পাই- এর গল্প

piপাই– প্রাচীন গ্রিক ভাষার একটি বর্ণ। গ্রিক পরিধি (περίμετρος পেরিমেত্রোস্‌) এর প্রথম বর্ণ থেকে এই পাই এর উৎপত্তি। ইংরেজিতে এর উচ্চারন পাই হলেও গ্রিক উচ্চারন কিছুটা ভিন্ন হয়ে থাকে।  গনিতের ক্ষেত্রে এর গুরুত্বটা অনেক। এটা  গুরুত্বপূর্ণ একটি গানিতিক ধ্রুবক যার মান মোটামুটিভাবে ৩.১৪১৫৯ ধরা হয়। গনিতে বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাতকে প্রকাশ করার জন্য এই ধ্রুবক ব্যাবহার করা হয়। এটা একটি অমুলদ সংখ্যা। একে দশমিক আকারেও সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা যায় না। আবার পৌনঃপুনিক আকারেও আসে না।

গণিতের ইতিহাস জুড়ে  নির্ভুলভাবে পাইয়ের মান নির্ণয়ের ব্যাপক চেষ্টা করা হয়েছে। ১৭০৬ সালে সর্বপ্রথম গনিতবিদ উইলিয়াম জোনাস এটি ব্যাবহার করে।উইলিয়াম জোনস তার “এ নিউ ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথম্যাটিকস” (A New Introduction to Mathematics) বইতে প্রথম এই ধ্রুবক প্রকাশে পাইকে  প্রতীক ব্যবহার করেন। তবে এটি জনপ্রিয় হয় ১৭৩৭ সালে অয়েলার যখন এটি গ্রহণ করেন। ১৭৬১ সালে জহান হেনরিখ ল্যাম্বাট সর্বপ্রথম পাইকে আমুলদ সংখ্যা হিসেবে প্রমান করেন। পাই নিজেই একটি অসীম দশমিক বর্ধন কারণ পাই এমন একটি অমূলদ সংখ্যা যার দশমিক বর্ধন কখনো শেষ হয় না বা পুনরাবৃত্তি করে না। পাই এর মানের ক্ষেত্রে দশমিকের পর ট্রিলিয়নের বেশি ঘর পর্যন্ত বের হবে। অর্থাৎ ১ এর পর ১২ টি শুন্য ব্যাবহার করার পর পর্যন্ত এর ধমিকের মান বের হবে। যেমনঃ ৩.১৪১৫৯২৬৫৩৫৮৯৭৯৩২৩৮৪৬২৬৪৩৩…চলমান। তবে সাধারন ভাবে দশমিকের পর ৪-৫ ঘর পর্যন্ত আর বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে দশমিকের পর ১২-১৫ ঘর পর্যন্ত ব্যাবহার করা হয়ে থাকে। বহু গণিতবিদ এর মান সঠিকভাবে বের করার চেষ্টা করেছে। এমনকি সুপার কম্পিউটার ব্যাবহার করেও এর মান বের করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তখনও দশমিকের পর লক্ষ কোটি ঘর পর্যন্ত হিসাব করে কোন পুনরাবৃত্তি পাওয়া যায় নি। পাই এর এরকম মান অনেক গণিতবিদকে বিভ্রান্ত ও চমৎকৃত করেছে।

