায়। সেদিন রাতেই তারা দুজন শরিফের ডেরায় হামলা করে সবাইকে মেরে ফেলে। শরিফের চ্যালারা অবশ্য রোবকপের দিকে মুহুমুহু গুলি বর্ষন করেও কিছু করতে না পেরে শেষ অস্ত্র হিসেবে মদের বোতল ছুড়ে মারে। শরিফ ও তার কয়েকজন চ্যালা ভাগ্যক্রমে পালিয়ে বেচে যায়।
শরিফ এই লৌহমানবের রহস্য উদ্ঘাটন করতে ডঃ মওলার ল্যাবে গোপনে ঢুকে সবকিছু জেনে ফেলে। পরে ডঃ মওলার স্ত্রী ও মেয়ে শারমিনকে গুম করে এক লালবাতিওয়ালা কাচের ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে বসিয়ে রাখে। পরে ডঃ মওলাকে ধরে নিয়ে এসে তার ডান হাত জুলিকেও রোবকপ বানিয়ে দিতে বলে। ডঃ মওলা অস্বিকার করলে লালবাতিওয়ালা ঘরের লাল বাতি জ্বালিয়ে দেয় ও নিচ দিয়ে ধোয়া বের হতে থাকে। এই ধোয়ায় শারমিন ও তার মা কস্টে কেপে ওঠে। সেই কষ্ট ডঃ মওলা সহ্য করতে না পেরে রাজী হয়। শরিফ জুলিকে গুলি করে আধমরা বানিয়ে ডঃ মওলার ল্যাবে পাঠিয়ে দেয়।
এই সময় রোকেয়া রোবকপের সাথে নাচ-গানে মোজমাস্তি করতে করতে মেয়ের কবরের পাশে নিয়ে আসে। তারপরে মেয়ের মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দিতেই তার ফরমেট করা মেমোরি অটো রিকভারী নেয়। এতে করে তার সব মনে পড়তেই সে আবেগে কেঁদে ফেলে।
জুলি সেই একই আলো ও ইনজেকশনের বৈজ্ঞানিক(!) প্রক্রিয়ার মাধমে জুলিকেও রোবকপের আপগ্রেডেড ভার্শন ২.০ তে বদলে দেয়। তবে এই ভার্শনে জুতা বাদে কোন আলাদা আর্মরের প্রয়োজন হয় না। আরেকটা কারন হয়ত হতে পারে যে আরেকটা রোবকপ কস্টিউম বানানোর বাজেটও হয়ত ছিল না প্রযোজকের। কস্টিউম ছাড়া তাকে দেখতে কিছুটা টারমিনেটরের মতন দেখায়। সে যাই হোক, পরে শরিফ তার পাওয়ার টেস্ট করতে গিয়ে ল্যাবের বাকি সব বিজ্ঞানিদের মেরে ফেলে। এখানে অনেক বিজ্ঞানির প্লাস্টিকের কন্টেইনারে লেগে মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত পড়তে দেখা যায়।
এত উপকারের পরেও শরিফ ডঃ মওলাকে ও রোকেয়াকে আবার ধরে নিয়ে গিয়ে তার অফিসে বেশে রাখে। এমতাবস্থায় পুলিশ সেখানে রেইড দিয়ে টারমিনেটর জুলির দিকে রাইফেল দিয়ে গুলি চালায়। কিন্তু টারমিনেটর তার হাতের ব্রেসলেট দিয়ে প্রতিটি গুলি থামিয়ে দেয়। এই সময় আকাশে কিছু কাঁকের কা-কা শব্দ শোনা যায়। এই দেখে ইন্সপেক্টার সোহেল অন্য পুলিশ সদস্যদের মরতে দিয়ে নিজে বাইকে করে পালিয়ে চলে যায়। এমন সময় তার ঘাড়ে একটি গুলি লাগে। তবুও সে জানে বেচে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
সোহেল পালিয়ে যেতে থাকলে শরিফ শারমিনকে ধরে আবেদনময়ী নাচ গান করতে বাধ্য করায়। সেই গানের ফাকেই সোহেল রোবকপের কাছে চলে যায়। পরবর্তিক্ষনেই রোবকপ আর সোহেল ক্রাইমস্পটে এসে স্ট্র্যাটেজিক মারপিট শুরু করে। রোবকপ জুলির সাথে মারামারি করতে থাকে, আর সোহেল তার গুলি লাগাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাকি গুন্ডাদের একাই পিটাতে আরম্ভ করে দেয়। জুলি ফ্লোরে শুয়ে স্লাইড করে এসে লাথি মারার মত গুরুত্বপুর্ন টেকনিক ইউজ করে, ফলে রোবকপ ভুলেই যায় যে তার কাছেও একটা পিস্তল আছে, এবং সে খালি হাতেই যুদ্ধ করতে থাকে। এমন অবস্থায় সব বন্দি ছাড়া পেয়ে যায় ও অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে। শরিফ তাই এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে চিৎকার করে আদেশ করে, ‘কিল হিম’ বলেই দৌড়ে পালিয়ে যেতে শুরু করে। এবার রোকেয়া জিপে করে তার পিছু নেয়।
রোবকপ আর টারমিনেটরের মারামারির চোটে বিল্ডিং ধসে পড়ে। এই অবস্থায় টারমিনেটর গাছের সাথে বাড়ি খেতে খেতে ব্যালান্স ফিরে পায়। রোবকপ আর টারমিনেটরের এই দুর্দান্ত মারামারি চলতেই থাকে, চলতেই থাকে, চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। শেষমেশ তারা সেই আগ্নেয়গিরির কাছে এসে মারামারি করে ও এক পর্যায়ে টারমিনেটরকে আগ্নেয়গিরির মাঝে ফেলে দিয়ে মারামারি শেষ হয়।
রোকেয়াও অপরদিকে জিপ নিয়ে শরিফ মাহামুদকে তিনবার গাড়িচাপা দেয় কিন্তু তার সামান্য কেটেছিড়ে যায় মাত্র। শেষ বার গাড়িচাপা দিতে প্রস্তুত হতেই ইন্সপেক্টর সোহেল সামনে দুইহাত প্রসারিত করে শরিফকে আইনের হাতে তুলে দিতে আবেদন জানায়। এই নাটক চলাকালে শরিফ পেছন দিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতে গেলে রোবকপ তাকে ধরে ফেলে ও এক টান দিয়ে তার একটা হাত ছিড়ে ফেলে। এরপর তাকে পুলিশে তুলে দেয়। এই মারামারিতে ব্রেইনে শট সার্কিট হয়ে রোবকপের সম্পুর্ন মেমোরি রিকভারি হয়ে যায়। অবশ্য হাত ছিড়ে ফেলার কারনে তার বিরুদ্ধে কোন চার্জশিট হয়েছে কিনা জানা যায় নি। এরপরে সবাই সুস্থ হয়ে যার যার ঘরে ফিরে যায় এবং live happily ever after!
শুধু পিছনে পরে থাকে ট্রমাটাইজড সিনেমা-দর্শকেরা।
The End.