বৃত্তের পরিধি ও ব্যাস এর অনুপাতকে পাই হিসেবে সঙ্গায়িত করা হলেও এর মান কিন্তু পরিধি বা ব্যাসের মাপের উপর নির্ভর করে না। যেমন কোন বৃত্তের ব্যাস অন্য একটি বৃত্তের ব্যাসের দ্বিগুন হয়, তাহলে সেই বৃত্তের পরিধি পরের বৃত্তের পরিধির দ্বিগুন হবে। অর্থাৎ পরিধি বা ব্যাস একই থাকবে। পাই এর মান বের করার জন্য একটি বৃত্তের পরিধি ও ব্যাস মেপে গননা করা যেতে পারে। এছাড়াও আরকিমিডিসের পদ্ধতি নামে আরেক্তি পদ্ধতি রয়েছে যেখানে একটি বৃত্ত ও বহুভুজ আকতে হবে। বহুভুজ গুলো সুষম হতে হবে। বাহুর সংখ্যা যতো বেশি হবে বহুভূজের ক্ষেত্রফল বৃত্তের ক্ষেত্রফলের ততো কাছাকাছি হবে। তারপর বৃত্তের ব্যাসার্ধের সঙ্গে এর ক্ষেত্রফলের সম্পর্ক থেকে পাই এর মান গণনা করা যাবে। যত বেশি বহুভুজ আকা হবে পাই এর মান তত বেশি নির্ভুল ভাবে বের করা সম্ভব হবে। আবার গ্রেগ্রি লিবনিতজ এর ধারা থেকেও পাই এর মান বের করা যায়। ১৪০০ সালের দিকে সংগমাগ্রামার মাধব প্রথম সেরকম ধারা খুঁজে পান। এই ধারাটি এখন গ্রেগ্রি লিবনিতজ ধারা নামে পরিচিত কারণ সপ্তদশ শতকে এটি তাদের দ্বারা পুনঃ আবিস্কৃত হয়। দুঃখের বিষয় এর কেন্দ্রীভূততার হার খুবই ধীর। এক্ষেত্রে কতগুল ভগ্নাংশ পাশাপাশি লিখে প্রথম দুই পদে বিয়োগ ও পরের পদ মানে ২য় ও ৩য় পদের সাথে যোগ ও এভাবেই ধারাটি লিখতে হবে। ভগ্নাংশের লব সবসময় ৪ হবে এবং হর হবে ১ থেকে শুরু করে বিজোর সংখ্যা গুলো (একি সংখ্যা দু’বার থাকবে না)। এভাবে বের করার একটা বড় অসুবিধা হল এটি একটি খুবই ধীর প্রক্রিয়া। এমনকি ৩০০০ টি পদ নিয়ে দশমিকের পর মাত্র বিশ ঘর মান সঠিকভাবে পাওয়া যাবে না। তবে ১৪২৪ সালে জ্যোতির্বিদ আল কাশি ১৬ ঘর পর্যন্ত পাই এর মান বের করলে এই রেকর্ড ভেঙ্গে যায়।

পরবর্তীতে ভন চিউলেন জ্যামিতিক পদ্ধতি ব্যাবহার করে দশমিকের পর ৩২ ঘর পর্যন্ত পাই এর মান সঠিক ভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম হন। মহান বিজ্ঞানি স্যার আইজ্যাক নিউটনও পাই -এর জন্য ধারা লিখেছেন এবং ১৫ ঘর পর্যন্ত মান বের করেছেন। জন মাচিন সর্বপ্রথম মাচিন তুল্য সুত্রের সাহায্যে দশমিকের পর ১০০ ঘর পর্যন্ত পাই এর মান বের করতে সক্ষম হন। তখন পর্যন্ত ইতিহাসে তিনিই ছিলেন ১০০ ঘর পর্যন্ত পাই এর  নির্ভুল মান বের করা প্রথম ব্যাক্তি এবং কম্পিউটার আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত এটিই ছিল পাই এর মান বের করার সবচেয়ে সফল সুত্র। সমকালীন সময়ে এ ধরনের আরো অনেক সুত্র প্রচলত ছিল। তবে সেগুলো খুব বেশি পরিচিত ছিল না। কিন্তু ১৮৪৪ সালে এমনি একটি সুত্রের সাহায্যে বিজ্ঞানি জাকারিয়াস ডাসে দশমিকের পর ২০০ ঘর পর্যন্ত পাই এর মান বের করে সমকালীন সকলকেই তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। এরপর ১৯ শতকে উইলিয়াম শশাঙ্ক দশমিকের পর ৫২৭ ঘর পর্যন্ত নির্ভুল মান বের করেন। যদিও তিনি ৭০৭ ঘর পর্যন্ত মান বের করেছিলেন, কিন্তু সামান্য ভুলের কারনে তার সে মান ৫২৭ ঘরে নেমে আসে। তবে তখন পর্যন্ত সেটিই ছিল ইতিহাসে বের করা সবচেয়ে বড় পাই এর মান। ১৯৪৯ সালে ৫০০৮ ঘর পর্যন্ত এনিয়াক কম্পিউটারে সাহায্যে গননা করা হয়। এই গণনার জন্য মাত্র ১৪০ ঘণ্টা বা ৫ দিন এর কিছু বেশি সময় লেগেছিল। বিশ শতকের শুরুতে ভারতীয় গণিতবিদ শ্রীনিবাস রামানুজন পাই এর মান গণনার বেশ কটি নতুন সূত্র বের করেন।

বর্তমানে বিভিন্ন দেশে পাই দিবস পালন করা হচ্ছে।